মহাঔষধি সুপার ফুড কাঁচা কাঁঠালের
বহুমুখী ব্যবহার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি
ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী১ জনাব মো. হাফিজুল হক খান২
বাংলাদেশে কাঁঠাল জাতীয় ফল হিসেবে পরিচিত হলেও বিগত বছরগুলোতে অবহেলিত ফল হিসেবেই পরিগণিত হয়েছে। দেশে পাকা কাঁঠাল খাওয়ার প্রবণতা খুব বেশি। শুধুমাত্র প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ প্রযুক্তি প্রয়োগের অভাব ও জনসাধারণের অসচেতনতার কারণে প্রতি বছর অধিক পরিমাণে এ ফলের অপচয় হয়ে থাকে। গবেষণা চলাকালীন গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলাস্থ জৈনা বাজার ও মাওনা এলাকার কৃষক, ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কাঁঠালকে শুধুমাত্র পাকা ফল হিসেবে খাওয়ার কারণে এটি যখন পাঁকতে শুরু করে তখন একসাথে বেশি ভাগ কাঁঠালই পেকে যায়। ভরা মৌসুমে গাছ হতে শতকরা ৩০-৪০ ভাগ কাঁঠাল প্রাকৃতিকভাবে পড়ে যায়, যা খাওয়ার উপযোগী থাকে না অর্থাৎ ব্যাপক কাঁঠাল এক্ষেত্রে নষ্ট হয়। অবস্থা এমন যে, গবাদিপশু বা পাখিও পাকা কাঁঠাল খায় না। কিন্তু কাঁঠালকে কাঁচা হতে ব্যবহার শুরু করা গেলে এবং বাণিজ্যিকীকরণের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এটি হতে পারে পুষ্টি নিরাপত্তার এক বড় নিয়ামক যেখানে পারিবারিক আয় বৃদ্ধিসহ একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও সঠিক পরিচর্যা ও প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য সামগ্রী তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করা হলে এ ফলটিকে সারা বছর খাওয়ার টেবিলেও পেতে সক্ষম। এক সময় কাঁঠালকে গরিবের ফল বলা হতো। এখন জনসাধারণের কিছুটা সচেতনতা ও সাম্প্রতীক বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির উপক্রম বাড়ার কারণে পুষ্টির চাহিদা পূরণে পুষ্টি সমৃদ্ধ ফলমূলের প্রাধান্য বেড়েছে। সেক্ষেত্রে কাঁঠাল একটি সর্বগুণে গুণান্বিত, মহাঔষধি সুপার ফুড হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।
কাঁচা কাঁঠাল রোগ ব্যাধি উপশমে যেমন কার্যকর তেমনি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বহুগুণ বাড়ায়। এটি ক্যান্সারের মোকাবেলায়ও সাহায্য করে। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে খনিজ উপাদান যা আমাদের হাড়ের গঠন ও হাড় শক্তিশালীকরণে এবং রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। আরও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শক্তিশালী এন্টি-অক্সিডেন্ট, যা দেহকে ক্ষতিকর ফ্রি-রেডিকেলস থেকে রক্ষা করে। কাঁঠাল সর্দি-কাশি রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে ও ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস-আলসার, উচ্চরক্তচাপ এবং বার্ধক্য প্রতিরোধে সক্ষম। এতে রয়েছে আয়রন যা দেহের রক্তাল্পতা ও এটি আঁশযুক্ত হওয়ায় কোষ্ঠকাঠিন্যও দূর করে। কাঁচা কাঁঠাল থেকে ৫৩ কিলোক্যালরি এবং কাঁঠালের বীজ থেকে ১৩০ কিলোক্যালরি পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়। কাঁঠালের অন্যতম উপযোগিতা হল ভিটামিন ‘সি’। প্রাকৃতিকভাবে মানবদেহে ভিটামিন ‘সি’ তৈরি হয় না। ভিটামিন ‘সি’ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দাঁতের মাড়িকে শক্তিশালী করে। এতে আরও আছে ভিটামিন ‘বি৬’ যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান কাঁঠাল থেকে পাওয়া সম্ভব। অনেক খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞানী চেহারায় লাবন্য দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য কাঁঠাল খাওয়ার পরামর্শ দেন।
কাঁঠালের সুনির্দিষ্ট জাত না থাকায় এই ফলের বিচিত্রতা অধিক যা বিদেশে রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা। উপমহাদেশের কাঁঠালের জাতের মধ্যে পরিচিত জাতগুলো হচ্ছে গালা, খাজা ও দোরোসা বা রস খাজা। কাঁঠালকে জনপ্রিয় ও যথাযথ ব্যবহার বৃদ্ধি করার প্রয়াসে বিএআরআই-এর উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র এ পর্যন্ত ৬টি জাত (বারি কাঁঠাল-১, বারি কাঁঠাল-২, বারি কাঁঠাল-৩, বারি কাঁঠাল-৪, বারি কাঁঠাল-৫ ও বারি কাঁঠাল-৬ উদ্ভাবন করেছে, যা বছরব্যাপী ভোক্তাদের নিকট সরবরাহ করতে সহায়তা করবে।
