Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ফলন বৃদ্ধিতে আগাম আখ চাষের কোনো বিকল্প নেই

ফলন বৃদ্ধিতে আগাম আখ চাষের কোনো বিকল্প নেই
নিতাই চন্দ্র রায়
আখ একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল। আখ রোপণ থেকে মাড়াই পর্যন্ত ১২-১৪ মাস সময়ের দরকার হয়। ওই সময়ে একই জমিতে আমন ধান, আলু ও ভুট্টার  মতো তিনটি ফসল চাষ করা যায়।
পৃবিবীতে সবচেয়ে বেশি আখ উৎপাদিত হয় ব্রাজিলে তারপর ভারতে। ভারতে বছরে আখ উৎপাদিত হয় ৪০ কোটি ৫৪ লাখ টন। আর আমাদের দেশে বর্তমানে বছরে আখ উৎপাতি হয়  মাত্র ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার টন, যা  প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত কম। ক্রমবর্দ্ধমান ঘ্রাণ সংখ্যা এবং জমির কারণে। বাংলাদেশে আখ চাষের জমির পরিমাণ বৃদ্ধি  করে আখের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়।  আখ চাষের আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উলম্বভাবে আখের উৎপাদন বাড়াতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে হবে আগাম আখের সাথে আলু ও পেঁয়াজের মতো একটি মূল্যবান সাথি ফসলের চাষ ও অথবা একবার নতুন আখ করেও দুই বার মুড়ি আখ চাষের মাধ্যমে। বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি আখের গড় ফলন ৪৬ টন। আখের ফলন বৃদ্ধির যেসব প্রযুক্তি রয়েছে তার মধ্যে আগাম আখ চাষ অন্যতম।
আগাম আখের অনেক গুণ-বেশি চারা, বেশি কুশি’ ফলন দ্বিগুণ। আগে কৃষক আউশ ধান ও পাট কেটে ঐ জমিতে আগাম আখের চাষ করতেন।  এখন অধিকাংশ কৃষক আমন ধান কাটার পর ঐ জমিতে রবি ফসলের চাষ করেন। রবি ফসল তোলার পর  জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে আখের চাষ করেন। বাংলাদেশে আখ চাষের উপযুক্ত সময় সময় হলো- অক্টোবর  থেকে  মধ্য ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ সময়ে অধিকাংশ জমিতে আমন ধান  থাকার কারণে চাষির ইচ্ছে থাকলেও  আগাম আখ চাষ করতে পারেন না।  তাই আগাম আখ চাষ বৃদ্ধি করতে হলে নির্বাচিত জমিতে স্বল্প জীবনকালের আমন ধানের চাষ করে  নভেম্বর মাসের  মাঝামাঝি আমন ধান কেটে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কৃষক আগাম আখের চাষ করতে পারেন। আমনের এইসব আগাম জাতের মধ্যে রয়েছে  বিনা-৭, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭৫ উল্লেখযোগ্য।
শুধু আগাম আখ চাষের মাধ্যমে আখের ফলন শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ এবং চিনিগুড়ের আহরণ হারও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো যায়। আগাম আখ চাষের অনেক  সুবিধা রয়েছে যেমন- ১. জমিতে প্রচুর রস থাকে। ২. মাটিতে সন্তোষজনক তাপমাত্রা বিরাজ করে। ৩.বীজের পরিমাণ কম লাগে। ৪.ভালো অঙ্কুরোদগম  হয়।  ৫.খরা ও বন্যা প্রতিরোধ করতে পারে। ৬. অধিক কুশি গজায়। ৭.জমিতে তেমন ফাঁকা জায়গা থাকে না। ৮. পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কম হয়। ৯. পদ্ধতিগতভাবে সাথী  সফলের চাষ করা যায়। ১০. আগাম আখে চিনি/গুড় আহরণ হার বেশি থাকে ।
 আগাম আখ রোপণের সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।
 জমি নির্বাচন : উঁচু ও  মাঝারি উঁচু  জমি যেখানে বন্যা বা বৃষ্টির পানি জমে থাকে না, সেসব জমি আগাম আখ চাষের জন্য উপযোগী। তবে বালু মাটি ছাড়া যেকোনো মাটিতেই সফলভাবে আখের চাষ করা যায়। দো-আঁশ,  বেলে দো-আঁশ  এবং এঁটেল দো-আঁশ মাটি আখ চাষের জন্য উত্তম।
