Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বারি উদ্ভাবিত যন্ত্রের সাহায্যে নারিকেল সংগ্রহ

বারি উদ্ভাবিত যন্ত্রের সাহায্যে নারিকেল সংগ্রহ
মৃত্যুঞ্জয় রায়
নারিকেল বাগান করা যতটা সহজ, প্রতিটি গাছ থেকে নারিকেল পাড়া ততটা সহজ না। ভালো গাছি ছাড়া যে কেউ ইচ্ছে করলে গাছ বেয়ে উঠে নারিকেল পাড়তে পারে না। আজকাল নারিকেল গাছে ওঠার মতো লোকই তো মেলে না। সনাতন নিয়মে কোনো দক্ষ গাছি এ কাজটি করে থাকেন এবং বিনিময়ে বাগান মালিক তাকে চুক্তি অনুসারে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক নারিকেল দেন বা টাকা দেন। বর্তমানে গাছপ্রতি দুটো নারিকেল দিলেও তাতে দুশো টাকা চলে যায়। কারো দশটা গাছ থাকলে সেসব গাছের নারিকেল পাড়াতে খরচ হয় প্রায় ২ হাজার টাকা। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। অথচ মাত্র ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা দিয়ে একটা নারিকেল পাড়া যন্ত্র কিনে আপনি দীর্ঘদিন ধরে সে যন্ত্রের সাহায্যে বহু গাছ থেকে নারিকেল পাড়াতে পারেন। সেক্ষেত্রে একজন সাধারণ শ্রমিকের মজুরি দিয়েই অনেক নারিকেল পাড়ানো যায়। এতে গাছপ্রতি নারিকেল পাড়ানোর খরচ কমে যায় ও সনাতন পদ্ধতির চেয়ে কম সময়ে বেশি নারিকেল পাড়ানো যায়। তাছাড়া সনাতন পদ্ধতিতে যে লোকটি গাছে উঠে নারিকেল পাড়েন, তার জন্যও কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ। এতগুলো গাছে উঠতে গিয়ে তার গায়ের চামড়া ছিলে যায়, বিশেষ করে হাত, পা ও বুকের চামড়া যায়। এমনকি গাছ থেকে পড়ে মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে। এসব ঝুঁকি ও নারিকেল পাড়ার খরচ কমাতে এখন যন্ত্রের সাহায্যে নারিকেল পাড়ার ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ যন্ত্র ব্যবহার করে যে কেউ নারিকেল গাছ থেকে নারিকেল পাড়তে পারেন। এমনকি মেয়েরাও চাইলে এ যন্ত্র ব্যবহার করে নারিকেল গাছে উঠতে পারেন।
নারিকেল গাছে উঠা যন্ত্রের মাধ্যমে একজন শ্রমিক খুব সহজে ও নিরাপদে নারিকেল গাছে উঠে নারিকেল পাড়া বা গাছ পরিষ্কার করতে পারেন। বাংলাদেশে যে নারিকেল গাছ আছে সেগুলোর অধিকাংশই লম্বা জাতের। গাছ ৪০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। তাই সেসব গাছে উঠে গাছ পরিষ্কার করা বা নারিকেল পাড়ার জন্য লোক সহজে পাওয়া যায় না। ফলে গাছের ব্যবস্থাপনা করতে না পারার কারণে নারিকেলের ফলন কমে যাচ্ছে। অথচ ‘কোকোনাট ট্রি ক্লাইম্বার’ নামের একটি সাধারণ যন্ত্র দ্বারা যে কেউ তরতর করে গাছে উঠে গাছ ঝোড়া বা পরিষ্কার করতে ও নারিকেল পাড়তে পারেন। এটি খুবই সহজ ও কার্যকর একটি প্রযুক্তি। স্থানীয় কোনো ওয়ার্কশপে যন্ত্রটি তৈরি করা সম্ভব।
