নিরাপদ ফল খাওয়ার
সুযোগ ও সম্ভাবনা
প্রফেসর ড. মো. সদরুল আমিন
বারো মাসে তেরো ফল যে দেশে পাওয়া যায়, আমার মতে বৈচিত্র্যময় ফল খাওয়ার সুযোগ সেদেশে সবচেয়ে বেশি। তবে প্রশ্ন থেকে যায় সে ফলের মান ও পুষ্টির নিরাপত্তা বিষয়ে। বলতে পারি প্রকৃতিকভাবে নিরাপদ ফল খাওয়ার সুযোগ অন্তত গ্রামীণ পরিবেশে বাংলাদেশে অনেক বেশি, যদি না আমরা সন্দেহজনক কথা বলাবলি করে তা বিনষ্ট না করি। আলোাচনা করা যাক কিভাবে তা সম্ভব।
বাংলাদেশে ন্যূনতম ১৩টি প্রধান ফলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: কলা, আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, আনারস, পেঁপে, কমলালেবু, জাম, আতা-শরীফা, তরমুজ, ডালিম-আনার, ড্রাগন ফ্রুট ও আমদানি ফল। এসব ফলের মধ্যে বালাই দমন, ফল পাকানো ও সংরক্ষণের জন্য পেস্টিসাইড, ফরমালডিহাইড, কারবাইড ইত্যাদি গ্রুপের দ্রব্য মিশানো হয় বলে মতামত চালু আছে। বলা যায় আমাদের নিজস্ব এসব ফলের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ফলে সচরাচর মারাত্মক বিষ প্রয়োগ করা হয় না। আমদানি করা ফলের ব্যাপারে দেশে কোয়ারেন্টাইন আইন রয়েছে। দেশে বাগান আকারে উৎপাদিত ফলের সর্বোচ্চ বিষাক্ততা ঝুঁকিতে রয়েছে কলা ও আম, তবে এর মাত্রা ক্ষতিকারকের কোন পর্যায়ে তা নিশ্চিত নয়। এসব বিষয় বিবেচনা করে ফল খাওয়ার ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করে ফল খাওয়ার প্রশান্তি বিনষ্ট করা সমীচীন নয়। কেবল আমদানি করা ফল খাওয়ার ব্যাপারে সাবধান হলে দেশের ফল খেয়ে ফলবিষে আক্রান্ত হয়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা অপ্রাসঙ্গিক হবে। আমার একথা বলার কয়েকটি যুক্তি ও করণীয় এখানে তুলে ধরা হলো-
বাংলাদেশে বার্ষিক কৃষিবিষ আমদানির পরিমাণ ৪০ হাজার টন (২০২২)। ২০০৮ সালে তা ছিল প্রায় ৫০ হাজার টন (তথ্য সূত্র- উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং ডিএই, ২০২৩)। এসব বিষ প্রয়োগ কার্যকর হচ্ছে না বলে এর প্রকৃত¦ ব্যবহার কমছে। অর্থাৎ ফল বিষাক্ততার আশংকাও কমছে।
মোট ৪০ হাজার টন কৃষি বিষের মধ্যে কীটনাশক ১৩ হাজার টন, যার মধ্যে ঝুঁকি পূর্ণ তরল বিষদ্রব্য হচ্ছে মাত্র সাড়ে ৬ হাজার টন, প্রায় ৯০ ভাগ ব্যবহার হয় মাঠ ফসল ও সবজিতে। বলা যায় দেশে গড়ে প্রতি হেক্টর বাগান ফলে ১ লিটার দ্রব্য ব্যবহৃত হয়, যা অনেক দেশের তুলনায় ২৫% এর বেশি নয়। যা অতিবিষের পর্যায়ে পড়ে না। ভারতে হেক্টরে ফলে কৃষিবিষ প্রয়োগের মাত্রা গড়ে ২.৬ কেজি/লিটার, অনেক রপ্তানিকারক দেশে ৫ লিটারের উপরে।