জাত নির্বাচন : সফলভাবে আখ চাষের জন্য প্রথম কাজটি হলো একটি  উন্নত, উচ্চফলনশীল  আখের জাত নির্বাচন। উঁচু জমির জন্য ঈশ্বরদী ১৬, ঈশ^রদী ২৬, ঈশ^রদী ৩২, ঈশ^রদী ৩৩, ঈশ^রদী ৩৫, ঈশ^রদী ৩৭,  ঈশ^রদী ৩৯, ঈশ^রদী ৪০, বিএসআরআই আখ ৪৩, বিএসআআর আই আখ ৪৪, বিএসআরআই আখ ৪৫ ও বিএসআরআই আখ ৪৮ নির্বাচন করা যায় । মাঝারি উঁচু জমির জন্য ঈশ^রদী ২০, ঈশ^রদী ২১ , ঈশ^রদী ৩৪, বিএসআরআই আখ  ৪৬, বিএসআরআই আখ ৪৫, ঈশ^রদী ২/৫৪ ও এলজে-সি জাতের আখ নির্বাচন করতে হবে। চিবিয়ে খাওয়া ও রস তৈরির জন্য বিএসআরআই আখ ৪১, বিএসআরআই আখ ৪২ (রংবিলাস), বিএসআরআই আখ ৪৭, মিশ্রিমালা, বনপাড়া গেন্ডারী ও কিউ ৬৯ জাতের আখ নির্বাচন করা উচিত।  চিনি ও গুড় তৈরির চেয়ে চিবিয়ে খাওয়া ও কাঁচা রস বিক্রিতে অনেক বেশি আয় করা যায়। দেশের কোনো কোনো স্থানে একটি চিবিয়ে খাওয়া জাতের আখ ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি করা হয়।  আর এক গ্লাস আখের কাঁচা রস বিক্রি করা হয় ১৫ টাকা। একটি পরিপুষ্ট আখ থেকে ৪ গ্লাস রস পাওয়া যায়। সে হিসেবে একটি আখের দাম দাঁড়ায় ৬০ টাকা।
জমি তৈরি : আখ লম্বা কা-  ও প্রচুর শিকড় বিশিষ্ট দীর্ঘ মেয়াদি ফসল। রোপণ থেকে কাটা পর্যন্ত ১২ থেকে ১৪ মাস সময় লাগে। আখের শিকড় মাটির বেশ গভীরে প্রবেশ করে। শিকড়গুচ্ছ যাতে  অবাধে বিস্তার লাভ করে মাটি হতে প্রচুর খাদ্য উপাদান গ্রহণ করতে পারে সেজন্য ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি গভীর করে আড়াআড়িভাবে ৪ থেকে ৫টি চাষ ও মই আখের জমি  তৈরি করতে হবে ।
নালা তৈরি : ভাল ফলনের জন্য কোদাল দিয়ে ৮ থেকে ৯ ইঞ্চি গভীর নালা তৈরি করতে হবে। এটেল দো-আঁশ মাটির জন্য নালা থেকে নালার দূরত্ব হবে ৩ ফুট এবং দো-আঁশ মাটির জন্য নালা থেকে নালার দূরত্ব হবে ২.৫ ফিট।
বীজ নির্বাচন : আখের অধিক ফলনের জন্য  অনুমোদিত জাতের সুস্থ-সবল পুষ্টি সমৃদ্ধ রোগ ও পোকামাকড় মুক্ত প্রত্যায়িত বীজক্ষেতের আখ বীজ হিসেবে নির্বাচন করা উচিত। বীজের জন্য ৮ থেকে ৯ মাস বয়সের আখই বেশি উপযোগী। আখের বয়স বেশি হলে উপরের অর্ধেক অংশ বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই শিকড় গজানো, চোখ ফোটা, রোগ ও পোকা আক্রান্ত আখ বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
বীজ খ- তৈরি ও শোধন : আগাম আখ রোপণের জন্য ধারালো দা বা হাসুয়া দিয়ে ২ চোখ বিশিষ্ট বীজ খ- তৈরি করতে হবে।  যে হাঁসুয়া বা দা দিয়ে আখ বীজ কাটা হবে, তা মাঝেমধ্যে আগুনে ঝলসিয়ে নিতে হবে। মাটিতে বসবাসকারী রোগজীবাণুর হাত থেকে বীজখ-কে মুক্ত রাখতে রোপণের পূর্বে বীজখ-গুলো  অটোস্টিন বা নোইন নামক ছত্রাক নাশকের ০.১% দ্রবণে আধা ঘণ্টশোধন করতে হবে।
নালায় সার ও কীটনাশক প্রয়োগ : ভালো ফলনের জন্য নালায় একরপ্রতি ৭২ কেজি টিএসপি, ৫৫ কেজি ইউরিয়া, ৫৩ কেজি পটাশ, ৫ কেজি জিপসাম,২.৫ কেজি দস্তা ও ২০০ কেজি খৈল প্রয়োগ  করে নালার ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি তলদেশ ভালোভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
