Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কাজে জৈবপদ্ধতি নিরাপদে থাকুক উদ্ভিদ ও প্রাণী

কৃষি কাজে জৈবপদ্ধতি
নিরাপদে থাকুক উদ্ভিদ ও প্রাণী

কৃষিবিদ মোঃ মুকুল মিয়া

পরিবেশ এবং কৃষি একটি আরেকটির উপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। নিরাপদ কৃষি উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়ের জন্য আবশ্যক। প্রাণী যেমন তার নিজের খাদ্যের জন্য উদ্ভিদের উপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল, ঠিক তেমনি উদ্ভিদও বিভিন্নভাবে প্রাণিদের মাধ্যমে উপকৃত হয়ে থাকে। প্রাণির মাধ্যমে উদ্ভিদের বংশবিস্তার অনেক সময় প্রভাবিত হয়। উদ্ভিদ বায়ুমণ্ডল থেকে  CO2 ও পানি নিয়ে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে ক্লোরোফিলের সাহায্যে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় শর্করা-খাদ্য, অক্সিজেন (প্রাণিকূলের অপরিহার্য উপাদান) ও শক্তি উৎপাদন করে। যে পরিবেশ উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের বসবাসের জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত সেটিই হলো নিরাপদ পরিবেশ। উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বা প্রযুক্তির ব্যবহারমুক্ত কৃষিই হচ্ছে নিরাপদ কৃষি। মানুষ এখন পরিবেশ ও নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে অনেক সচেতন হলেও অনেক সময় অর্থনৈতিক ও শিক্ষার অভাবে অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করে থাকে; পরিবেশ দূষিত করে বা দূষিত পরিবেশে বসবাস করে। কৃষি যদি নিরাপদ হয় তাহলে পরিবেশও নিরাপদ হবে। সুতরাং নিরাপদ কৃষিই নিশ্চিত করে পরিবেশের নিরাপত্তা।
 

জীব বৈচিত্র্যে রাসায়নিক পদার্থের ক্ষতিকর প্রভাব    
আমাদের পরিবেশের চারপাশে যে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা, পশুপাখি, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেগুলো নিয়েই গঠিত হয়েছে জীববৈচিত্র্য। আমরা ফসল উৎপাদনে, উদ্ভিদ ও প্রাণীর চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহার করে থাকি। এছাড়াও বালাই দমনের জন্য ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের পর থেকে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমান সময়ে কৃষি জমিতে আঁগাছা, রোগ ও পোকা দমনে জৈব বালাইনাশকের পরিবর্তে ব্যাপক হারে নিয়ম না মেনে রাসায়নিক কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, ব্যাকটেরিসাইড, কৃমিনাশক (নেমাটিসাইড) ব্যবহৃত হচ্ছে। ফসল উৎপাদনে বা উদ্ভিদের বালাই দমনে ব্যবহৃত এসব রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে কোনো কোনোটির দীর্ঘ মেয়াদি রেসিডিউয়াল ইফেক্ট রয়েছে যা মাটি, পানি ও জীব জগৎকে ব্যাপকহারে দূষিত করছে। এর ফলে জমির উর্বরতা বা ফসল উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মাটি, পানি ও বায়ু দূষিত হয়ে প্রাণিকূলে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাইসহ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করছে।

 

পশুপাখি ও উদ্ভিদ মূলত পরিবেশের খাদ্যশৃঙ্খল ও বাস্তুসংস্থান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যেমন: ফিঙ্গে, শালিক, দোয়েল পাখি ক্ষেতখামারে ফসলের ক্ষতিকর পোকা খায়; ব্যাঙ, সাপ, গুইসাপ ফসল ও পরিবেশের বিভিন্ন ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খায়; টিকটিকি বসতবাড়িতে মশা মাছি খায়। সুতরাং এসব উপকারী প্রাণী, পাখিকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।  রাসায়নিক ওষুধের পরিবর্তে জৈব বালাইনাশক বিশেষ করে কৃষি জমিতে, ফসলে, উদ্ভিদের চিকিৎসায় ব্যবহার করতে হবে। তাহলে মাটি, উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়ের জন্যই ভালো হবে।
 

জৈব বালাইনাশক   
জীবের বিভিন্ন অংশ থেকে প্রস্তুতকৃত বালাইনাশক যা দ্রুত পচনশীল, মাটিতে মিশ্রণীয়, পরিবেশে কোন ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলে না সেগুলোই উদ্ভিদের বালাই দমনে ব্যবহৃত জৈব বালাইনাশক। জৈব বালাইনাশক বিভিন্ন ধরনের হয়। যেমন :


