গর্ভাবস্থায় পুষ্টির গুরুত্ব ও করণীয়
মোঃ মাহফুজুর রহমান১ ড. যাকীয়াহ রহমান মনি২
গর্ভাবস্থা মেয়েদের জীবনের একটি বিশেষ সময়। এ অবস্থায় মায়ের শরীর ও শিশুর বিকাশের জন্য সঠিক পুষ্টি গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় মায়ের শরীরে পুষ্টির চাহিদা বাড়ে, তাই শিশুর সঠিক বৃদ্ধি ও বিকাশ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। গর্ভাবস্থায় পুষ্টির গুরুত্ব, প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ, করণীয় এবং কিছু সতর্কতা অবলম্বন সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরি।
গর্ভাবস্থায় পুষ্টির গুরুত্ব
গর্ভাবস্থায় সঠিক পুষ্টি গ্রহণ মায়ের স্বাস্থ্য ও শিশুর বিকাশের জন্য অপরিহার্য। সঠিক পুষ্টি মায়ের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধসহ, শিশুর মস্তিষ্ক ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক বিকাশে সহায়তা করে। এ ছাড়া এটি প্রসবকালীন জটিলতা যেমন : উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং প্রিক্ল্যাম্পসিয়ার (প্রিক্ল্যাম্পসিয়া বলতে গর্ভাবস্থার একটি গুরুতর অবস্থা, যা সাধারণত উচ্চরক্তচাপ, প্রস্রাবের সাথে অতিরিক্ত প্রোটিনের পরিমাণ এবং গুরুতর ফোলা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়, নিয়মিত চেকআপ এর মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ রাখা আবশ্যক, কারণ শিশুর জন্ম এবং প্লাসেন্টা ডেলিভারি ছাড়া প্রিক্ল্যাম্পসিয়ার কোন চিকিৎসা নেই) ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান
ফলিক এসিড : ফলিক এসিড বা ভিটামিন বি-৯ ভ্রƒণের নিউরাল টিউবের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে এটি বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। ফলিক এসিডের অভাব নিউরাল টিউব ডিফেক্টের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, বিধায় ৬০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত ফলিক এসিড দৈনিক খাদ্যমান হতে হবে।
খাদ্য উৎস : কলিজা, গাঢ় সবুজ শাকসবজি, ডিম, বাদাম, বিচিজাতীয় খাবার, কমলা, কলা ইত্যাদি।
আয়রন : গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে রক্তের পরিমাণ বাড়ে, ফলে আয়রনের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। আয়রনের অভাবে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়, যা মায়ের ক্লান্তি, মাথাঘোরা ও শ্বাসকষ্টের মতো বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে, তাই এ সময়ে দৈনিক ২৭ মিলিগ্রাম আয়রন খাওয়া দরকার।
খাদ্য-উৎস : কলিজা, লাল মাংস, মুরগি, মাছ, ডিম, ডাল, পালংশাক, কলা, খেজুর ইত্যাদি।
আয়রনের অভাবে নি¤েœাক্ত উপসর্গ দেখা দিতে পারে : অতিরিক্ত ক্লান্তি ও দুর্বলতা-ছোটখাটো কাজ করলেও ক্লান্ত হয়ে পড়া; শ্বাসকষ্ট হাঁটাহাঁটি বা হালকা পরিশ্রমে শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া; মাথাঘোরা বা মাথাব্যথা- সাধারণত রক্তে অক্সিজেন কম থাকার কারণে হয়, যা আয়রনের সাথে জড়িত; হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া বিশেষ করে ঠোঁট, চোখের নিচে বা নখে; হাত-পা ঠা-া হয়ে যাওয়া; মনোযোগে ঘাটতি বা একাগ্রতা কমে যাওয়া; চুল পড়ে যাওয়া চুল পাতলা হয়ে পড়া; নখ ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া বা সহজে ভেঙে যাওয়া; অস্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস (চরপধ) মাটি, বরফ বা খড় খাওয়ার ইচ্ছা হওয়া।
ক্যালসিয়াম : শিশুর হাড় ও দাঁতের গঠন এবং মায়ের হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় ক্যালসিয়াম অপরিহার্য। ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন (জানুয়ারি-২০২২)-এ প্রকাশিত, একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন প্রায় ১,০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম প্রয়োজন। যদি মা কিশোরী হয় (১৮ বছরের নিচে), তবে প্রতিদিন ১,৩০০ মিলিগ্রাম প্রয়োজন হতে পারে ।
খাদ্য-উৎস : দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য, ডিম, কাঁটাসমেত ছোট মাছ, গাঢ় সবুজ শাকসবজি, বাদাম, সয়া ইত্যাদি।