বীজখ- রোপণ ও মাটি শোধন : বীজখ- রোপণের সময় বীজখ-ের চোখ দুই পাশে রাখতে হবে। বীজখ-গুলো উঁই পোকার আক্রমণ হতে রক্ষার জন্য  নালার মাটিতে বীজখ-  স্থাপনের পর বীজখ-ের উপর দু’ আঙুলের চিমটি দিয়ে একর প্রতি ৬ কেজি পাইরিব্যান-১৫জি প্রয়োগ করে ২ ইঞ্চি গুঁড়া মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। পাইরিব্যানের অভাবে নালায় একরপ্রতি ৬ কেজি রিজেন্ট -৩ জিআর ব্যবহার করতে হবে। লাল ও বালু মিশ্রিত মাটিতে আখ রোপণের সাথে সাথে , দোআঁশ ও এটেল দোআঁশ মাটিতে আখ রোপণের ৭দিনের মধ্যে একটি হালকা সেচ দিতে হবে।
ফাঁকা স্থান পূরণ : আখ রোপণের ৩০ দিনের মধ্যে সাধারণত দু’ফুট দূরত্বের মধ্যে কোনো চারা  না গজালে  তাকে ফাঁকা স্থান হিসেবে চিহ্নিত করে একই জাতের চারা বা বীজ খ- দ্বারা ওই ফাঁকা স্থান পূরণ করতে  হবে। বাংলাদেশে সরাসরি রোপণকৃত আখের জমিতে শতকরা ৩৩ ভাগ ও মুড়ি আখের জমিতে  শতকরা  ৫০ ভাগ পর্যন্ত ফাঁকা স্থান থাকে, যা আখের ফলন বৃদ্ধির প্রধান অন্তরায়।
মাটি আলগাকরণ : সেচ কিংবা ভারী বৃষ্টিপাতের পর জমিতে জো আসার সাথে সাথে বীজখ-ের ওপরের শক্ত মাটির স্তর অবশ্যই আলগা করে দিতে হবে। অন্যথায় অক্সিজেনের অভাবে অঙ্কুরোদগম ব্যাহত হবে।  
আগাছা দমন : আগাছা আখের সাথে পানি ও খাবারে জন্য প্রতিযোগিতা করে। রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। তাই রোপণের ৩০ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে  আখক্ষেতের আগাছা অবশ্যই কোদাল বা নিড়ানি দ্বারা দমন করতে হবে।
সারের উপরি প্রয়োগ : আখ রোপণের  ৯০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে একরপ্রতি ৫৫ কেজি ইউরিয়া ও ৫২ কেজি পটাশ সার আখের সারি থেকে ৬ ইঞ্চি  দূরে লাঙ্গল দিয়ে ভাউর টেনে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।  জমিতে রসের অভাব হলে সাথে সাথে সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
আখের পাতা ও নাবী কুশি ব্যবস্থাপনা : নাবী কুশি ও পুরাতন পাতা আখের ফলন এবং চিনি আহরণ হার কমিয়ে দেয়।  এ জন্য এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে  ১ থেকে ২ বার  প্রতি ঝাড়ে  ৮ থেকে ১০টি পরিপুষ্ট আখ রেখে অতিরিক্ত  কুশি ও পুরাতন পাতা কেটে দিতে হবে। আগাম আখের বেলায়  ৮ থেকে ১০ কুশি  হওয়ার পর আখ গাছের গোড়ায় কোদাল দিয়ে মাটি  তুলে দিতে হবে। ভাদ্র থেকে কার্তিক মাসে আখ যাতে বৃষ্টি ও ঝড়ো হওয়ায় হেলে না পড়ে এজন্য  শুকনো পাতা দিয়ে প্রতিটি ঝাড় আলাদাভাবে বেঁধে দিতে হবে।
সেচ ও পানি নিষ্কাশন : ফাল্গুন-চৈত্র মাসে  কয়েক সপ্তাহ পরপর জমিতে ২ থেকে ৪ বার  ৪ থেকে ৫ একর/ইঞ্চি পানি দিলে আখের ফলন  উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে বর্ষাকালে  আখের জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে আখক্ষেতে জমা পানি  নালা কেটে দ্রুত বের করে দিতে হবে।
আখের ফলন :  আখের বয়স ১২ থেকে ১৪ মাস হলে আখ পরিপক্ব হয়। আখে ফুল আসা পরিপক্বতার একটি লক্ষণ। পরিপক্ব আখ  ধারালো কোদাল দিয়ে মাটির সমতলে কাটা উচিত। আগাম আখ চাষের মাধ্যমে  অনায়াসে একর প্রতি ৩০ থেকে ৩৫ টন ফলন পাওয়া যায়। যার বর্তমান বাজারমূল্য ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২লাখ টাকা। উৎপাদন খরচ ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বাদ দিলে  একর প্রতি নিট লাভ দাঁড়ায় ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। বর্তমান ঠিকানাঃ জিপাল প্লাজা, ৩৮ রামবাবু রোড, নতুন বাজার, ময়মনসিংহ। মোবাইল: ০১৭২২৬৯৬৩৮৭। ইমেইল:netairoy18@yahoo.com