রফতানিমুখী বাণিজ্যিক কৃষি
উন্নয়ন এবং চ্যালেঞ্জ
মোহাম্মদ আরিফুর রহমান
বাংলাদেশ খোরপোষ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরের (ট্রানজিশন) একটি সময় পার করছে। বাণিজ্যিকভাবে ফল, সবজি ও মসলা চাষাবাদ হচ্ছে। এসব পণ্যগুলো গুণগত মানসম্পন্ন উৎপাদন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বাজার ব্যবস্থা আধুনিকায়নসহ মধ্যস্থতা ভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে হবে। পণ্য পরিবহন পর্যায়ে নৈরাজ্য সহনীয় পর্যায় আনতে না পারলে এর প্রভাব ভোক্তার ওপর পড়াটা স্বাভাবিক। আমাদের দেশের সম্ভাবনাময় খাতের মধ্যে কৃষিজ পণ্য রফতানির খাতটি অন্যতম। প্রায় ১০৪ রকম কৃষিজ পণ্য রফতানি হয়ে থাকে। কৃষিজ পণ্য রফতানিতে বেশ কিছু বাধা রয়েছে। উৎপাদন পর্যায় থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত বেশ কিছু বাধা আছে। উৎপাদন পর্যায় উত্তম কৃষি চর্চা প্রয়োগ, গ্রেডিং, প্যাকেজিংসহ কোয়ারেন্টাইন প্রক্রিয়া সহজীকরণে নজর দিতে হবে।
বাংলাদেশ এলডিসি গেজেট প্রাপ্তির দ্বার প্রান্তে থাকায় কৃষি পণ্য রফতানিতে খাত ভেদে সরকার দশ শতাংশ পর্যন্ত নগদ সহায়তা কমিয়েছে। মূলত এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে। উন্নত দেশের সাথে প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। উন্নয়ন ভাবনার ব্যক্তিবর্গ বলছে রফতানি প্রতিযোগিতা বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি নগদ সহায়তা কোন সমাধান নয়।
রফতানি খাতে সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে এ খাতে জড়িত ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা যেমন চিন্তায় পড়ছে তেমনি উত্তরণের পথও খুঁজছে। বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ কৃষি রপ্তানিমুখী হিসবে অগ্রগামী। গতবছরে কৃষি পণ্য রফতানির পরিমাণ ১.১৬ বিলিয়ন ডলার ছিল। আশঙ্কার বিষয় হলো গত ১০ বছরে ইউরোপে ফল ও সবজি রফতানি কমেছে মোট রফতানির প্রায় ১৩% (২০১৪ সালে ৫৪.৮% এবং ২০২৩ সালে ৩২%), অপর দিকে মধ্যপ্রাচ্যে রফতানি অংশ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৮% (২০১৪ সালে ৩০.৭% এবং ২০২৩ সালে ৪৯%)। এটি নির্দেশ করে রফতানি পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক বাজার ধরে রাখার জন্য পণ্যের মান বৃদ্ধির বিকল্প নাই।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের জনগণের খাদ্যাভাস এবং কৃষিজ পণ্য উৎপাদন চিত্র প্রায় কাছাকাছি। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উপমহাদেশের জনগণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উপমহাদেশের জনণের খাদ্যাভাস খুব একটা পরিবর্তন করতে চায় না। প্রবাসে বসেও তারা দেশী খাবার খেতে পছন্দ করেন। দেশী খাবার খুজেন, সংগ্রহ করেন। প্রবাসীদের মতোই স্থানীয় বিদেশিরাও উপমহাদেশের খাদ্যের প্রতি একটু একটু দুর্বল হচ্ছে। বিশেষ করে উপমহাদেশের আম, লেবুসহ বেশ কিছু প্রচলিত/অপ্রচলিত সবজি ও ফলের প্রতি।
বাংলাদেশ থেকে শতাধিক ফল ও সবজি বিদেশে রফতানি হয়ে থাকে। আম, জারালেবু, সাতকড়া, জাম্বুরা, পান, জলপাই, কাঠাঁল, কঁচু, আমলকি, লুকলুকি, শালুক, শুকনো বরইসহ অনেক অপ্রচলিত এবং প্রচলিত ১০৭ ধরনের কৃষজ পণ্য। রফতানিকারকরা সারা দেশ ঘুরে ঘুরে এসব পণ্য সংগ্রহ করেন। তাদের কিছু সোর্স এবং বিশ্বস্ত কৃষক এসব পণ্যের জোগান দেন। অনেক রফতানিকারকের কিছু চুক্তিবদ্ধ কৃষক রয়েছে। চুক্তিবদ্ধ কৃষকরা চাহিদা অনুসারে পণ্য উৎপাদন করে সরবরাহ করে থাকেন। নরসিংদী, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁর বেশ কিছু কৃষক রফতানির সাথে সরাসরি জড়িত। বর্তমানে কৃষি শ্রমিকের অপর্যাপ্ততা, কৃষি উৎপাদন