বর্তমানে বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের শতকরা ৮০ ভাগ নারিকেল দেশের দক্ষিণাঞ্চলে উৎপাদিত হয়। তাই সে অঞ্চলে এ যন্ত্রের ব্যবহার সম্প্রসারিত হতে পারে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এ কাজের জন্য একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে যার নাম ‘বারি নারিকেল গাছে উঠা যন্ত্র’। বিভিন্ন দেশে বেশ কিছু নারিকেল পাড়া যন্ত্র উদ্ভাবিত হয়েছে। নারিকেল উৎপাদন এলাকায় যদি এক দল যুবককে এসব যন্ত্র ব্যবহারের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে নারিকেল পাড়ায় দক্ষ করা যায় তাহলে তাদের সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এতে সে এলাকা থেকে নিয়মিতভাবে নারিকেল পাড়া ও বাজারে তা সরবরাহ করা সম্ভব হবে। যন্ত্রটির দ্বারা একটি ৪০ ফুট লম্বা গাছে উঠতে ২ মিনিটের বেশি লাগে না। দক্ষতা থাকলে একজন শ্রমিক এ যন্ত্র ব্যবহার করে দিনে যদি ২০টি গাছের নারিকেলও পাড়তে পারেন তবে গাছপ্রতি ৫০ টাকা হারে মজুরি নিলে দিনে তার আয় হতে পারে ১ হাজার টাকা, মাসে ৩০ হাজার টাকা। সাধারণত একটি নারিকেল গাছ থেকে ৪৫ থেকে ৬০ দিন পরপর নারিকেল পাড়া যায়। কিন্তু লোকের অভাবে অনেক গাছ থেকেই বছরে মাত্র ১ থেকে ২ বার নারিকেল পাড়া হয়। দক্ষিণাঞ্চলে অধিকাংশ গাছ শরতকালে ঝোড়া (পরিষ্কার করা) ও নারিকেল পাড়া হয়। বছরে যেখানে ৫ থেকে ৬ বার নারিকেল সংগ্রহ করা যায়, সেখানে মাত্র ১ বার নারিকেল সংগ্রহ করার কারণে নারিকেল গাছের উৎপাদনশীলতা যেমন কমে যায় তেমনি ফলন কম পাওয়া যায়। তাছাড়া গাছ থেকে নারিকেল ঝরে পড়ার কারণে অপচয় বাড়ে। এরূপ সনাতন নিয়মে প্রধানত ঝুনা নারিকেল বেশি পাওয়া গেলেও ডাব পাড়ার জন্য বছরে কয়েকবার গাছ থেকে তা পাড়তে হয়। বছরে ৪ থেকে ৫ বার ডাব সংগ্রহ করলে গাছে মোট নারিকেলের সংখ্যাও বাড়ে। তবে মাসে মাসে বা ঘন ঘন ডাব পাড়া উচিত না। এতে আবার ফলনের ব্যাঘাত ঘটে।
ইদানীং ডাবের দাম ও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কেউ কেউ ঘন ঘন ডাব পেড়ে বিক্রি করছেন। এতে নারিকেলে উৎপাদন বিশেষ করে ঝুনা নারিকেলের উৎপাদন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এতে ঝুনা নারিকেলের ওপর নির্ভরশীল অন্তত পাঁচ ধরনের শিল্পে ধস নেমে এসেছে। নারিকেল তেল তৈরির জন্য এখন কারখানাগুলো পর্যাপ্ত ঝুনা নারিকেলের জোগান পাচ্ছে না। একইভাবে ধুঁকছে নারিকেলের ওপর নির্ভরশীল মশার কয়েল তৈরি, কোডোস্ট তৈরি, নারিকেলের ছোবড়া বা আঁশ তৈরি ও নারিকেলের খোল থেকে বিভিন্ন কারুপণ্য তৈরির শিল্পগুলো। এসব শিল্পের ওপর আবার নির্ভর করে আরও অনেক শিল্প। যেমন নারিকেলের আঁশ থেকে তৈরি হয় ম্যাট্রেস বা জাজিম, কাতা বা রশি, সোফা ইত্যাদি। ঝুনা নারিকেলের সরবরাহ কমে গেলে আঁশ কমবে, আঁশ কমলে এসব বেডিং শিল্প বা কারখানাও থাকবে না। সেসব কারখানার শ্রমিকরাও কাজ হারাবে। কাজেই নারিকেল চাষ ও শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে