Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ১৮ মে ২০২৫

জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি

জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি 
(১৫ মে- ১৪ জুন)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
জ্যৈষ্ঠ মাস প্রকৃতিতে ভিন্ন আবেশ নিয়ে আসে। এ সময় দিন বড়ো হয়, প্রকৃতিতে থাকে তাপদাহের তা-ব। ঋতু চক্রের পরিক্রমায় ঋতু পরিবর্তিত হচ্ছে তার আপন গতিতে।  প্রচ- তাপের পাশাপাশি  জ্যৈষ্ঠ মাসে বছরজুড়ে কমবেশি নানান ফল পাওয়া যায় । নানান রং বাহারি ফলের মৌ মৌ গন্ধে ভরিয়ে তোলে চারপাশ। আর কৃষিজীবী ভাইবোনেরাও কৃষি সমৃদ্ধিতে ব্যস্ত থেকে পিপাসা মেটায় বিভিন্ন প্রজাতির রসালো ফল দিয়ে। আর তাই প্রিয় পাঠক চলুন, এক পলকে জেনে নেই জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি উন্নয়নের কাজগুলো।
বোরো ধান
জমিতে রোরো ধান শতকরা ৮০ ভাগ পেকে গেলে ধান সংগ্রহ করে কেটে মাড়াই, ঝাড়াই করে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে করে সময়, শ্রম ও অর্থসাশ্রয়ী শুকনো বীজ ছায়ায় ঠা-া করে প্লাস্টিকের ড্রাম, বিস্কুটের টিন, মাটির কলসি এসবে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। 
আউশ ধান 
আউশের বীজ বোনা বৈশাখ (০৫  বৈশাখ- ১৭  বৈশাখ) মাসে সম্পূর্ণ হয়ে থাকলে চারার বয়স ১৫  থেকে ২০ দিন হলে মূল জমিতে রোপণ করতে হবে। চারা থেকে চারার দূরত্ব ১৫-২০ সেমি. এবং গোছাপ্রতি ২-৩টি চারা রোপণ করা প্রয়োজন। বিঘাপ্রতি ২০ কেজি ইউরিয়া, ৭ কেজি টিএসপি, ১০ কেজি এমওপি, ৫ কেজি জিপসাম ও ০.৭ কেজি জিংক সার প্রয়োজন। তবে টিএসপি সারের পরিবর্তে ডিএপি সার ব্যবহার করলে ১৭ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োজন হবে।    
সর্বশেষ জমি চাষের সময় এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া, অর্ধেক এমওপি, সবটুকু টিএসপি, জিপসাম এবং জিংক সালফেট সার একসাথে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক এমওপি দ্বিতীয় কিস্তিতে ইউরিয়ার সাথে দিতে হবে। ইউরিয়া সার সমান দুই কিস্তিতে যথা রোপণের ১০-১২ দিন পর  ১ম কিস্তি এবং ২০-২৫ দিন পর ২য় কিস্তি প্রয়োগ করতে হবে। সালফারের অভাব পরিলক্ষিত হলে জিপসাম ইউরিয়ার মত উপরিপ্রয়োগ হবে। ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগের সময় জমিতে ২-৩  সেমি. পানি থাকতে হবে অথবা মাটিতে প্রচুর রস থাকতে হবে। ইউরিয়া প্রয়োগে সাথে হাত বা উইডার দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে যাতে সার মাটিতে ভালভাবে মিশে যায়। ফসলের অবস্থার উপর নির্ভর করে সার প্রয়োগের মাত্রা ও প্রয়োগের সময়ে তারতম্য করা যেতে পারে। চারা রোপণের পর অন্তত ৩০-৪০ দিন পর্যন্ত জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। রোপণের পর থেকে দুধ আসা পর্যায় পর্যন্ত জমিতে যথেষ্ট পরিমাণে রস থাকা প্রয়োজন।
আমন ধান
নিচু এলাকায় বোরো ধান কাটার ৭-১০ দিন আগে বোনা আমনের বীজ ছিটিয়ে দিলে বা বোরো ধান কাটার সাথে সাথে আমন ধানের চারা রোপণ করলে বন্যা বা বর্ষার পানি আসার আগেই চারা সতেজ হয়ে ওঠে এবং পানি বাড়ার সাথে সাথে সমান তালে বাড়ে। চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া ছিটিয়ে দিলে চারা তাড়াতাড়ি বাড়ে, ফলন ভালো হয়।