উপকরণের ব্যয় বৃদ্ধি, পরিবহন খরচসহ ভোগীদের অতিরিক্ত চাহিদার কারণে মানসম্মত কৃষি পণ্যের দর বৃদ্ধির বিষয়টা অস্বীকার করার সুযোগ নাই। সরকারি দপ্তরসমূহ প্রতিনিয়ত এই ব্যয় হ্রাসের চেষ্টা অব্যাহত রাখছে। যখনই রফতানির বিষয়টি সামনে আসে তখন পণ্যের নিরাপত্তা, বাছাইকরণ, প্যাকেজিংসহ গুণগতমান বজায় রাখার কারণে এসব পণ্যের দাম অন্যান্য পণ্যের চেয়ে স্বভাবতই বেশি হয়। তদুপরি রফতানির ক্ষেত্রে পণ্য উড়োজাহাজীকরণ ব্যয়, উন্নত প্যাকেজিং এবং গুণগতমান বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান ব্যয় প্রতিবেশি দেশের তুলনায় কিছুটা বেশি। পণ্যের উৎপাদন পর্যায়ে কৃষককে সহায়তা করা গেলে বিশেষত যেসকল কৃষক ডেডিকেটেডলি রফতানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করবে সেসব কৃষকদের উৎপাদন পর্যায় উপকরণ সহায়তাসহ অর্থাৎ বিশেষ মূল্যে উৎপাদন উপকরণ সরবরাহ করা গেলে মানসম্মত পণ্য প্রতিযোগিতা মূল্যে উৎপাদনে সক্ষম হতে পারতো। এক্ষেত্রে বিদেশি ক্রয়কারীগণও এগিয়ে আসতে পারে। বিশেষ করে নিরাপদ পণ্য উৎপাদনের স্বার্থে জৈব বালাইনাশক, ফ্রুট ব্যাগিং, মালচিং সিট এবং আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি উপকরণ সহায়তা হিসেবে কৃষকদের সরবরাহ করা গেলে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমে আসবে।
জলবায়ু পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, লবণাক্ততা, সেচের অভাব ইত্যাদি নানা প্রতিকূলতার পরও বাংলাদেশের কৃষকরা ফসল উৎপাদনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছে গুণগত মানের পণ্য উৎপাদনের দিকে। পাশাপাশি বাংলাদেশে গবেষণা মাঠের উৎপাদন এবং কৃষকের মাঠের উৎপাদনের পার্থক্যটা কমিয়ে আনা প্রয়োজন। গবেষকদের খুঁজে বের করতে হবে উন্নত বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে স্বল্প জায়গায় অধিক উৎপাদন করে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করা। প্রতিযোগিতা বিশ্বে তাল মিলিয়ে কৃষি পণ্য রফতানি বাণিজ্যের সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার একমাত্র অবলম্বন হলো মানসম্মত পণ্য উৎপাদন, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস, পণ্য সংগ্রহোত্তর উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার সেইসাথে নতুন বাজার অনুসন্ধান অব্যাহত রাখা গেলে রফতানির উলম্ব ধারাটা বজার রাখা সম্ভব হবে।
কৃষি সেক্টরে মোট জনশক্তির প্রায় ৪৫ শতাংশ জড়িত। বিশাল জনগোষ্ঠীর পেশাটি লাভজনক রূপে গড়ে তুলতে হবে। বাণিজ্যিক কৃষিতে নজর দিতে হবে। কৃষির উৎপাদন ব্যবস্থার নজরদারির পাশাপাশি বাজার কাঠামো, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, ভ্যালু এডেশন এবং প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থায় আধুনিকায়নে গুরুত্বারোপ করা দরকার। কৃষি উৎপাদনের সাথে কৃষি ব্যবসা শব্দটি প্রয়োগের সময় এসেছে। শিক্ষিত তরুণদের জোনিংভিত্তিক কৃষি ব্যবসায় সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। ফসল সাব সেক্টরের পাশাপাশি মৎস্য এবং প্রাণিজ সম্পদ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় শিক্ষিত তরুণদের আধুনিক চিন্তাকে সম্পৃক্ত করা গেলে কৃষি ব্যবসায় বিপ্লব ঘটা সময়ের ব্যাপার।
বাংলাদেশের আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থান, কৃষ্টি এবং আর্থসামাজিক অবস্থা কৃষি উন্নয়নে সহায়ক বিধায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের সোপান হিসেবে কৃষি ভাবনাই প্রাধান্য পাওয়া সমীচীন।
লেখক : মোহাম্মদ আরিফুর রহমান, প্রকল্প পরিচালক, রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, ডিএই। মোবাইল : ০১৮১৯৪৫৭৫৭৪,