গর্ভবতী গাভী এবং নবজাতক বাছুরের যত্ন
ডা: মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ
গাভীর খামার লাভজনক হওয়া অনেকাংশে নির্ভর করে গাভী থেকে প্রতি ১২-১৪ মাস অন্তর একটি করে সুস্থ-সবল বাছুর পাওয়ার ওপর। আর গর্ভাবস্থায় গাভীর যত্ন ও অন্যান্য পরিচর্যার উপরই স্বাভাবিক প্রসব, ভালো বাছুর, দুগ্ধ উৎপাদন ও পরবর্তীকালে স্বাভাবিক গর্ভধারণ নির্ভর করে। কাজেই গাভী পালনের ক্ষেত্রে গর্ভবতী গাভীর যথাযথ যত্ন নেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে আজকের নবজাতক বাছুরই আগামীদিনের অধিক উৎপাদনক্ষম গাভী বা ষাঁড় হবে। তাই নবজাতক বাছুরেরও যথাযথ যত্ন নেয়া একান্ত প্রয়োজন।
গর্ভবতী গাভীর যত্ন
গাভী সাধারণত ২৭০-২৯০ দিন নিজ গর্ভে বাছুর বহন করে। এই সময়কে গর্ভকাল বলে। গর্ভাবস্থায় গাভীর যতেœ নিম্নলিখিত নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে-
গাভীর গর্ভধারণ কালের হিসাব ও সম্ভাব্য বাচ্চা প্রসবের তারিখ জানা থাকতে হবে।
প্রয়োজনে প্রজননের ৮০-৯০ দিন পর অভিজ্ঞ ভেটেরিনারি চিকিৎসক দ্বারা পরীক্ষা করে গর্ভধারণ নিশ্চিত করতে হবে।
পর্যাপ্ত আলো বাতাসযুক্ত সুপরিসর, সহজেই গাভী নাড়াচড়া করতে পারে এমন ঘরে রাখতে হবে।
গাভীর ঘর দৈনিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে এবং প্রয়োজন হলে জীবাণুনাশক ঔষধ মিশ্রিত পানি দ্বারা ঘর ধুয়ে দিতে হবে।
গর্ভকালের সাত মাস পর্যন্ত গাভীর খাদ্য, পরিচর্যা, দুধ দোহন স্বাভাবিকভাবেই চলবে। তবে ৭ মাসের পরেই গাভীকে অবশ্যই পৃথক করতে হবে। এই সময় খাদ্য, পরিচর্যা ও বাসস্থান গাভীর অবস্থার উপযোগী হতে হবে।
গাভীর শোবার জায়গায় খড় দিয়ে বিছানা তৈরি করে দিতে হবে। বিছানার খড় নোংরা হয়ে গেলে তা পরিবর্তন করে দিতে হবে, তা ছাড়া বিছানার খড় প্রয়োজনে রোদে শুকাতে হবে।
গাভীকে প্রত্যেক দিন পর্যাপ্ত সবুজ ঘাস, সুষম দানাদার খাদ্য এবং বিশুদ্ধ পানি খাওয়াতে হবে।
গাভী যেন পড়ে গিয়ে আঘাত না পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
গর্ভবতী গাভীর উপর অন্য কোনো গরু বা প্রাণি যেন লাফিয়ে উঠতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
গর্ভাবস্থার ৭-৮ মাসে দুধ দোহন বন্ধ করতে হবে। দুধের প্রবাহ বন্ধ না হলে দানাদার খাদ্য কিছুটা কমিয়ে দিতে হবে তবে এমনভাবে কমানো যাবে না যাতে গাভীর স্বাস্থ্য ভেঙে যাওয়ার আশক্সক্ষা থাকে।
গাভীকে কোনোক্রমেই ভয় পাওয়ানো, দ্রুত তাড়ানো বা উত্তেজিত/উত্যক্ত করা চলবে না।
গর্ভবতী গাভী দ্বারা হাল টানা, ভারবহন, ফসল মাড়াই করানো যাবে না।
প্রসবের দুই সপ্তাহ আগে সহজপাচ্য খাদ্য খাওয়াতে হবে। এই সময় গাভীকে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। শীতের সময় পানি কুসুম গরম করে দিতে হবে।
গরমের দিন হলে গাভীকে প্রতিদিন গোসল করাতে হবে।
গর্ভবতী গাভীর প্রসবকালীন যত্ন
আসন্ন প্রসবা গাভীকে সব সময় চোখে চোখে রাখতে হবে। প্রসবের তারিখের ২-৩ দিন আগে থেকে সার্বক্ষণিক নজরে রাখতে হবে।
গাভীর প্রসবের লক্ষণগুলো হলো: যোনিপথ বড় হবে ও ফুলা হয়ে ঝুলে যাবে, আঠালো তরল পদার্থ বের হবে, ঘন ঘন প্রসাব হবে, ওলান বড় হবে এবং বাট দিয়ে দুধজাতীয় তরল পদার্থ বের হবে, পেট ঝুলে পড়বে এবং লেজের দুই পাশের্^ রগের স্থানে গর্তের মতো হবে।
বাচ্চা প্রসবের সময় গাভীকে একটি নিরিবিলি, পরিষ্কার পরিছন্ন, খোলামেলা ও স্বাস্থ্যসম্মত স্থানে রাখতে হবে।
