Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

হাইব্রিড বীজ : সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির এক অনন্য হাতিয়ার

সুস্থসবল জীবনের জন্য প্রতিদিন পরিমিত পরিমাণ বিভিন্ন ধরনের সবজি খাওয়া অপরিহার্য। কারণ জীবন ধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন ও খনিজ লবণের অন্যতম উৎস হলো সবজি। বর্তমানে বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সবজির চাহিদা পূরণ করতে হলে ১১.২৪ মিলিয়ন টন সবজির প্রয়োজন। সবজি উৎপাদন হয় ৪.০৫ মিলিয়ন টন। ক্রমহ্রাসমান আবাদি ভূমির চাপকে সমান রেখে সবজির উৎপাদন প্রায় ৩ গুণ বাড়াতে হবে। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র হাইব্রিড সবজির জাত ব্যবহার ও উন্নত চাষাবাদ প্রযুক্তির মাধ্যমেই এই বিশাল সবজির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষকরা খুব অল্প পরিমাণে (৩০-৪০%) সবজির হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করেন। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশেই শতভাগ পর্যন্ত সবজির হাইব্রিড জাত ব্যবহার হচ্ছে।
 

সংকর (হাইব্রিড) ও  সংকরায়ন
সংকরায়ন হলো একটি উদ্ভিদ প্রজনন প্রদ্ধতি, যার মাধ্যমে দুই বা ততোধিক ভিন্ন রকম জেনোটাইপ সম্পন্ন উদ্ভিদসমূহের যৌন মিলনের ফলে নতুন ধরনের জাত সৃষ্টি করা। এর ফলে যে নতুন জাত সৃষ্টি হয় তা হলো সংকর বা হাইব্রিড, আর এ প্রক্রিয়াটি হলো সংকরায়ন (Hybridization)।

 

সংকরায়নের উদ্দেশ্য
*সংকরায়নের প্রধান উদ্দেশ্য হলো কৌলিক বিভিন্নতা সৃষ্টি করা।
*সংকরায়নের মাধ্যমে কোন একটি জাতে অন্যান্য জাতসমূহ বা বন্য প্রজাতিসমূহ থেকে এক বা একাধিক বৈশিষ্ট স্থানান্তরিত করা যায়।
*সংকরায়নের অন্য একটি উদ্দেশ্য হলো প্রজনকদ্বয় অপেক্ষা উন্নতর বা অধিক ফলনশীল (১০-৫০%) পর্যন্ত জাত সৃষ্টি করা।
সংকরায়ন করার পূর্বে নিম্নোক্ত তথ্যাবলি জানা একান্ত প্রয়োজন
*পুং-প্রজনক (Male line) সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান
*স্ত্রী-প্রজনক (Female line) সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান
*গাছসমূহ এক লিঙ্গ না উভয়লিঙ্গ
*ফুল প্রস্ফুটিত  হওয়ার সময়
*ফুল স্বপরাগী (self pollinated)  বা পরপরাগী (Cross pollinated)
ফসল সংগ্রহের সময়  যে কোনো ফসলের হাইব্রিড জাত তৈরি বা সংকরায়নের জন্য অনেকগুলি ধাপ আছে। প্রতিটি  ধাপ সতর্কতার সাথে অতিক্রম করলেই কেবল সংকরায়নে     কৃতকার্যতা আসতে পারে। ধাপগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো:


প্রজনক নির্বাচন : সংকরায়নের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো প্রজনক নির্বাচন। উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভর করে প্রজনক নির্বাচন করতে হয়। যদি আমাদের উদ্দেশ্যে হয় সবজির ফলন বৃদ্ধি, তবে যে লাইনদ্বয়ের ফলন বেশি কেবল মাত্র তাদেরকেই নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে একটিকে পুরুষ লাইন হিসাবে নির্বাচন করতে হবে এবং অন্যটিকে স্ত্রী লাইন নির্বাচন করতে হবে। তবে উভয় লাইন অবশ্যই সমস্বত্ব   (Homozygous) হতে হবে। নির্দিষ্ট লাইন দুটি যদি সমস্বত্ব (Homozygous) না  হয় তবে কখনই সংকর বা হাইব্রিড জাত তৈরি করা যাবে না।