ফল পাকানো বা প্রিজারভেটিভ হিসাবে দেওয়া বিষ অনেকটা হরমোনাল বা ব্যাক্টেরিয়া বা ছত্রাক প্রতিরোধী। আমাদের গ্রামীণ বিপণন পদ্ধতিতে এগুলোর ব্যবহারের উন্মুক্ত সুযোগ কম, যদিও তা বেশি বলে অনেক সময় প্রচার করা হয়।
আমাদের দেশে উষ্ম জলবায়ুতে পেস্টিসাইড বিযোজন হার বেশি।
ফল পাকানোর জৈবরাসায়নিক এমনিতে ফলের ভিতরেই তৈরি হয় যা তেমন বিষাক্ত মাত্রার পর্যায়ে বলে মনে করা হয় না ।
বিষ দেওয়া ফল বর্ণ , স্বাদ, গন্ধ ও শ^াসের গঠনে বুঝা যায় এবং তা এড়িয়ে যাওয়া যায়। বর্ণ নিখুঁত সমরূপ উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয়, মিষ্টি কম, গন্ধ সামান্য ঝাঁঝালো ও গঠন একটু শক্ত হতে পারে।
বর্তমানে সরকারিভাবে আম জাতভেদে সংগ্রহের সময় ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। এতে কেউ অপরিপক্ক আম পেড়ে বিষ দিয়ে পাকানোর সুযোগ পায় না।
দেশে-বিদেশে বাজার থেকে ফল কিনতে হলে এর গায়ে লাগানো স্টিকার দেখে কিনবেন। কোডভেদে এই স্টিকার বিধিবদ্ধ ফলের গুণমান নির্দেশ করে। যেমন: ৪ দিয়ে শুরু ৪ ডিজিট সংখ্যা থাকলে সে ফল হবে কনভেনশনাল পদ্ধতিতে উৎপাদিত, ৮ দিয়ে শুরু ৫ ডিজিট সংখ্যা থাকলে তা জেনেটিকেলী মডিফাইড ফল নির্দেশ করে, ৯ দিয়ে শুরু ৫ ডিজিটের সংখ্যা থাকলে তা ফলটি জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত বলে নির্দেশনা দেয়। তাই ফলের কোড দেখে সেই অনুযায়ী ফল কিনলে বিষাক্ত ফল বা বেশি মূল্য দিয়ে ফল কিনা থেকে রেহাই পাবেন।
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে ভুল ট্যাগ লাগানো কি না তাও দেখতে হবে।
সবশেষে ২টি বিষয়ে সাবধান থাকলে দেশে আমরা তুলনামূলক কম আতংকিত ও মানসিক প্রশান্তি যোগে বারো মাসে দেশীয় অন্তত ১৩টি ফল খেতে পারব।
কৃষি বিভাগের পররামর্শ মতে গ্যাপ বা গুড এগ্রিকালচারেল প্র্যাক্টিসেস পদ্ধতিতে কলা, আমসহ ফল উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও বিপনন।
ফলের বাগানে ওমসানি পদ্ধতিতে আইপিএম ধারণায় ন্যূনতম কৃষি বিষ প্রয়োগ করা।
ওসমানি হল- ও’ হল সঠিক ঔষধ নির্বাচন, স’ হল সঠিক সময়ে প্রয়োগ, মা’ হল সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ, নি” হল সঠিক নিয়মে প্রেসক্রিপশন মতে প্রয়োগ।
আশা করি দুশ্চিন্তা না করে সন্দেহাতীত মনে ফল খাওয়া যাবে। তবে দেশে গ্রামীণ বাজার থেকে স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত ফল কিনলে ফল বিষাক্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
লেখক : প্রফেসর (সাবেক), হাজী দানেশ মোহাম্মদ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, দিনাজপুর। মোবাইল : ০১৭২৭৫৭৫৭২৪