সতর্কতা : ক্যালসিয়াম ও আয়রন ট্যাবলেট একসাথে খাওয়া ঠিক নয়; এদের মধ্যে ২ ঘণ্টার ব্যবধান রাখা উচিত। ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হবে; ক্যালসিয়াম ও আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার পর পর্যাপ্ত পানি পান করা জরুরি।
ভিটামিন ডি : ভিটামিন ডি ক্যালসিয়ামের শোষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়তা করে। ইউরোপীয় খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ (ঊঋঝঅ) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব মেডিসিন সুপারিশ অনুসারে একজন গর্ভবতী মায়ের ১৫ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ডি প্রয়োজন হয়। যা সূর্যালোক থেকে পূর্ণ করা সম্ভব। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেল্থ-এ প্রকাশিত প্রতিদিন ১৫-২০ মিনিট হাত, পা ও মুখে মধ্যম প্রখর রোদ লাগানো সহায়ক।
খাদ্য উৎস : ডিম, চর্বিযুক্ত মাছ, দুধ, দই ইত্যাদি।
প্রোটিন : শিশুর টিস্যু ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন এবং মায়ের শরীরে কোষের বৃদ্ধি ও মেরামতের জন্য প্রোটিন প্রয়োজন। ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন (ফেব্রুয়ারি-২০২১) এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে গর্ভকালীন প্রথম তিন মাস ০.৮ গ্রাম/কিলোগ্রাম/ওজন এবং পরের ছয় মাস থেকে ১.১ গ্রাম/কিলোগ্রাম/ওজন প্রোটিন গ্রহণ করা দরকার।
খাদ্য উৎস : মুরগি, গরু, মাছ, ডিম, ডাল, বাদাম, দুধ, বিচিজাতীয় খাদ্য ইত্যাদি।
ভিটামিন এ : শিশুর চোখের স্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ত্বকের গঠন রক্ষায় ভিটামিন এ প্রয়োজনীয়। গর্ভাবস্থায় ৭৫০ থেকে ৭৭০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামনি-এ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
খাদ্য উৎস : কলিজা, ডিমের কুসুম, গাঢ় কমলা ও হলুদ রঙের ফল ও শাকসবজি যেমন- গাজর, কুমড়া, আম, মিষ্টি আলু ইত্যাদি।
অন্যান্য খাদ্য : শরীরের টিস্যু ও শারীরিক কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য স্টেরল, ফসফোলিপিডস্ এবং ট্রাইগ্লিসারয়েড তথা লিপিড অপরিহার্য। কোষের মেমব্রেন, হরমোন, চোখ ও মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য লিপিড খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা গর্ভাবস্থা হতে শিশুর প্রথম বেড়ে উঠার জন্য প্রয়োজন। এ ছাড়াও অত্যাবশকীয় ফ্যাটি এসিড যেমন- লিনোলিক এসিড (ওমেগা-৬) এবং লিনোলিনিক এসিড (ওমেগা-৩) গর্ভাবস্থায় শিশুর মস্তিষ্ক, চোখ ও হরমোন সদৃশ্য সাবটেন্স (ঊরপড়ংধহড়রফং) তৈরিতে ভূমিকা পালন করে। এই এসিডগুলোর প্রাপ্যতা সামুুদ্রিক খাবার, সামুদিক মাছ গ্রহণে পূরণ হয়। তবে পরিপূরক খাবার বা ঔষধের মাধ্যমে সাপ্লিম্যান্ট করা যেতে পারে। প্রতিদিন গড়ে ১৩ গ্রাম ওমেগা-৬ এবং ১.৪ গ্রাম ওমেগা-৩ এসিড গ্রহণ করা প্রয়োজন। তবে প্রসূতি মায়ের ওমেগা-৩ এসিড গ্রহণ করা উচিত। কোলিন নামক উপাদানটি ফসফোলিপিডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সেল মেমব্রেন ও ¯œায়ুর কোষ গঠনে গরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন গড়ে ৪৫০ মিলিগ্রাম কোলিন গর্ভাবস্থায় ও প্রসূতি মায়ের প্রয়োজন। প্রতিদিন ডিম ও দুধ গ্রহণে কোলিনের ঘাটতি পূরণ করে। ফিটাসের (গর্ভস্থ শিশু) স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য ফাইবারের গুরুত্ব অপরিসীম এ ছাড়াও কোষ্টকাঠিন্য (যা গর্ভাবস্থায় সাধারণ প¦ার্শপ্রতিক্রিয়া) থেকেও রক্ষা করে। দিনে গড়ে ২৮ গ্রাম ফাইবার গ্রহণ করা উচিত। শাকসবজি ও ডালজাতীয় খাবারে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার রয়েছে, যা গ্রহণে ফাইবারের চাহিদা মেটানো সম্ভব। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নির্ভর করে কার্বো-হাইড্রেটের মাত্রার ওপর। সঠিক মাননিয়ন্ত্রণ করা গর্ভাবস্থায় খুবই জরুরি এবং স্বাভাবিক অবস্থায় দিনে কমপক্ষে ১৭৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করা উচিত।
গর্ভাবস্থায় করণীয়