জৈব রাসায়নিক বালাইনাশক
বর্তমানে বাজারে সহজে পাওয়া যায় এবং সরকার অনুমোদিত বেশ কিছু জৈব বালাইনাশক রয়েছে। যেমন: শাক সবজি ও ফলের ক্ষতিকর পোকার পুরুষ মাছিকে মিলনে প্রলুব্ধ করে ফাঁদে ফেলে মেরে ফেলে সেক্স ফেরোমোন। ফসলের মাকড়, পাতা সুরঙ্গকারী পোকা, জাব পোকা দমন করে নিম তেল। ফলের পুরুষ মাছি পোকা দমন করে ফুজি ফ্রুট লিউর। ইহা কুমড়াজাতীয় ফলের পুরুষ মাছি পোকা মেরে ফেলে। ফেরোমোন লিউর বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা মেরে ফেলে। স্পোডো লিউর ফসলের লেদা পোকা এবং অ্যাজাডিরেক্টিন (অ্যাবামেক্টিন, নিমবিসিডিন, ফাইটোম্যাক্স, বায়োনিম প্লাস) ফসলের মাকড়, থ্রিপস, জাব পোকা, সাদা মাছি, হপার পোকা, পাতা সুরঙ্গকারী পোকা দমনে ভূমিকা রাখে। স্পাইনোসেড ফসলের পাতা সুরঙ্গকারী পোকা, বরবটির ফল ছিদ্রকারী পোকা, কাটুই পোকা, বেগুন ও ঢেঁড়সের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা, থ্রিপস দমনে উপকারী। ফাইটোক্লিন ফসলের মাকড়, ছাত্রা পোকা, জাব পোকা, সাদা মাছি দমন করে। মোনেক্স ০.৫ ডব্লিউপি টমেটোর ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট, আলু, মরিচ, বাঁধাকপি, মূলার ঢলে পড়া রোগ দমন করে। ডিকোপ্রাইমা বেগুনের ছত্রাকজনিত ঢলে পড়া রোগে বেশ কার্যকর।

 

অণুজীব বালাইনাশক
অণুজীব (ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়া) হতে তৈরীকৃত বালাই দমনকারী ওষুধই হলো অণুজীব বালাইনাশক। কিছু অণুজীব বালাইনাশক রয়েছে যা ফসলের আগাছাও দমন করতে পার। কয়েকটি অনুজীব বালাইনাশকের উদাহরণ যেমন- ট্রাইকোডার্মা কাইলোনিজ, ট্রাইকোডার্মা জ্যাপোনিকাম, ট্রাইডার্মা ভিরিডি, ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস, নিউক্লিয়ার পলিহেড্রোসিস ভাইরাস (এনপিভি) ইত্যাদি। ট্রাইকোডার্মা প্রকৃতি থেকে আহরিত এমনই একটি অণুজীব যা জৈবিক পদ্ধতিতে উদ্ভিদের রোগ দমনে ব্যবহার করা হচ্ছে। মাটিতে মুক্তভাবে বসবাসকারি উপকারি ছত্রাক যা উদ্ভিদের শিকড়স্থ মাটি, পচা আবর্জনা ও কম্পোস্ট ইত্যাদিতে অধিক পরিমাণে ট্রাইকোডার্মা পাওয়া যায়। এটি মাটিতে বসবাসকারি উদ্ভিদের ক্ষতিকর জীবাণু যেমন- ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও কৃমি বা নেমাটোডকে মেরে ফেলে। ট্রাইকোডার্মা কাইলোনিজ ও ব্রাকন বরবটি, শিম, ঢেঁড়সের ফল ছিদ্রকারী পোকা, কাটুই পোকা, কুমড়ার লেদা পোকা দমন করে। ট্রাইকোডার্মা (ট্রাইকস্ট ১% ডব্লিউপি) সবজির ঢলে পড়া, শিকড় ও গোড়া পচা, পাতায় ঝলসানো রোগ দূর করে। ট্রাইকোডার্মা (বায়োডার্মা, বাউ-বায়োফানজিসাইড) পানের পাতা পচা, কাণ্ড, শিকড় ও গোড়া পচা রোগ দূরীকরণে বেশ ব্যবহার্য্য। এছাড়াও মসুর ডালে নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী কিছু ব্যাকটেরিয়া সম্প্রতি আবিষ্কার হয়েছে যা ঐ গাছের শিকড়ে নডিউল তৈরির মাধ্যমে জমিতে ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমায়।

 

উদ্ভিদজাত/ভেষজ জৈব বালাইনাশক
উদ্ভিদ/উদ্ভিদাংশ বা জৈব উৎস থেকে উৎপন্ন বালাইনাশককে জৈব বালাইনাশক বলে। আবহমানকাল থেকেই মানুষের স্বাস্থ্য সেবায়, কৃষি ফসল উৎপাদন ও সংরক্ষণে গাছ-গাছালি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যেমন, নিমের থেঁতলানো বীজ, ছাল এবং গুড়া সাবান একত্র করে মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে তা ঠাণ্ডা করে ছেঁকে নিয়ে পানি যোগ করে স্প্রে করলে পাতা মোড়ানো পোকাসহ বিভিন্ন ধরনের কীড়া ও গান্ধী পোকা, মাছি পোকা, বিটল পোকা, কীড়া ও বিছা পোকা দমন করা যায়। নিম ও ধুতরা গাছের শুকনো পাতার গুঁড়া গুদামজাত ফসলের পোকা দমনে উপকারী। মেহগনির ফলের সাদা কুচি কুচি অংশ পানিতে ভিজিয়ে রেখে ডিটারজেন্ট পাউডার মিশিয়ে ছেঁকে স্প্রে করলে বাদামি গাছফড়িং, মাজরা, পাতামোড়ানো ও ডায়ামন্ড ব্যাকমথ দমন করা যায়। তামাকের শুকনো পাতা ভেজানো পানি ছেঁকে নিয়ে ফসলে প্রয়োগ করলে মাইট ও জেসিড দমন করা যায়। বিষকাটালী বা ঢোল কলমীর পেষানো পাতা-কাণ্ড পানিতে ভিজিয়ে ছেঁকে নিয়ে স্প্রে করলে এফিড, মাছি, পাতা ও ফলখেকো কীড়া দমন করা যায়। কালো কচুর পাতাসিদ্ধ পানি স্প্রে করলে ফসলের কীড়া, বাদামি গাছফড়িং, পাতা শোষক পোকা মারা যায়। শুকনা মরিচের গুঁড়া, পানি এবং গুঁড়া সাবান মিশিয়ে পানি যোগ করে স্প্রে করলে শশার মোজাইক ভাইরাস রোগের বাহক, পিঁপড়া, জাব পোকা দমন হয়। পাট বীজ কড়াইতে ভেজে নিয়ে গুঁড়া করে পানিতে ভিজিয়ে এক রাত রেখে ছেঁকে নিয়ে জমিতে স্প্রে করলে ধানের মাজরা, বাগ, পাতা শোষক পোকা দমন করা যায়। রসুনের রস ও নিমের পাতা ও বীজ দ্বারা পাটসহ বিভিন্ন ফসলের বীজ শোধন করলে বীজবাহিত রোগবালাই দূর করা হয়। পেঁপে পাতা কুচি কুচি করে কেটে পানি মিশিয়ে এক রাত রেখে উহাতে পানি যোগ করে ছেঁকে নিয়ে  স্প্রে করলে ফসলের পাউডারি মিলডিউ রোগ নিরাময় হয়। গাঁদা ফুলের থেঁতলানো শিকড়ের সাথে পানি করে যোগ করে এক রাত রেখে ছেঁকে নিয়ে জমিতে বীজ বপনের সময় স্প্রে করলে মাটিতে থাকা কৃমি মারা যাবে।


রাসায়নিক বালাইনাশকের চেয়ে জৈব বালাইনাশক বিষাক্তহীন বা কম বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহারকারীর কোন স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। ইহা কেবল নির্দিষ্ট বালাইকে দমন করে, অন্য কোন ইকোসিস্টেমের ক্ষতি করে না। এ ধরনের বালাইনাশক প্রাকৃতিক পরিবেশে দ্রুত নিঃশেষিত হয় বলে এদের কোন ধরনের রেসিডিউয়াল ইফেক্ট নেই। কোন কোন ফসলে জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে অধিক ফলন দে। এ ধরনের বালাইনাশক প্রয়োগকৃত ফসল খাওয়া নিরাপদ এবং ফসলের উৎপাদন খরচও অনেক কম।

লেখক : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয়, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭। মোবাইল : ০১৫২০-০৮৩০৮৮, ই-মেইলঃ mukulbjribreeding@gmail.com