Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

আধুনিক পদ্ধতিতে মাষকলাই ডাল চাষে ফলন ও লাভ বেশি আসে

আধুনিক পদ্ধতিতে মাষকলাই ডাল 
চাষে ফলন ও লাভ বেশি আসে
ড. মোঃ কামরুজ্জামান১ সৌরভ অধিকারী২
মাষকলাই বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত ডাল ফসল। ভারতীয় উপমহাদেশে এই ডাল শস্যটি সবথেকে বেশি প্রচলিত এবং বহুল ব্যবহৃত। বাংলাদেশে যেসব ডাল জাতীয় ফসল চাষ হয় তার মধ্যে মাসকলাই চতুর্থ স্থানে। দেশে মোট উৎপাদিত ডালের মধ্যে মাষকলাই এর উৎপাদন ৯-১১%। এজন্য ডাল ফসল হিসেবে মাষকলাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাষকলাই খরা সহিষ্ণু এবং উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল ফসল হিসেবে পরিচিত। মাষকালাই খেতে সুস্বাদু এবং রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ। এতে রয়েছে প্রোটিন ও লৌহ যা দেহের বল ও পুরুষের শুক্রাণু বৃদ্ধি করে এবং পেশি গঠনে ভূমিকা রাখে। ফাইবার, যা খাবার হজমে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। ম্যাগনেশিয়াম যা রক্তপ্রবাহ বাড়ায় এবং হৃদযন্ত্র ভালো রাখতে সাহায্য করে। শরীরে কোলস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে এ ডাল উপকারী। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণাতেও মাষকলাই ডালের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি দেখা গেছে। ত্বকের চর্চা ও মাথার খুশকি দূর করতেও এর ব্যবহার রয়েছে। 
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর সুপারিশ মতে আমাদের সুষম খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন জনপ্রতি ৪৫ গ্রাম ডালের চাহিদা থাকলেও আমরা পেয়ে থাকি মাত্র ১২-১৫ গ্রাম। ডালের গুরুত্বকে তুলে ধরার জন্য সংস্থাটি প্রতি বছর ১০ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক ডাল দিবস হিসেবে উদযাপন করে আসছে। প্রতি বছর আমাদের প্রায় ২৬ লাখ টন ডালের চাহিদা রয়েছে যার বিপরীতে উৎপাদন হয় মাত্র ১০ লাখ মেট্রিক টন এবং আমদানি করা হয় ১০-১২ লাখ টন (কৃষি ডাইরি, ২০২২) আর বাকি ৫-৬ লাখ টন ঘাটতিই রয়ে যায়। বিদেশ থেকে ডাল আমদানি করতে প্রতি বছর আমাদের প্রায় ৮-৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। তবে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ডাল ফসল চাষের সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে ডালের আমদানি নির্ভরতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করা সম্ভব। 
দেশের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে আউশ ধান/পাট-পতিত-রবি ফসল এই শস্যবিন্যাসে প্রায় ৮০-৯০ দিন জমি পতিত পড়ে থাকে। পতিত সময়ের এই জমিগুলোকে মাষকলাইয়ের চাষের আওতায় আনা সম্ভব। এছাড়া খরিফ-১ মৌসুমের মাষকলাই সংগ্রহের পর সকল উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে খরিফ-২ মৌসুমে আবারও মাষকলাই চাষ করা যায়। অভিযোজনক্ষমতা বেশি থাকায় বিভিন্ন রাস্তা ও বাঁধের ধারে, পুকুর পাড়ে এবং বিভিন্ন ধরনের ফল বাগানেও মাষকলাই চাষ করা যায়। বিগত ১০ বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী উচ্চফলনশীল জাত ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডালের ফলন ২.০ বা তার বেশি গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। কৃষি ডাইরি ২০২৪ অনুযায়ী, ডালের এলাকা, উৎপাদন ও ফলন অনেক বেড়েছে। যেখানে ২০১২ সালে প্রতি হেক্টরে ডালের গড় ফলন ছিল ৮০০ কেজি, সেখানে ২০২৪ সালে হয়েছে ১২৭১ কেজি। সঠিক নিয়ম মেনে মাষকলাই চাষ করলে আরও অধিক লাভবান হওয়া যাবে। 
মাষকালাই উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি
জাত নির্বাচন : বাংলাদেশে চাষকৃত মাষকলাই এর বেশ কিছু উন্নত ও স্থানীয় জাত রয়েছে। এর ভিতর বেশ কিছু ঊফশী জাত যেমন :  বারি মাষ-১(পান্থ), বারি মাষ-২(শরৎ), বারি মাষ-৩(হেমন্ত), বারি মাস-৪, বিনা মাষ-১ এবং 