একটি সমন্বিত বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। এক্ষেত্রে নারিকেলের ওপর এ দেশে গবেষণাও হয়েছে অপ্রতুল। জাত উন্নয়নসহ এর ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তিগুলোর আধুনিকায়ন প্রয়োজন। এখন নারিকেলের খোসা ছাড়ানো, কোকোডাস্ট ও কোকেপিট তৈরি, কোপরা বা শাঁস তোলা, তেল নিষ্কাশন ইত্যাদি কাজ আর আগের মতো সনাতন পদ্ধতিতে হাতে করা হয় না, উদ্ভাবিত হয়েছে নানা রকমের যন্ত্র। সেসব যন্ত্রের আধুনিকায়ন ও ব্যবহারেও জোর দেয়া উচিত।
নারিকেল পাড়া যন্ত্রের বৈশিষ্ট্য
 যন্ত্রটি ব্যবহার করে সহজে গাছে উঠা যায়;
 স্থানীয় কারখানায় এমএস রড ও প্লেট দিয়ে সহজে যন্ত্রটি তৈরি করা যায়;
 যন্ত্রটির ব্যবহার সহজ ও নিরাপদ;
 যন্ত্রটি চালনার জন্য একজন লোকের প্রয়োজন হয়;
 এটি সম্পূর্ণরূপে মনুষ্যচালিত, শক্তিচালিত নয়;
 যন্ত্রটি সহজে বহনযোগ্য;
 যন্ত্রটির ওজন ৮ থেকে ৯ কেজি;
 আকার : ১১৬ঢ৩৪ঢ১৩ সেন্টিমিটার;
 যন্ত্রটির বাজার মূল্য ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা।
যন্ত্রের ব্যবহার পদ্ধতি
দুই রকমের নারিকেল সংগ্রহ যন্ত্র পাওয়া যাচ্ছে। একটি ২ রডের, আর একটি ৩ রডের। যেটিই হোক না কেন যন্ত্রটির দুটি ধাতব লুপ, একটি রাবার বেল্ট, রশি ও একটি সংযোগ ক্ল্যাম্প থাকে। এমএস-লোহার তৈরি এ যন্ত্রটি সেসব নারিকেল গাছের নারিকেল পাড়ার জন্য ব্যবহার করা যায় যেগুলোর ব্যাসার্ধ ১৫ থেকে ৩২ সেন্টিমিটার। এই যন্ত্রটির ব্যবহার খুবই সহজ। এ যন্ত্র চালাতে কোনো মেশিন, তেল বা ব্যাটারি লাগে না। মানুষ সাধারণত যেভাবে গাছে ওঠে বা হাঁটে সেভাবে গাছে এ যন্ত্রের সাহায্যে হাঁটার মতো করে ওঠা যায়। এ যন্ত্রটি মূলত এক ধরনের রশি ও রডের সমম্বয়ে চালিত হয়। নারিকেল গাছের সাথে রশি ঢিলা করে প্রথমে আটকে দিতে হয়। দুটি অংশের রশি একটু উপরে ও নিচে গাছের সাথে আটকানো বা বাঁধা হয়। তারপর রডের নিচের প্রান্তে দুটি অংশে দুই পা রাখা হয়। পা যখন তোলা হয় তখন রশিটি ঢিলা হয় ও পা রাখলে বা চাপ পড়লে রশিটি গাছের সাথে আটকে যায়। ঢিলা হলে হাত দিয়ে উপরের অংশ উপরে তুলে তুলে উপরে উঠতে হয়। এভাবে ডান পা নামালে বাম পা উঠবে, বাম পা নামালে ডান পা উঠবে। এভাবে গাছ বেয়ে উঠে যেতে হবে। গাছের মাথায় বা উপরে উঠে নারিকেলের কাঁদি কাটার পর তা রশিতে বেঁধে নিচে নামিয়ে দিতে হবে। হাত দিয়ে ধরার হাতল ও কোমরে বেল্ট বাঁধার ব্যবস্থা থাকায় গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেই। এ যন্ত্র ব্যবহারে একটি লম্বা গাছের মাথায় উঠতে মাত্র ২ থেকে ৩ মিনিট সময় লাগে।
 
লেখক : পরিবেশ ও সামাজিক সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ, পার্টনার প্রকল্প, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৮২০৯১০৭, ই-মেইল : kbdmrityun@gmail.com