হলুদ
তরমুজ চাষে সম্ভাবনার হাতছানি
কৃষিবিদ তাহসীন তাবাসসুম
আসলে তরমুজের কথা চিন্তা করলেই আমাদের মাথায় আসে লাল রঙ এর সুস্বাদু একটি ফলের কথা। তবে আমাদের দেশে বর্তমানে তরমুজের আর একটি আকর্ষণীয় রঙ সকলের নজর কেড়েছে, আর সেটি হচ্ছে হলুদ রঙ এর তরমুজ। অল্প কয়েক বছর ধরে এই হলুদ তরমুজ চাষে কৃষকদের মাঝে বেশ আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। সাধারণত যেসব জায়গায় এই তরমুজ চাষ শুরু হয়েছে সেখানকার কৃষকগণের সাথে কথা বলে জানা যায়, তেমন কোনো পরিশ্রম না থাকার কারণে খুব সহজেই যেহেতু এই তরমুজ চাষ করা যাচ্ছে তাই এই তরমুজ সকলের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। উচ্চফলনশীল এসব হলুদ তরমুজের কিছু জাত হচ্ছে- ব্ল্যাকবেবি, মধুমালা, তৃপ্তি, লালতীর ল্যানফাই ইত্যাদি। এই জাতগুলো চাষ করতে বীজের পরিমাণও লাগে মাত্র এক গ্রাম করে। অর্থাৎ অত্যন্ত লাভজনক এই হলুদ জাতের তরমুজসমূহ স্বল্প বীজে, কম সময়ে ও কম খরচে যেমন চাষ করা যাচ্ছে তেমনি বেশি লাভের কারণেও জাতগুলো বর্তমানে বিভিন্ন জেলায় বেশ সারা তুলেছে।
চাষাবাদ পদ্ধতি : সাধারণত আমাদের দেশে তরমুজ চাষের ক্ষেত্রে মাদায় সরাসরি বীজ বপনের পদ্ধতি প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে পলিথিন ব্যাগে চারা তৈরি করে মাদায় রোপণ করাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এতে বীজের পরিমাণ যেমন কম লাগে তেমনি জমিতে ফাঁকা জায়গা থাকারও কোনো সম্ভাবনা থাকে না। সাধারণত প্রতি মাদায় ৩-৪টি বীজ বপন করা হয়। বপনের ১০ দিন আগে মাদা তৈরি করে মাদার মাটিতে সার মেশাতে হবে। মাদা স্থাপনের ক্ষেত্রে দুই মিটার দূরে দূরে সারি করে প্রতি সারিতে দুই মিটার অন্তর মাদা তৈরি করতে হবে। মাদার সাইজ হবে ২০দ্ধ২০দ্ধ২০ ইঞ্চি। বীজ গজানোর পর প্রতি মাদায় দুটি করে চারা রেখে বাকি চারাগুলো তুলে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে বীজ বপনের চেয়ে চারা রোপণ করাই উত্তম। চারা তৈরি করার জন্য ৪দ্ধ৫ ইঞ্চি মাপের পলিথিনের ব্যাগে ৫০:৫০ অনুপাতে বালু ও পচা গোবর সার ভর্তি করে, প্রতি ব্যাগে একটি করে বীজ বপন করতে হবে। চারা রোপণের সময় খেয়াল রাখতে হবে চারার বয়স যেন ৩০-৩৫ দিন হয় এবং ৫-৬ পাতা বিশিষ্ট এসব চারা মাদায় রোপণ করতে হবে।
সার ব্যবস্থাপনা : সাধারণত হলুদ তরমুজ চাষের ক্ষেত্রে প্রতি শতকে গোবর/ কম্পোস্ট সার ১০-১৫ টন, ইউরিয়া সার ২৮০ কেজি, টিএসপি ১০০ কেজি এবং এমওপি সার ৩২০ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির সময় মাদা প্রতি ৮-১০ দিন আগে পচা গোবর/জৈবসার ১০ কেজি, খৈল ৫০০ গ্রাম, টিএসপি ২৫০ গ্রাম ও ছাই ৪ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হবে। চারা গাছ ২০-৩০ সেমি. লম্বা হলে ৩-৪ সপ্তাহ পরপর ২ কিস্তিতে প্রতি মাদায় ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ২০০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