বিনা মাষ-২ এবং বেশ কিছু স্থানীয় জাত যেমনঃ রাজশাহী, সাধুহাটি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উচ্চফলনশীল জাতগুলোর জীবনকাল ৬০-৮০ দিন, গাছগুলো খাটো হতে মধ্যম আকৃতির হয়। মাষকলাইয়ে আমিষের পরিমাণ ২১-২৪%, এবং ফলন ১৫০০-২০০০ কেজি পর্যন্ত হয়। 
জমি নির্বাচন ও চাষ : মাষকলাই চাষের জন্য সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি উপযোগী। পানি জমাট বাধার আশঙ্কা থাকে না এমন উঁচু থেকে নিচু সব ধরনের জমিতে মাষকলাই চাষ করা যায়। উষ্ণ ও শুকনো জলবায়ু মাষকলাই চাষের জন্য উপযোগী। মাষকলাই চাষের জন্য খুব মিহিভাবে জমি তৈরির প্রয়োজন হয় না। জমি ও মাটির প্রকারভেদে ২-৩টি আড়াআড়ি চাষ ও ৪-৫টি মই দিয়ে জমি সমান করে তৈরি করতে হয়। এতে বীজের অংকুরোদগমের হার বেড়ে যায় এবং ফসলের বৃদ্ধিও ভালো হয়।
বীজ বপনের সময় ও বপন পদ্ধতি : মাষকলাই বীজ ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বপন করা যায় অর্থাৎ খরিফ-১ ও খরিফ-২ মৌসুম। খরিফ-১ মৌসুমে ফেব্রুয়ারির শেষ হতে মধ্য মার্চ এবং খরিফ-২ মৌসুমে আগস্টের ২য় সপ্তাহ হতে সেপ্টেম্বরের ১ম সপ্তাহ পর্যন্ত বীজ বপন করতে হবে। মাষকলাইয়ের বীজ ছিটিয়ে বা সারি করে বপন করা যায়। তবে বীজের জন্য সারিতে বপন করা ভালো। সারিতে বপন করার ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি. রাখতে হয়। সারিতে বীজগুলো ৩-৪ সেমি. গভীরে বপন করা হয় যাতে অংকুরোদগম ভালো হয় এবং পাখি বীজ নষ্ট করতে না পারে। ছিটানো পদ্ধতিতে শেষ চাষের সময় মই দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হয়।
উল্লেখ্য বীজ বাহিত রোগ দমনের জন্য বীজ শোধন করে বপন করা দরকার।
সার ব্যবস্থাপনা : গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে মাষকলাই চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে উর্বরতার উপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা ঠিক করা হয়। তবে জৈবসার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকে। তবে কম উর্বর জমিতে মাষকলাই চাষাবাদে  হেক্টর প্রতি ইউরিয়া ৪০-৫০ কেজি, টিএসপি ৮০-৯০ কেজি, এমওপি ৪০-৪৫ কেজি প্রয়োজন হয়। জমি তৈরির শেষ চাষের সময় সবসার একসাথে প্রয়োগ করতে হবে। জীবাণু সার প্রয়োগ করা হলে ইউরিয়া সার প্রয়োগের দরকার হয় না। প্রতি কেজি বীজের জন্য ৮০ গ্রাম হারে অণুজীব সার প্রয়োগ করতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা : মাষকলাইয়ের জমিতে পোকা ও রোগের আক্রমণ দেখা দিলে তা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। বপনের পর জমিতে রসের পরিমাণ কম বা অভাব হলে হালকা সেচ দিতে হবে। সেচের পর ‘জো’ অবস্থায় আসলে মাটির উপরের স্তর ভেঙে দিতে হবে। চারা গজানোর পর আগাছা দেখা দিলে ১৫-২০ দিন পর নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে। মাষকলাইয়ের জমিতে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা থাকলে পানি বের করার ব্যবস্থা করতে হবে।
রোগ দমন ব্যবস্থাপনা
পাতার দাগ রোগ : এ রোগটি হয় সারকোস্পোরা নামক ছত্রাক দ্বারা। আক্রান্ত পাতার উপর ছোট ছোট লালচে বাদামি গোলাকৃতি হতে ডিম্বাকৃতির দাগ পড়ে। আক্রান্ত অংশের কোষসমূহ শুকিয়ে যায় এবং পাতা ছিদ্র হয়ে যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাতা ঝলসে যায়। পরিত্যক্ত ফসলের অংশ, বায়ু ও বৃষ্টির মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। শতকরা ৮০ ভাগের বেশি আর্দ্রতা ও ২৮ ডিগ্রি সে. এর বেশি তাপমাত্রায় এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। রোগ প্রতিরোধী জাতের (পান্থ, শরৎ ও হেমন্ত) মাষকলাই চাষ করতে হবে। আক্রমণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে ছত্রাকনাশক অটোস্টিন-৫০ ডব্লিউপি প্রতি লিটার পানিতে ২.০ গ্রাম মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