স্বাভাবিক প্রসবের সময় প্রসূত বাচ্চার সামনের দুই পা তার মধ্যে মাথাসহ বেরিয়ে আসে। তারপর সমস্ত শরীর বেরিয়ে বাচ্চা ভূমিষ্ট হয়।
স্বাভাবিক অবস্থায় প্রসবের ২-৮ ঘণ্টার মধ্যেই গর্ভফুল পড়ে যায়। গাভী যাতে গর্ভফুল খেতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
স্বাভাবিক প্রসব না হলে এবং যথাসময়ে গর্ভফুল না পড়লে তাৎক্ষণিক রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রসবের পর গাভীর পেছনের অংশ জীবাণুনাশক মিশ্রিত পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে দিতে হবে।
বাছুরকে ধরে গাভীর বাট চুষাতে হবে এতে করে গাভীর দুধ নিঃসরণে সহায়তা হবে।
নবজাতক বাছুরের যত্ন
নবজাতক বাছুররর যতেœ নিম্নলিখিত নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে-
জন্মের পরপরই বাছুরকে শুকনা খড়কুটো বা ছালার উপর রাখতে হবে। এরপর বাছুরের মুখে এবং শরীরে লেগে থাকা লালা ঝিল্লি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিষ্কার করে দিতে হবে। এতে নবজাতক বাছুরের শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়, অন্যথায় বাছুর শ্বাস আটকে মারাও যেতে পারে। বাছুরের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলে মুখ দিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে।
জন্মের পর মা কর্তৃক বাছুরের শরীর চাটতে দিতে হবে, এতে বাছুরের শরীরের রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক হয় এবং বাছুরকে দ্রুত দাঁড়াতে এবং হাঁটতে সাহায্য করে।
পরিষ্কার, জীবাণুমুক্ত এবং ধারালো ছুড়ি বা ব্লেড জাতীয় কিছু দিয়ে নাভীর নাড়ি কাটতে হবে যেন কোনো সংক্রমণের সম্ভাবনা না থাকে এবং নাভির নাড়ি শক্ত ক্লিপ দিয়ে এমনভাবে আটকে রাখতে হবে যেন মাটিতে ঘষা না লাগে।
নাভি কাটার পর কমপক্ষে ৭% শক্তিশালী টিংচার আয়োডিনের মধ্যে চুবাতে হবে এবং ১২ ঘণ্টা পর পর ৩ দিন পুনরায় একই কাজ করতে হবে। দুর্বল জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করলে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে।
২ ঘণ্টার মধ্যে কমপক্ষে ২ কেজি শালদুধ পান করাতে হবে। একইভাবে প্রতি ১২ ঘণ্টায় কমপক্ষে ২ কেজি করে শালদুধ পান করাতে হবে। এই শালদুধ থেকেই বাছুর প্রয়োজনীয় পুষ্টি এবং রোগ প্রতিরোধের উপাদান পেয়ে থাকে। এই কারণে শাল দুধকে বলা হয় ‘পাসপোর্ট অব লাইফ’।
শীতকাল হলে অবশ্যই দ্রুত গরম কোন কাপড় দিয়ে বাছুরকে পেচিয়ে দিতে হবে যেন বাছুর ঠা-া অনুভব না করে। বাছুরের জন্মের পরে প্রথম ৭২ ঘণ্টা ঝুঁকিপূর্ণ সময় অতিবাহিত করে।
প্রথম ৩ মাস পর্যাপ্ত (কমপক্ষে বাছুরের ওজনের ১০%) দুধপান করতে দিতে হবে, নাহলে বাছুর পরবর্তী জীবনে অপুষ্টিতে ভুগবে এবং বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত হবে।
বাছুরকে প্রয়োজনে মিল্ক রিপ্লেসার ও কিড স্টার্টার খাওয়ানো যেতে পারে।
৩ মাস বয়স পূর্ণ হওয়ার পরে ডাক্তারের সাথে পরামর্শক্রমে সিডিউল অনুযায়ী টিকা প্রয়োগ করতে হবে এবং কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে।
৩ মাস বয়সের পর থেকে কচি ঘাস কুচি করে দিয়ে খাওয়ানোর অভ্যাস করতে হবে। একই সাথে অবশ্যই মায়ের জন্য তৈরি সুষম দানাদার খাবার বাছুরকেও খাওয়ানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : ভেটেরিনারি সার্জন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি খামার সড়ক, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল : ০১৮১১-৯৮৬৬০৫, ইমেইল-smmohibullah@gmail.com