ফসল পরিপক্ব সময় ও লক্ষণ : আসলে জাত ও আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে হলুদ তরমুজ ফল পাকতে ৮০-১০০ দিন সময় লাগে। যদিও ফলের পাকা অবস্থা নির্ণয় করা কিছুটা কঠিন। তবে কিছু লক্ষণের ভিত্তিতে ফসল পাকা অনুমান করা যায়, যেমন :
* ফলের বোঁটার সঙ্গে যে আকাশী রঙ থাকে তা শুকিয়ে বাদামি রঙের হয়।
* খোসার উপরের সূক্ষ লোমগুলো মরে পরে গিয়ে তরমুজের খোসা চকচকে হয়।
* তরমুজের যে অংশটি মাটির উপর লেগে থাকে, তা সবুজ থেকে উজ্জ্বল হলুদ রঙের হয়ে থাকে।
* শাঁস হলুদাভ হয়।
* আর আঙুল দিয়ে টোকা দিলে যদি ড্যাব ড্যাব শব্দ হয় তবে বুঝতে হবে যে ফল পরিপক্ব হয়েছে। সাধারণত অপরিপক্ব ফলের শব্দ হয় অনেকটা ধাতবীয়।
হলুদ তরমুজের ফলন : হলুদ তরমুজের প্রতিটি ফলের ওজন সাধারণত ৩-৪ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং জাতভেদে একর প্রতি ৩০-৩৫ টন পর্যন্ত পর্যন্ত ফলন হয়ে থাকে। উচ্চফলনশীল এই হলুদ তরমুজ সারা বছর চাষ করা যায় বিধায় এই তরমুজ চাষে কৃষকগণের মাঝে নতুন করে আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ : নীলফামারী সদর উপজেলার ইটাখোলা এলাকার কৃষক সামছুল ইসলাম ধান, ভুট্টা, আলুসহ অন্য সবজি চাষ করেন। এসব ফসল উৎপাদনের পর উপার্জিত অর্থ দিয়েই চলে তার সংসার। তবে কয়েক বছর ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ভালো ফলন পাননি সামছুল। কিছু ভেবে না পেয়ে কৃষি অফিসের সহযোগিতায় পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করেন হলুদ বর্ণের নতুন জাতের তরমুজ। এ পরীক্ষামূলক চাষেই সামছুলের জমিতে এসেছে ভালো ফলন। কৃষক সামছুল ইসলামের মতে- তিনি ১৫ শতাংশ জমিতে এই তরমুজ চাষ করেন এবং বেশ ভালো ফলন পান। এতে তার ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে কিন্তু তিনি প্রায় ১ লাখ টাকার মতো হলুদ তরমুজ বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, গ্রীষ্মকালীন এই হলুদ তরমুজ বিভিন্ন অঞ্চলের মাটিতে ব্যাপকভাবে চাষ করা সম্ভব। আর এতে বেশি লাভবানও হবেন কৃষকগণ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আরো জানায়, ব্ল্যাক বেবি ও তৃপ্তি নামে হলুদ তরমুজের জাত দুটি অনেক অঞ্চলের মাটির জন্যই অনুকূল। ফলে এ তরমুজ চাষে উচ্চফলনের সম্ভাবনাও রয়েছে। এসব হলুদ তরমুজের প্রতিটির ওজন ২-৩ কেজি পর্যন্ত হয়। আর ৮০-১০০ দিনেই হারভেস্ট করা যায় নতুন জাতের এ তরমুজ। এছাড়া এটি চাষ করে ১ বিঘা জমিতে প্রায় ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি সম্ভব। ফলে কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
ভালো দাম পেলে এবং উত্তম বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে হলুদ জাতের এই তরমুজ চাষে দিন দিন আরো আগ্রহ বাড়বে এবং সেইসাথে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন হবে বলে আশাবাদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
(সূত্র : ড. এ কে এম কামরুজ্জামান, তরমুজের আধুনিক উৎপাদন কলাকৌশল, কৃষিকথা ফাল্গুন ১৪২৯ এবং উপজেলা কৃষি অফিস, নীলফামারী সদর)
লেখক : প্রকাশনা কর্মকর্তা, প্রশিক্ষণ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭২০২৫২৭৬৫,