স্ত্রী ও পুরুষ ফুলকে সংকরায়নের জন্য উপযুক্তকরণ ঃ নির্বাচিত স্ত্রী লাইন ও পুরুষ লাইনের স্বস্ব ফুলকে সংকরায়নের জন্য উপর্যুক্ত করে নেওয়া সংকরায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এক্ষেত্রে ফুলের বৈশিষ্ট্যর জ্ঞান থাকা খুবই জরুরি। কোন কোন সবজিতে একই ফুলে পুরুষ (পুংকেশর) ও স্ত্রী (গর্ভমুণ্ড) অংগ বিদ্যমান (যেমন- টমেটো, বেগুন ইত্যাদি) আবার কোন কোন সবজিতে পুরুষ ফুল ও স্ত্রী ফুল একই গাছে আলাদা আলাদা ভাবে থাকে (যেমন- কুমড়াজাতীয় ফসল), আবার কোন কোন ক্ষেত্রে পুরুষ ও স্ত্রী গাছেই আলাদা  (যেমন- পটোল, কাকরোল ইত্যাদি)। সবজির প্রকারভেদ অনুযায়ী কাজের ধরন ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, টমেটো ও বেগুনের ক্ষেত্রে ফুল ফোটার পূর্বের দিন স্ত্রী লাইনের ঐ নির্দিষ্ট ফুল হতে পুরুষ অঙ্গ (পুংকেশর) চিমটার সাহায্যে অপসারণ করা হয়। এই কাজটিকে বলা হয় পুংহীনকরণ (Emasculation) এই পুংহীনকরণ কাজটি বিভিন্নভাবে করা যেতে পারে। তবে চিমটার সাহায্যে অপরিণত ফুল হতে পুরুষ অঙ্গ (পুংকেশর) অপসারণ বেশ প্রচলিত। কিন্তু কুমড়াজাতীয় সবজির ক্ষেত্রে এই কাজটি করা হয় ভিন্নভাবে। এক্ষেত্রে যে স্ত্রী ও পুরুষ ফুল পরের দিন ফোটার সম্ভাবনা আছে, এমন পুরুষ ও স্ত্রী ফুলকে এক বিশেষ ধরনের কাগজের ব্যাগ (Butter paper bag) দিয়ে ঢেকে দিতে হবে যাতে কোন ভাবেই প্রাকৃতিক ভাবে পরাগায়ন না হতে পারে। কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে এই ধরনের কাগজের ব্যাগকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।


