Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন ফলের রোগ ও দমন ব্যবস্থাপনা

বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন ফলের রোগ ও দমন ব্যবস্থাপনা
ড. সৈয়দ মোহাম্মদ মহসিন
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ যেখানে কৃষি পণ্য উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো ফল। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালীন ফল যেমন আম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, জাম, লেবু ইত্যাদি দেশের জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দেশে এখন অনেক রকম দেশি ফল উৎপাদিত হচ্ছে। বসতবাড়ির আঙ্গিনা ও তার আশেপাশের বাগানেও ফলগাছ লাগানোর পরিমাণ বেড়ে গেছে। কিন্তু ফল উৎপাদনে বিভিন্ন রোগবালাই বড় বাঁধা। এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা, কৃষকের সচেতনতা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
আমের রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার 
গ্রীষ্মে বাংলাদেশে আবাদি ফলের মধ্যে আম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল। এনথ্রাকনোজ ও পাউডারি মিলডিউ আমের প্রধান দুটি ছত্রাকজনিত রোগ। এনথ্রাকনোজ রোগটি Colletotrichum gloeosporioides ছত্রাক দিয়ে হয়ে থাকে, ফলে আমের পাতা ও ফলের পৃষ্ঠে ছোট আকারের বাদামি থেকে কালচে দাগ দেখা দেয়, যা পরে ছোপার আকার ধারণ করে। পেকে যাওয়া ফলের ওপর কালো দাগ পড়ে এবং হালকা গর্তের আকার ধারণ করে (ছবি-ক১ ও ক২)। রোগ প্রতিরোধের জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে মরা ও আক্রান্ত শাখা-পাতা ছেঁটে ফেলতে হবে। প্রচুর আর্দ্রতা এড়িয়ে চলতে হবে। লক্ষণ দেখা গেলে কার্বেনডাজিম অথবা কপার অক্সিক্লোরাইড ছত্রাকনাশক স্প্রে করে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। Oidium mangiferae হল আরেকটি ছত্রাক যা আমের পাউডারি মিলডিউ রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। আক্রান্ত অংশে সাদাধূসর ধুলোর মতো ছত্রাকের বৃদ্ধি হয়। বিশেষ করে ফুলের গাঁদায় সাদা ছত্রাকের ফোটা দেখা দেয় এবং ফল ঝরে পড়ে যায়। নতুন পাতা মোচড়ানো বা বিকৃত হয়। গাছের বৃদ্ধির হার কমে যায় (ছবি-খ)। সালফার ছত্রাকনাশক স্প্রে করে পাউডারি মিলডিউ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
লিচুর রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার 
এনথ্রাকনোজ লিচুর একটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ যা Colletotrichum  প্রজাতির ছত্রাক দিয়ে হয়ে থাকে। আক্রান্ত ফল, পাতা ও ফুলে গোলাকার বাদামি দাগ পড়ে। ফলের ত্বকে কালচে গর্ত ও রেখাজাত ক্ষত পড়ে। পরিপক্ব ফলের ত্বক কালচে হয়ে দাগ ছাপ পড়ে। কারবেনডাজিম অথবা কপার অক্সিক্লোরাইড ছত্রাকনাশক স্প্রে করে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় ।
কাঁঠালের রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার 
