বাংলাদেশে প্রথম মাছের কৌটাজাতকরণ প্রযুক্তি
মোঃ মাসুদ রানা
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য সেক্টর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। আমাদের প্রাণিজ আমিষের ৬০% আসে মাছ থেকে, দেশে মোট মাছের উৎপাদন ৪৯.১৫ লক্ষ মেট্রিক টন। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৪ এর তথ্যমতে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ২.৪৩% এবং কৃষিজ জিডিপির ২২.১৪% আসে মৎস্য সেক্টর থেকে (ইঊজ, ২০২৩)। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১২% প্রত্যেক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য সেক্টরের সাথে যুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। বাংলাদেশ বিশ্বে মাছ উৎপাদনে ৫ম, স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে ২য়, ইলিশ উৎপাদনে ১ম, তেলাপিয়া মাছ উৎপাদনে ৪র্থ এবং এশিয়ার মধ্যে ৩য়। আমরা এখন আমাদের দেশের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি মাছ উৎপাদন করছি, গত কয়েক বছরে মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬ গুণ যা সত্যিই ঈর্ষণীয়। দেশে উৎপাদিত মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ এখন সময়ের দাবি। উৎপাদিত অতিরিক্ত মাছ যদি সঠিক ব্যবহার করতে না পারি তাহলে অধিক উৎপাদন খামারিদের জন্য কোন সুফল বার্তা আনবে না।
বিশ্বে মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণের অনেকগুলো পদ্ধতি প্রচলিত আছে তার মধ্যে মাছের শুঁটকীকরণ, মাছ লবণাক্তকরণ, মাছ ধূমায়িতকরণ, মাছ গাঁজনীকরণ, মাছ কৌটাজাতকরণ উল্লেখযোগ্য। মাছ সংরক্ষণের পদ্ধতিগুলো প্রজাতিভেদে এবং মাছের শরীরের পুষ্টি উপাদানের উপর ভিক্তি করে ভিন্নতর হয়ে থাকে, একেক পদ্ধতি একেক প্রজাতির মাছের জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রচলিত মাছ সংরক্ষণের পদ্ধতি হলো শুঁটকীরণ ও লবণাক্তকরণ। বিশ্বে মাছ দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য বহুল প্রচলিত পদ্ধতি হলো মাছ কৌটাজাতকরণ, এ পদ্ধতিতে মাছকে কৌটার মধ্যে মাছ ও বিভিন্ন উপাদান দিয়ে কৌটার মুখ বন্ধ করে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময় ধরে স্টেরিলাইজেশন করে সমস্ত অনুজীব ধ্বংস করা হয় ফলে, কৌটার ভেতর কোন ক্ষতিকর অনুজীব না থাকায় মাছ দীর্ঘদিন ভাল থাকে। আমাদের দেশে কৌটাজাতকরণ মৎস্য পণ্যের ব্যবহার সত্তরের দশক থেকে চলমান থাকলেও এখনও অবধি দেশে মাছ কৌটাজাতকরণের জন্য দেশীয় মাছগুলো কৌটায় সংরক্ষণ করার জন্য কোন প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মাছ কৌটাজাতকরণের জন্য বিভিন্ন মাছের জন্য বিভিন্ন রকম রেসিপি দরকার হয় অন্যদিকে ভোক্তার চাহিদাকেও গুরুত্ব দিতে হয়।
দেশ এখন মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ন এবং আমরা এখন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি মাছ উৎপাদন করছি, অন্যদিকে বাংলাদেশের সীমানাভুক্ত সমুদ্রে রয়েছে বিপুল পরিমাণ মাছ যেগুলোর অধিকাংশই দীর্ঘদিন সংরক্ষণের তেমন কোন পদ্ধতি নাই। উৎপাদিত মাছ ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকার মূল্য সংযোজিত মৎস্য পণ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ এবং ২ বছর গবেষণা করে দেশে প্রথমবারের মতো মাছ কৌটাজাতকরণের প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়। বাংলাদেশ যেহেতু ইলিশ মাছ উৎপাদনে প্রথম এবং বিশ্বে এ মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে সেহেতু প্রাথমিকভাবে জাতীয় মাছ ইলিশ কৌটাজাতকরণের জন্য নানাবিধ রেসিপি ও কৌশল উদ্ভাবন করা করেন। বিভিন্ন রেসিপির মধ্যে সরিষা ইলিশ, টমেটো ইলিশ অন্যতম, তবে রেসিপিগুলোর মধ্যে সরিষা ইলিশ অধিক জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীতে তিনি দেশীয় প্রজাতির নানান মাছ যেগুলো বাজারে সহজলভ্য যেমন তেলাপিয়া, পাংগাস, টুনা, কই, মলা, সাগরের ইটা মাছ দিয়ে কৌটাজাতকরণ পন্য উৎপাদন করেন এবং পণ্যগুলোর পুষ্টি মান কত দিন ভাল রাখা যায় তার উপর গবেষণা করেন। গবেষণায় দেখা যায় সামুদ্রিক মাছ দিয়ে উদ্ভাবিত কৌটাজাতকরণ মৎস্য পণ্য ক্যানড ইলিশ, ক্যানড টুনাসহ অনান্য পণ্যে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩, ওমেগা-৬ সহ বিভিন্ন রকম অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড বিদ্যমান যেগুলো মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী বিশেষ করে হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় জড়িত রোগীদের জন্য। এছাড়াও সামুদ্রিক মাছ প্রক্রিয়াজাত করে কৌটায় সংরক্ষণ করে দীর্ঘদিন রেখে দেখা যায় মাছের বিদ্যমান অ্যামাইনো এসিড অপরিবর্তিত রয়েছে। মাছ কৌটাজাতকরণ করে তা কক্ষ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করে স্বাদ ও পুষ্টমান অপরিবর্তিত রেখে এক বছরের অধিক সময় ধরে সংরক্ষণ করা যায় বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে, দেশের মানুষ দিন দিন কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ছে। উন্নত বিশ্বে যেমন মানুষ সবকিছুই হাতের নাগালে রেডি টু কুক বা রেডি টু ইট অবস্থায় পেয়ে থাকেন ঠিক সে অবস্থায় আমাদের যেতে খুব বেশি দেরি নাই, আমাদের দেশেও বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বসবাসরত অধিকাংশ পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করে থাকেন অর্থাৎ পরিবারে রান্নাঘরে সময় ব্যয় করার মতো সময় দিন দিন ক্ষীণ হচ্ছে। এমতাবস্থায় রেডি টু কুক বা রেডি টু ইট পণ্যই হতে পারে কর্মব্যস্ত সময়ের সহজ সমাধান। ইলিশ বা অনান্য মাছ কৌটাজাতকরনের মাধ্যমে যেমন আমিষ, ফ্যাটি এসিড, অ্যামাইনো এসিডসহ অনান্য পুষ্টিউপাদান ভোক্তা সহজেই হাতের নাগালে পাবেন তেমনি এ প্রযুক্তি পারিবারিক জীবনের কর্মব্যস্ততাকে অনেকাংশে সহজতর করে দিবে। ইলিশ মাছ আমাদের জাতীয় মাছ যার ৮০-৯০% শতাংশ উৎপাদিত হয় আমাদের দেশে কিন্তু এ মোছের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। ইলিশ মাছ কৌটাজাতকরণ করলে বিদেশে রপ্তানি করার ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে অন্যদিকে নানাবিধ মাছ আছে যেগুলোর বাজারমূল্য তুলনামূলকভাবে অনেক কম সেগুলো কৌটাজাতকরণের মাধ্যমে তুলনামূলক কম মূল্যের মাছগুলোকে মূল্যসংযোজিত মৎস্য পণ্য হিসেবে দেশে-বিদেশে বাজারজাতকরণ সহজতর হবে।
পরিশেষে বলা যায়, উদ্ভাবিত মাছের কৌটাজাতকরণের প্রযুক্তি দেশে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ মাছকে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে মূল্য সংযোজন করে বাজারজাতকরণের মাধ্যমে একদিকে মানুষ যেমন সহজেই মাছের পুষ্টি পাবে অন্যদিকে দেশে উৎপাদিত মাছের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হবে। প্রযুক্তিটি উদোক্তাদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে ফলে মৎস্য সেক্টরে নতুন নতুন উদোক্তা সৃষ্টি ও জনবলের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে যা দেশের বেকারত্ব দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। প্রযুক্তিটি সম্প্রসারণ বাস্তবায়ন করে উৎপাদিত কৌটাজাতকরণ মৎস্য পণ্য দেশের অভ্যন্তরে বাজারজাতকরণ করে তুলনামূলক কম মূল্যের মাছগুলোর দাম বৃদ্ধি করে খামারিদের মুনাফা বাড়ানো সম্ভব অন্যদিকে উৎপাদিত কৌটাজাতকরণ মৎস্য পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদশিক মুদ্রা অর্জন করে মৎস্য সেক্টর তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৪৫-৬২৬১৫৩