কাঁচা কাঁঠাল প্রোটিন সমৃদ্ধ হওয়ায় এটি ভেজিটেবল মিট হিসেবে স্বীকৃত ও মাংসের বিকল্প হিসেবে এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশেই সারা বছর খাওয়া হয়ে থাকে। ভারতের কেরালা, শ্রীলংকা, নেপাল, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশে কাঁঠালের তৈরিকৃত খাদ্যসামগ্রী বছরব্যাপী পাওয়া যায়। কাঁচা কাঁঠালের বহুবিধ খাবারের মধ্যে ভর্তা, সবজি, ফ্রাইড প্রডাক্টচিপ্স বা ঝুড়ি ভাজা, সিংগারা, সমুচা, ভেজিটেবল রোল, কাটলেট, স্যান্ডউইচ, বার্গার উল্লেখযোগ্য। ভারতের কেরালায় কাঁচা কাঁঠাল খুবই জনপ্রিয়। সেখানে ‘ভেজিটাবল মিট’সহ বিভিন্ন উপকরণে ১০০ প্রকার কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে তৈরিকৃত খাবার বিভিন্ন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রাস্তার পাশে দোকানসহ বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায়। এ ছাড়াও কাঁচা কাঁঠাল সংরক্ষণের মাধ্যমে রকমারি খাদ্যসামগ্রী সহজেই তৈরি করা যায় ও বাজারজাত করা সম্ভব। কাঁচা কাঁঠালের ফ্রোজেন খাদ্যসামগ্রী হিসেবে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। প্রবাসীদের নিকট কাঁচা কাঁঠাল ও কাঁঠালের বীচির কদর খুব বেশি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই দক্ষিণ এশিয়ার সুপার-সপগুলোতে ফ্রোজেন অবস্থায় প্রক্রিয়াজাতকৃত কাঁচা কাঁঠালের কোষ, ক্যান প্রডাক্ট ও কাঁঠালের বীচি বিক্রয় করতে দেখা যায়।
পৃথিবীর ৬০টিরও অধিক দেশে প্রায় ৩.৭ মিলিয়ন টন কাঁঠাল উৎপাদিত হচ্ছে। তন্মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২য়। এফএও এর মোতাবেক দেশে উৎপাদিত প্রায় ১.২৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন কাঁঠালের খুব অল্প পরিমাণে বিদেশে রপ্তানি হয় এবং এর ক্রেতা অধিকাংশই প্রবাসী বাংলাদেশী। বাংলাদেশ বর্তমানে ১৫টিরও অধিক দেশে ৩৫ ধরনের বেশি ফল বিদেশে রপ্তানি করছে। অন্যান্য ফলের রপ্তানির তুলনায় কাঁঠাল রপ্তানি খুবই নগণ্য। ডিএই ও হটেক্স ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে ২০২১-২০২২ সালে রপ্তানি ছিল ২০৫০ টন। আমাদের দেশের কাঁঠালের মধ্যে হবিগঞ্জের বড় ও ভালোমানের কাঁঠাল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কাতার, ওমান, বাহরাইন, সৌদি আরব, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। উত্তম কৃষি চর্চা, উন্নত প্যাকেজিং প্রযুক্তি, সঠিক পরিপক্বতা নির্ধারণ, সুনির্দিষ্ট জাত নির্বাচন, প্যাকিং হাউজ সুবিধাসহ যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগ করার মাধ্যমে জাতীয় ফল কাঁঠালকে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে যা কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি যেমন নিশ্চিত করবে তেমনি অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল কাঁঠালের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
দেশের তরুণ, যুবক ও বেকার জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সহজ ঋণ সুবিধাসহ আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা নেয়া হলে প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প দ্রুত এগিয়ে যাবে, কাঁঠালের ন্যায় অন্যান্য কৃষি পণ্যের অপচয় রোধ হবে, কাঁঠাল পণ্যের রপ্তানি বাড়াবে এবং পারিবারিক আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। সর্বোপরি খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানসহ দেশের অর্থনীতিকে বেগমান করবে। কাঁচা কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে যা এসডিজি এর লক্ষ্য পূরণেও সহায়ক হবে।
লেখক : ১খাদ্য প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষক ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, , মোবাইল : ০১৭১২২৭১১৬৩; ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, ই-মেইল : cso.pht@bari.gov.bd, ফোন : ০২-৪৯২৭০১৭৬, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১।