সুষম খাদ্য গ্রহণ : গর্ভাবস্থায় সুষম খাদ্য গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ফল, শাকসবজি, প্রোটিন, দুধ ও দই, শস্যদানা, বাদাম ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
পর্যাপ্ত পানি পান : গর্ভাবস্থায় শরীরের পানি চাহিদ বাড়ে। আমেরিকান কলেজ অব অবস্টেট্রিশিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্টস (অক্টোবর-২০২০) এ প্রকাশিত, দিনে কমপক্ষে ৮-১২ গ্লাস (যা প্রায় ২-৩ লিটার) পানি পান করা উচিত। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্লান্তি ও অন্যান্য সমস্যা প্রতিরোধে সহায়তা করে।
নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ : হালকা ব্যায়াম যেমন : হাঁটা, যোগব্যায়াম ইত্যাদি গর্ভাবস্থায় শরীরের নমনীয়তা বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
পর্যাপ্ত বিশ্রাাম : গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম গ্রহণ প্রয়োজন। এটি ক্লান্তি কমাতে এবং মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে সহায়তা করে, জার্নাল অব স্লিপহেল্থ (মার্চ-২০২৫)-এ প্রকাশিত একজন গর্ভবতী মায়ের সাধারণত প্রতি রাতে ৭-৯ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন হয়।
নিয়মিত চিকিৎসক পরার্মশ : গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এটি গর্ভাবস্থার সঠিক পর্যবেক্ষণ এবং যেকোনো জটিলতা প্রতিরোধে সহায়তা করে।
গর্ভাবস্থায় বর্জনীয়
অ্যালকোহল ও ধূমপান : গর্ভাবস্থায় অ্যালকোহল ও ধূমপান শিশুর বিকাশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এটি জন্মগত ত্রুটি, কম জন্ম ওজন এবং অন্যান্য জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
কাঁচা বা কম রান্না করা খাবার : কাঁচা বা কম রান্না করা মাংস, মাছ, অর্ধসেদ্ধ ডিম ইত্যাদি ব্যাকটেরেয়িা ও পরজীবী দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে যা গর্ভাবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ, তাই এ জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
ক্যাফেইন : অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ গর্ভাবস্থায় ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এটি গর্ভপাত, কম জন্ম ওজন, অনুপুষ্টি (গরপৎড়হঁঃৎরবহঃ) শোষণে বাধা এবং অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, সকল ক্যাফেইনযুক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে যেমন : কফি, চা, চকোলেট, কিছু এনার্জি ড্রিংক ইত্যাদি ।
প্রক্রিয়াজাত খাবার ও অতিরিক্ত চিনি : অতিরিক্ত চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার গর্ভাবস্থায় এড়িয়ে চলা উচিত। এটি মায়ের ওজন বৃদ্ধি, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
এ ছাড়াও অন্যান্য ফল খাওয়ার আগে ভালো করে ধুয়ে খেতে হবে, কেননা বাজারজাতকৃত বেশির ভাগ ফলই সংরক্ষণের জন্য মোম বা কীটনাশক এবং বিভিন্ন প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়, যা মায়ের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এবং ভ্রƒণের স্বাভাবিক বিকাশে ব্যাহত হতে পারে।
গর্ভাবস্থা একটি বিশেষ সময়, তাই এ সময় সঠিক পুষ্টি গ্রহণ মায়ের ও শিশুর সুস্থতার জন্য অপরির্হায। সুষম খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত পানি পান, নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ গর্ভাবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় মায়ের যত্ন ও সঠিক পুষ্টি শিশুর সুস্থ বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
(তথ্য সূত্র : Institute of Medicine. Food and Nutrition Board. Dietary Reference Intakes: Thiamin, Riboflavin, Niacin, Vitamin B6, Folate, Vitamin B12, Pantothenic Acid, Biotin, and Choline. Washington, DC: National Academy Press; 1998.)
লেখক : ১এক্সিকিউটিভ (পুষ্টিবিদ), রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্ট, আকিজ ফুড এন্ড বেভারেজ, বারোবাড়িয়া, ধামরাই, ঢাকা। ২ প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পুষ্টি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫।