Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

লাভজনক প্রযুক্তি বস্তায় আদা চাষ

লাভজনক প্রযুক্তি বস্তায় আদা চাষ
কৃষিবিদ তনয় দত্ত
আদা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মসলা ফসল। দেশের চাহিদার তুলনায় আদার উৎপাদন বেশ কম। এজন্য প্রতি বছর বিদেশ থেকে আদা আমদানি করতে হয়। দেশের জনসংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে, এ কারণে চাষ অযোগ্য পতিত জমি, বসতবাড়ির আশপাশে অব্যবহৃত স্থান, লবণাক্ত এলাকা, নতুন ফলবাগান, শহর-গ্রামে বাড়ির ছাদে বস্তায় আদা চাষ করে উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। মাটিতে আদা চাষ করলে আদার রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে থাকে, সে ক্ষেত্রে বস্তায় আদা চাষে এ সম্ভাবনা একেবারেই কম দেখা যায়। বাংলাদেশে ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে ২.৮৮ লাখ মেট্রিক টন আদা উৎপাদিত হয়। যা দেশের চাহিদার ৪.৮১ লাখ মেট্রিক টন এর তুলনায় খুবই কম। আদার গড় ফলন ১১.২৮ টন/হেক্টর। এই ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীগণ বারি আদা-১, বারি আদা-২ ও বারি আদা-৩ নামে তিনটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছেন। যার ফলন ৩০-৩৯ টন/হেক্টর। 
বস্তায় আদা চাষের সুবিধা 
 এ পদ্ধতিতে আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না, যে কোন পরিত্যক্ত জায়গা, বসতবাড়ির চারিদিকে ফাঁকা জায়গা, লবণাক্ত এলাকা বা বাড়ির ছাদে সহজেই চাষ করা যায়।
 একই জায়গায় বারে বারে চাষ করা যায়।
 এ পদ্ধতিতে অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় আনা সম্ভব হয়।
 বস্তায় আদা চাষে উৎপাদন খরচ অনেক কম, প্রতি বস্তায় ২৫-৩০ টাকা খরচ করে বস্তা প্রতি এক থেকে দুই কেজি আদা উৎপাদন করা যায়, যার বাজার মূল্য প্রতিকেজি ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা।
 এ পদ্ধতিতে আদা চাষ করলে রোগবালাইয়ের আক্রমণ অনেক কম হয়। যদি রোগ দেখা দেয় সাথে সাথে রোগাক্রান্ত গাছ বস্তুাসহ সরিয়ে ফেলা যায়, ফলে অন্যান্য গাছে রোগ সংক্রমিত হতে পারে না।
 বস্তায় আদা চাষ করলে নিড়ানিসহ অন্যান্য পরিচর্যার তেমন প্রয়োজন হয় না, ফলে উৎপাদন খরচ অনেক কম হয়।
মাটি ও আবহাওয়া : জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও উঁচু জায়গা বস্তায় আদা চাষের জন্য ভালো।
বস্তায় আদা চাষে মাটি তৈরির পদ্ধতি : সিমেন্ট বা অন্য বস্তায় আদা চাষের জন্য নিম্নলিখিত উপাদানগুলো একত্রে মিশ্রণ করে আদা কন্দ রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে একত্রে গাদা বা ঢিবি করে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে, যাতে বাতাস প্রবেশ না করে। প্রতি বস্তায় মাটি, জৈবসার ও রাসায়নিক সার প্রয়োগের পরিমাণ সারণি দ্রষ্টব্য।
বস্তায় মাটি মিশ্রণ তৈরির সময় মাটি, গোবর, ভার্মিকম্পোস্ট, ছাই, টিএসপি, জিংক, বোরন, কার্বফুরান সব একত্রে মিশিয়ে দিতে হবে। অর্ধেক এমওপি মিশ্রণ তৈরির সময় দিতে হবে। অর্ধেক ইউরিয়া ও ডিএপি আদা রোপণের ৫০ দিন পর এবং বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি সমানভাবে দুই কিস্তিতে রোপণের যথাক্রমে ৮০ ও ১১০ দিন পর বস্তায় প্রয়োগ করতে হবে। অর্ধেক ডিএপি সার আদা রোপণের ৬৫ দিন পর এবং বাকি অর্ধেক ডিএপি আদা রোপণের ১৩০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে।
বস্তায় মিশ্রণ ভরাট : বস্তায় আদা রোপণের পূর্বে প্রতি বস্তায় আগে তৈরিকৃত মিশ্রণ এমনভাবে ভরতে হবে যাতে বস্তার উপরের দিকে ১-২ ইঞ্চি ফাঁকা থাকে।
আদা রোপণের সময় : এপ্রিল- মে (চৈত্র-বৈশাখ) মাসে আদা রোপণ করতে হয়। তবে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে আদা রোপণের উপযুক্ত সময়।
আদা অঙ্কুরোদগমের পদ্ধতি
বস্তা সাজানো বা স্থাপন পদ্ধতি : একটি বালি ভর্তি টবে ৪০ থেকে ৫০ গ্রাম ওজনের অঙ্কুরিত আদা বালুর ৩-৪ ইঞ্চি নিচে পুঁতে দিতে হয়। ২০-২৫ দিন পর ওই আদা থেকে গাছ বের হবে। তখন আদার চারা সাবধানে তুলে বস্তার মুখে মাটির ৪ ইঞ্চি নিচে বসিয়ে দিতে হয়। প্রতি বস্তায় ২ থেকে ৩টি অঙ্কুরিত বীজ প্রয়োগ করা যায়। দিনের অধিকাংশ সময় রোদ পায় এমন স্থানে বস্তাটি রাখতে হবে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আদা গাছ বাড়তে থাকবে। ৩ মিটার দৈর্ঘ্য ও সুবিধামত প্রস্থের বেড তৈরি করতে হবে। দুই বেডের মাঝে ৬০ সেমি.  সেচ নিষ্কাশনে নালার ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রতি বেডে ১ মিটার দূরত্বে সারি করতে হবে। প্রতি সারিতে ৬-৮ ইঞ্চি পরপর পাশাপাশি ২টি বস্তা স্থাপন করতে হবে।
বীজ শোধন : বস্তায় আদা রোপণের আগে ২ গ্রাম অটোস্টিন/প্রভেক্স প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে এক কেজি আদা বীজ এক ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখতে হবে। এরপর ভেজা আদা পানি থেকে তুলে ছায়ায় রেখে শুকিয়ে বস্তায় রোপণ করতে হবে।
আন্ত:পরিচর্যা : বস্তায় আদা চাষ করলে তেমন একটা আগাছার উপদ্রব হয় না। যদি প্রথম পর্যায়ে কিছু আগাছা দেখা যায় তাহলে নিড়ানি দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে হয়। পরবর্তীতে সার উপরিপ্রয়োগের সময় মাটি আলগা করে গাছের গোড়া থেকে দূরে সার প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয়।
সেচ প্রয়োগ : বৃষ্টি না হলে প্রথম দিকে ঝাঁঝরি দিয়ে হালকাভাবে সেচ দিতে হবে, তবে বৃষ্টি স্বাভাবিক মাত্রায় হলে সেচের তেমন প্রয়োজন হয় না।
আদার রোগবালাই  
কন্দ পচা :  আদা ফসলে সাধারণত কন্দ পচা প্রধান রোগ। আবহাওয়া ও অধিক আপেক্ষিক আর্দ্রতায় (৮৭-৯০%) জীবাণু সহজেই কন্দকে আক্রমণ করে। এ ছাড়াও অত্যাধিক বৃষ্টিপাতের ফলে রোগের প্রকোপ খুব বেশি হয়। গাছের নিচের দিকের পাতার প্রান্ত ভাগে প্রথমে হলুদাভ দেখায় এবং পর্যায়ক্রমে তা পাতার কিনারা ও পত্রফলকের দিকে বিস্তার লাভ করে। গাছের পাতা হলুদ হয়ে গাছ ঝিমিয়ে পড়ে। পচনের ফলে কন্দ নরম হয়ে আভ্যন্তরীণ টিস্যু সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যায়। আক্রান্ত রাইজোম থেকে এক ধরনের গন্ধ বের হয়।
দমন পদ্ধতি
য় বস্তায় আদা চাষের জন্য পানি জমে না এমন উচু জায়গা নির্বাচন করতে হয়।
য় বীজ আদার জন্য সুস্থ ও নিরোগ গাছ নির্বাচন করতে হয়।
য় ২ গ্রাম অটোস্টিন/প্রভেক্স প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে বীজ কন্দ শোধন করে রোপণ করতে হবে।
আদা গজানোর ৪০ দিন পর থেকে মেটালক্সিল+ মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন- রিডোমিল গোল্ড) ২ গ্রাম/লিটার হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
পোকা মাকড় : বাড়ন্ত গাছে পাতা খেকো পোকা অনেক সময় আদা গাছের পাতার ব্যাপক ক্ষতি করে। ফলে গাছের সালোক সংশ্লেষণ হ্রাস পায়। এতে ফলন অনেকাংশে কমে যায়।
দমন : এ পোকা দমনের জন্য ১০-১৫ দিন পর পর ২-৩ বার বিকাল বেলায় শতকরা ০.৫ ভাগ হারে মার্শাল বা ১ মিলি ডার্সবান বা সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের ওষুধ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ফসল সংগ্রহ : সাধারণত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে বস্তা থেকে আদা তোলা হয়। আদা পরিপক্বতা লাভ করলে গাছের পাতা ক্রমশ হলুদ হয়ে কা- শুকাতে শুরু করে। এ সময় আদা তুলে মাটি ঝেড়ে ও শিকড় পরিষ্কার করে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়।
ফলন : সাধারণত প্রতি বস্তায় জাত ভেদে ১ থেকে ৩ কেজি পর্যন্ত আদা পাওয়া যায়।
সংরক্ষণ : বীজ আদা ছায়াযুক্ত জায়গায় মাটির নিচে গর্ত বা পিট তৈরি করে সংরক্ষণ করা হয়। গর্তের নিচে ১ ইঞ্চি পরিমাণে শুকনা বালু দিয়ে তার উপর বীজ আদা রেখে মাটি দ্বারা ঢেকে দিতে হয়। এতে বীজ আদা শুকিয়ে ওজন কমার সম্ভাবনা থাকে না। (তথ্য সূত্র : মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, শিবগঞ্জ, বগুড়া)। 
 
লেখক : কৃষিবিদ তন্ময় দত্ত, উপজেলা কৃষি অফিসার, বাগেরহাট সদর, বাগেরহাট। মোবাইল : ০১৭১৭-৮১০২৫১;