পরাগায়ন :  প্রত্যেক সবজির পরাগায়নের সময় নির্দিষ্ট এবং এই সময়কাল ২-৩ ঘণ্টা হয়ে থাকে। ঐ নির্দিষ্ট সময়ে মধ্যে পরাগায়ন না হলে ফল সেট হয় না। যেমন- মিষ্টিকুমড়ার ক্ষেত্রে সকাল ৬ টা হতে সকাল ৯.৩০ পর্যন্ত সবচেয়ে উপযোগী সময়। এর আগে বা পরে পরাগধানী ও পরারেণু কার্যকর অবস্থায় থাকে না। এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (টমেটো ও বেগুনের ক্ষেত্রে (সকাল ৮.৩০ হতে ১০.৩০ পর্যন্ত) ফুটন্ত স্ত্রী ফুল যা পূর্বে পুংহীন করা হয়েছে, তার গর্ভমুণ্ডের উপর কাক্সিক্ষত পুরুষ লাইনের গাছ হতে পুংরেণু (pollen) সংগ্রহ করে তা ভালোভাবে লাগিয়ে দিতে হবে। এরপর বেগুনের ক্ষেত্রে উক্ত স্ত্রী ফুলটিকে পূর্বে উল্লেখিত বিশেষ ব্যাগ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে কিন্তু টমেটোর ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন হয় না। কুমড়াজাতীয় সবজির ক্ষেত্রে, পরাগায়নের পূর্বের দিন ব্যাগ দিয়ে ঢেকে রাখা স্ত্রী ফুলটিকে নির্দিষ্ট সময়ে খুলে কাক্ষিত পুরুষ লাইন হতে পুরুষ ফুলটিকে ছিঁড়ে পাপড়িগুলোকে আলাদা করে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুণ্ডের ওপর ভালোভাবে লাগিয়ে দিতে হবে এবং স্ত্রী ফুলটিকে পুনরায় ঢেকে দিতে হবে। এক্ষেত্রে একটি পুরুষ ফুল দিয়ে ২-৩টি স্ত্রী ফুলকে পরাগায়ন করা যায়। ফুল ঢাকার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, তা হলো ফুল ঢাকার পর ফুলের ভেতর যাতে কোন পিঁপড়া বা অন্য কোন পোকা প্রবেশ করতে না পারে। কাক্সিক্ষত সংকর (হাইব্রিড) ফল সেট হওয়ার ৩-৪ দিন পর ব্যাগ অপসারণ করে দিতে হবে। সংকরায়িত ফলে অবশ্যই বিভিন্ন তথ্য সম্বলিত একটি ট্যাগ ঝুলিয়ে দিতে হবে। ট্যাগের মধ্যে পরাগায়নের তারিখ ও প্রজনক দ্বয়ের নাম অবশ্যই লিখে রাখতে হয়।


বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ : বীজ পরিপক্ব হলে প্রতি গাছের বীজ আলাদা আলাদা ব্যাগে ট্যাগ সহকারে সংগ্রহ করা হয়। বীজ শুকিয়ে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয় যেন তা অন্যান্য বীজের সঙ্গে মিশে যেতে না পারে এবং পোকামাকড় কর্তৃক আক্রান্ত হতে না পারে।


 হাইব্রিড বীজের ব্যবহার :  উপরোক্তভাবে উৎপাদিত সংকর (হাইব্রিড) বীজকে শুধুমাত্র একবারেই  ব্যবহার করা যাবে। কোনভাবেই পরবর্তী বছর তা থেকে বীজ রাখা যাবে না এবং খাবারের জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়।


দিন দিন আমাদের দেশে হাইব্রিড সবজি চাষাবাদ বাড়ছে। আমাদের দেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করার লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সুখী, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে সবজি উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়াতে  হবে। আর এক্ষেত্রে অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে সবজিতে শতভাগ হাইব্রিড বীজের ব্যবহার। হাইব্রিড বীজকে কৃষকের মাঝে জনপ্রিয় করতে হবে এবং সেই সাথে হাইব্রিড সবজি বীজের প্রাপ্যতাও নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি ভ্রান্তধারণা প্রচলিত আছে যে হাইব্রিড সবজির স্বাদ দেশি সবজির মতো হয় না। এ ধারণা সঠিক নয়। হাইব্রিড সবজির স্বাদ নির্ভর করে প্রজনক দ্বয়ের স্বাদের ওপর এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহারের ওপর। মাত্রাঅতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহারের কারণে সবজির স্বাদে কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওয়াতাধীন বিএডিসি ‘বিএডিসির সবজি বীজ বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে হাইব্রিড সবজি বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বিতরণ কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আশা করা যায় এই প্রকল্পের গবেষণা প্রান্তিক পর্যায়ে হাইব্রিড সবজি বীজের স্বল্পমূলে প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে এবং দেশে সবজি চাহিদাপূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে।

 

ড. বাহাউদ্দিন আহমদ       

ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সবজি বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র বিএআরআই, জয়দেবপুর, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৫৫৬৩৬৩৯০১, ই-মেইল : bahauddinmed57@yahoo.com