পাউডারি মিলডিউ রোগ : ওইডিয়াম প্রজাতির ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে (খরিফ-২) বীজ দেরিতে বপন করলে এ রোগের প্রকোপ দেখা যায়। এ রোগে পাতার উপর পৃষ্ঠে পাউডারের মতো আবরণ পড়ে। হাতে স্পর্শ করলে ছত্রাককে পাউডারের গুঁড়ার মতো লাগে। পাতা হতে লক্ষণ পরবর্তীতে কা-, ফুল ও ফলে ছড়াতে পারে। বীজ, পরিত্যক্ত গাছের অংশ ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। এ রোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইলে রোগমুক্ত উৎস হতে প্রাপ্ত বীজ সময়মত বপন করতে হবে। বীজ ছত্রাকনাশক দ্বারা শোধন করে বপন করা উচিত। বিকল্প পোষক ও গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। টিল্ট-২৫০ ইসি/০.৫ মিলি বা থিওভিট ৮০ ডব্লিউপি ২.০ গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে রোগের আক্রমণের শুরু হতে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার প্রয়োগ করতে হবে। 
হলদে মোজাইক ভাইরাস : মোজাইক ভাইরাস দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত পাতার উপর হলুদ ও গাঢ় সবুজ মিশ্র মোজাইকের মতো দাগ পড়ে। কচি পাতা প্রথমে আক্রান্ত হয়। দূর থেকে আক্রান্ত জমি হলদে মনে হয়। আক্রান্ত বীজ ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। সাদা মাছি এ রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। বিকল্প পোষক ও সাদা মাছি বেশি হলে এ রোগ দ্রুত ছড়ায়। এ রোগ দমনে রোগমুক্ত বীজ বপন করতে হবে। সাদা মাছি দমনের জন্য ম্যালাথিয়ন স্প্রে করতে হবে। রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে বা মাটি চাপা দিতে হবে। শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে। রোগ প্রতিরোধী জাতের মাষকলাইয়ের চাষ করতে হবে। বারি ও বিনার উচ্চফলনশীল মাষকলাই এর জাতগুলো এ রোগের সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন।   
পোকা দমন ব্যবস্থাপনা
বিছা পোকা : এ পোকা মাষকলাই ফসলের অন্যতম শত্রু। এ পোকা পাতা, অপরিপক্ব সবুজ ফলের রস খেয়ে ফেলে। আক্রান্ত পাতাসহ সমস্ত গাছ সাদা জালিকার মতো হয়ে যায়, ফলে ফলন কমে যায়। এ পোকার আক্রমণ দেখা দিলে হাত দ্বারা সেগুলোকে সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে পরিমাণ মতো সাইপারমেথ্রিন ইসি ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া পূর্ণ বয়স্ক পোকা ও কীড়া উভয়ই গুদামজাত মাষকলাই ডালের ক্ষতি করে থাকে। এ পোকা ডালের খোসা ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে শাঁস খেতে থাকে। ফলে দানা হালকা হয়ে যায়। এর ফলে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় এবং খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়। বীজের জন্য টন প্রতি ৩০০ গ্রাম ম্যালাথিয়ন বা সেভিন শতকরা ১০ ভাগ গুঁড়া মিশিয়ে প্রয়োগ করলে পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। 
জাব পোকা : এ পোকা দলবদ্ধভাবে গাছের পাতা, কা-, ও ফুল-ফলের রস চুষে খায় ফলে বীজ পুষ্ট হতে পারে না। জাব পোকা দেখা গেলে ডাইমেথয়েট গ্রুপের যেকোনো কীটনাশক মোড়কের গায়ে উল্লেখিত মাত্রায় স্প্রে করে সহজেই দমন করা যায়।
ফসল কাটা, মাড়াই ও গুদামজাতকরণ : মাষকলাইয়ের গড় ফলন হেক্টর প্রতি ১.৫-২.০ টন হয়ে থাকে। খরিফ-১ মৌসুমে মে মাসের শেষ এবং খরিফ-২ মৌসুমে অক্টোবর মাসের শেষে ফসল সংগ্রহ করা হয়। পরিপক্ব হলে সকালের দিকে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। প্রথম দিকে পরিপক্ব ফল হাত দিয়ে এবং শেষবারের বেলায় কাঁচি দিয়ে গাছগুলো গোড়া থেকে কেটে নিতে হবে। গাছগুলো রোদে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বা গরু দিয়ে মাড়াই করে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। সংগৃহীত বীজ ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে পরিষ্কার ও ঠা-া করে মাটি বা টিনের পাত্রে মুখ বন্ধ করে গুদামজাত করতে হবে।

লেখক : ১ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), উপকেন্দ্র, গোপালগঞ্জ, মোবাইল : ০১৭৭৬৯৬০৭৬৯, ই-মেইল : kamruzzaman_bina2013@yahoo.com