এ মাসের মধ্যেই রোপা আমনের জন্য বীজতলা তৈরি করতে হবে। এছাড়াও স্বল্প সময়ে, অধিক জায়গায় ধানের চারা নির্দিষ্ট, দূরত্বে, সারিবদ্ধভাবে নির্দিষ্ট সংখ্যায়, নির্দিষ্ট গভীরতায় লাগানোর জন্য রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহার করা প্রয়োজন। এ যন্ত্র দ্বারা চারা রোপণের জন্য ট্রে অথবা পলিথিন সিটের উপর চারা উৎপাদন করতে হয়। ৩-৪ পাতা বিশিষ্ট ২০-২২ দিন বয়সের চারা এ যন্ত্রের সাহায্যে জমিতে রোপণ করা যায়। জমি উর্বর হলে সাধারণত কোনো রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না, তবে অনুর্বর হলে প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ২ কেজি জৈবসার মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রতি বর্গমিটার জমির জন্য ৮০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। 
বীজ বোনার আগে অংকুরিত করে নিলে তাড়াতাড়ি চারা গজায়, এতে পাখি বা অন্য কারণে ক্ষতি কম হয়। ভালো চারা পাওয়ার জন্য বীজতলায় নিয়মিত সেচ দেয়া, অতিরিক্ত পানি নিকাশের ব্যবস্থা করা, আগাছা দমন, সবুজ পাতা ফড়িং ও থ্রিপসের আক্রমণ প্রতিহত করাসহ অন্যান্য কাজগুলো সতর্কতার সাথে করতে হবে। 
জ্যৈষ্ঠ মাসে আউশ ও বোনা আমনের জমিতে পামরী পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। পামরী পোকা ও এর কীড়া পাতার সবুজ অংশ খেয়ে গাছের অনেক ক্ষতি করে। আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে হাতজাল, গামছা, লুঙ্গি, মশারি দিয়ে পামরী পোকা ধরে মেরে ফেলে আক্রমণ কমানো যায়। তাছাড়া আক্রান্ত গাছের গোড়া থেকে ৫ সেন্টিমিটার (২ ইঞ্চি) রেখে বাকি অংশ কেটে কীড়া ও পোকা ধ্বংস করা যায়। আক্রমণ যদি বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
পাট
পাটের জমিতে আগাছা পরিষ্কার, ঘন ও দুর্বল চারা তুলে পাতলা করা, সেচ এসব কাজগুলো যথাযথভাবে করতে হবে। 
ফাল্গুনি তোষা জাতের জন্য একরপ্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে রস না থাকলে বা দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে হালকা সেচ দিতে হবে এবং বৃষ্টির কারণে পানি জমে থাকলে তা নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। পাটশাক যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর। তাই নিড়ানির সময় তোলা অতিরিক্ত পাটের চারা ফেলে না দিয়ে শাক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
এ মাসে পাটের বিছাপোকা এবং ঘোড়াপোকা জমিতে আক্রমণ করে থাকে। বিছাপোকা দলবদ্ধভাবে পাতা ও ডগা খায়, ঘোড়াপোকা গাছের কচিপাতা ও ডগা খেয়ে পাটের অনেক ক্ষতি করে থাকে। বিছাপোকা ও ঘোড়াপোকার আক্রমণ রোধ করতে পোকার ডিমের গাদা, পাতার নিচ থেকে পোকা সংগ্রহ করে মেরে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। জমিতে ডালপালা পুঁতে দিলে পোকা খাদক পাখি যেমন- শালিক, ফিঙ্গে এসব পোকা খেয়ে আমাদের দারুণ উপকার করে। আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
তুলা
আগামী আষাঢ়-শ্রাবণ মাস তুলাবীজ বপনের উপযুক্ত সময়। আপনার যদি তুলাচাষ উপযোগী উঁচু জমি থাকে এবং আপনি তুলাচাষে আগ্রহী হোন তাহলে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নিকটবর্তী অফিস/ইউনিট অফিস যোগাযোগ করূন।