বাংলাদেশে কাঁঠালের প্রধান রোগগুলো হলো পাতার দাগ রোগ, গামিরোগ এবং ফল পচন রোগ। পাতার দাগ বা স্পট রোগ সাধারণত ছত্রাকের মাধ্যমে হয়ে থাকে। আক্রান্ত পাতা ও ডালপালায় গোলাকার বাদামি দাগ পড়ে, যা পরে ছোপাকৃতি ছত্রাকনাশী দাগে পরিণত হয়। আক্রান্ত পাতা খাঁকি হয়ে নষ্ট হয়। রোগ প্রতিরোধে আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। কার্বেনডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে দেওয়া যেতে পারে। গামিরোগ বা গ্যামোসিস কাঁঠালের আরেকটি ছত্রাকজনিত রোগ যা Phomopsis artocarpi  দ্বারা হয়ে থাকে। ছত্রাকটির আক্রমণের ফলে কা-ের গায়ে ছোট ফাটল দেখা দেয়। ফাটল থেকে বাদামি গাম (গলনের দ্রবণ) বেরিয়ে পড়ে। গাছের কা- দুর্বল হয়ে যায়, কাঠ তন্তু খারাপ হয় এবং ফলন কমে যায় (ছবি-ঙ)। রোগ দমনের জন্য আক্রান্ত অংশে ছুরি দিয়ে ফাটল বড় করে পরিষ্কার করতে হয়। তারপর বোর্দো পেস্ট বা কপার ছত্রাকনাশক পেস্ট দিয়ে সেই স্থানে লেপ দিতে হয়। এটি গাম নির্গমনের রোগকে নিয়ন্ত্রণ করে। কাঁঠালের আরেকটি প্রধান রোগ হলো ফল পচন যা Rhizopus stolonifer ছত্রাকের কারণে হয়। পচা ফলের অংশে নরম পানি-মাখানো ফোস্কা তৈরি হয় এবং ছত্রাকের ফোঁটা দেখা যায়। এ রোগটি দমনের জন্য ম্যানকোজেব ছত্রাকনাশক সবচেয়ে কার্যকর।
লেবু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার 
বাংলাদেশে লেবুর প্রধান রোগ হলো সাইট্রাস ক্যান্কার। এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ যা ঢধহঃযড়সড়হধং পরঃৎর নামক ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে হয়ে থাকে। আক্রান্ত পাতায়, ডালে ও ফলের ত্বকে গাঢ় বাদামি দাগ পড়ে। দাগের চারপাশে পানিতে ভেজা অংশের মতো হলুদ রিং থাকে। পুরানো দাগগুলো বাঁধাকপি-মতো কর্কের মতো ফেটে যায়। আক্রান্ত ফল গোলাকার দাগ, উঁচু হয়ে ওভাল চিহ্নে পরিণত হয় (ছবি- ছ)। রোগ দমনের জন্য আক্রান্ত গাছের ডাল-পাতা যতটা সম্ভব পরিষ্কার করতে হবে। কপার ছত্রাকনাশক স্প্রে করলে সাইট্রাস ক্যানকার দমনে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
তরমুজ রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার 
তরমুজের একটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ হলো ঢলে পড়া যার প্রধান কারণ হলো Fusarium oxysporum  নামক ছত্রাক। ছত্রাকের আক্রমণের ফলে গাছের একাংশে পানি-প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ক্রমে শুকিয়ে যায়। কা- ভেতরকার অংশে গাঢ় বাদামি রং ধারণ করে এবং গাছের একাংশ হঠাৎ ঢলে পড়ে (ছবি-জ)। মাটিতে জৈব বালাইনাশক ট্রাইকোডার্মা ব্যবহারের মাধ্যমে এ রোগ দমন করা যায় এবং কার্বেনডাজিম ছত্রাকনাশক স্প্রে করেও রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। গামি স্টেম ব্লাইট হলো তরমুজের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ যা Stagonosporopsis cucurbitacearum ছত্রাকের সংক্রমনে হয়ে থাকে। আক্রান্ত পাতায় কোণাকৃতি বা গোলাকার গাঢ় বাদামি দাগ পড়ে, মাঝখানে একটু হালকা থাকে। পাতার ধার বা মাঝখানে দাগের ছোঁয়া দেখা যায়। ধীরে ধীরে দাগ একত্র হয়ে সারাটা পাতা শুকিয়ে যায়। কা-ের ওপর পানির মতো ময়লা দাগ (গামি) পড়ে থাকে। ফলের ডগায় কালচে দাগ পড়ে। প্রতিরোধের জন্য আক্রান্ত পাতা ও ফল সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। বোর্দো মিশ্রণ বা প্রোপামোকার্ব, ক্যাপ্টান, কার্বেনডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক দিয়ে নিয়মিত স্প্রে করতে হবে। খেতের আশপাশের আগাছা নিয়ন্ত্রণ ও কচি রোগা গাছ ধ্বংস করে ক্ষেত পরিষ্কার রাখতে হবে।
উল্লেখ্য, সঠিক রোগ ব্যবস্থাপনা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ফল উৎপাদনে যেমন গুণগত মান বজায় থাকবে, তেমনি কৃষক লাভবান হবেন ও দেশের অর্থনীতিও আরও সমৃদ্ধ হবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। মোবাইলঃ ০১৬৭১০৩৫২৫১, ই-মেইল : mohsinsau.ac@gmail.com