শাকসবজি
মাঠে বা বসতবাড়ির আঙ্গিনায় গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির পরিচর্যা সতর্কতার সাথে করতে হবে। এ সময় সারের উপরিপ্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার, গোড়ায় বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, লতাজাতীয় সবজির জন্য বাউনি বা মাচার ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। লতানো সবজির দৈহিক বৃদ্ধি যত বেশি হবে তার ফুল ফল ধারণক্ষমতা তত কমে যায়। সেজন্য বেশি বৃদ্ধি সমৃদ্ধ লতার ১৫-২০ শতাংশের কেটে দিলে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে। 
কুমড়াজাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন হাতপরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে।
এ মাসে কুমড়াজাতীয় ফসলে মাছি পোকা দারুণভাবে ক্ষতি করে থাকে। এ ক্ষেত্রে জমিতে খুঁটি বসিয়ে খুঁটির মাথায় বিষটোপ ফাঁদ দিলে বেশ উপকার হয়। এ ছাড়া সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করেও এ পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়। 
সবজিতে ফল ছিদ্রকারী পোকা, জাবপোকা, বিভিন্ন বিটল পোকা সবুজ পাতা খেয়ে ফেলতে পারে। হাত বাছাই, পোকা ধরার ফাঁদ, ছাই ব্যবহার করে এসব পোকা দমন করা যায়। তা ছাড়া আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলে এবং সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে   বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। মাটির জো অবস্থা বুঝে প্রয়োজনে হালকা সেচ দিতে হবে। সে সাথে পানি নিকাশের ব্যবস্থা সতর্কতার সাথে অনুসরণ করতে হবে।
বিবিধ
বাড়ির কাছাকাছি উঁচু এমনকি আধা ছায়াযুক্ত জায়গায় আদা হলুদের চাষ করতে পারেন। মাঠের মিষ্টি আলু, চীনাবাদাম বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই তুলে ফেলতে হবে। গ্রীষ্মকালীন মুগডালের চাষও এ মাসে করতে পারেন। পতিত বা আধা ছায়াযুক্ত স্থানে অনায়াসে লতিরাজ বা পানিকচু বা অন্যান্য উপযোগী কচুর চাষ করতে পারেন। যারা সবুজ সার করার জন্য ধইঞ্চা বা অন্য গাছ লাগিয়ে ছিলেন, তাদের চারার বয়স ৩৫-৪৫ দিন হলে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সবুজ সার মাটিতে মেশানোর ৭-১০ দিন পরই ধান বা অন্যান্য চারা রোপণ করতে পারবেন।
গাছপালা
আগামী মাসে চারা লাগানোর জন্য জায়গা নির্বাচন, গর্ত তৈরি ও গর্ত প্রস্তুতি, সারের প্রাথমিক প্রয়োগ, চারা নির্বাচন এ কাজগুলো এ মাসেই শেষ করে ফেলতে হবে। উপযুক্ত মাতৃগাছ থেকে ভালোবীজ সংগ্রহ করে নারকেল, সুপারির বীজ বীজতলায় এখন লাগাতে পারেন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের কল্যাণে ও সফলতার জন্য আমরা এক মাস আগেই আগামী মাসের কৃষির করণীয় দিকগুলো স্মরণ করিয়ে দেই। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিলে আরও বেশি লাভবান হবেন। প্রয়োজনে কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩ নম্বরে কল করে জেনে নিতে পারেন। 

লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। টেলিফোন:০২৫৫০২৮৪০৪, ইমেইল : editor @ais.gov.bd