কোরাল (ভেটকি) মাছ চাষ : মৎস্য সেক্টরের নতুন সম্ভাবনা
মোঃ মাসুদ রানা
বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৪৮ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে যার মধ্যে ৩২ লাখ মেট্রিক টন চাষের, ১৩ লাখ মেট্রিক টন উন্মুক্ত জলাশয় থেকে এবং বাকিটা সমুদ্র থেকে আহরণ করা হয়েছে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়, মিঠাপানির মাছের পাশাপাশি কিছু সামুদ্রিক মাছও মিঠাপানিতে চাষ হচ্ছে, এদের মধ্যে কোরাল বা ভেটকি মাছ অন্যতম।
কোরাল মাছ চাষে সফলতা: কোরাল মাছ ভেটকি বা সি বাস নামে বহুল পরিচিত কিন্তু উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক জায়গায় এটি পাতাড়ি মাছ নামেও পরিচিত। কোরাল মাছের বৈজ্ঞানিক নাম খধঃবং পধষপধৎরভবৎ, এটি লম্বাটে, চাপা ও রুপালি বর্ণের একটি দামি মাছ। অস্ট্রেলিয়া ও পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এটি বারামু-ি নামে পরিচিত। কোরাল মাছে ওমেগা-৩, ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিডসহ উন্নতমানের আমিষ থাকায় মানব শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও হার্টের রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কোরাল মাছে ভিটামিন এ, ডি, বি, প্রচুর খনিজ পদার্থ, ক্যালসিয়াম, জিংক, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম থাকায় শরীরের গঠন ও বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। কোরাল মাছ দীর্ঘ মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে তাই এ মাছকে মোহনা থেকে মুরু করে উপকূলীয় এলাকার পুকুরে বা ঘেরে চাষ করা হয়, কিন্তু বর্তমানে কোরাল মাছ স্বাদু পানিতে চাষ করা হচ্ছে। কোরাল মাছ যে কোন পানিতে নিজেকে দ্রুতসময়ের মধ্যে খাপখাইয়ে নিতে পারে এবং অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায়। যদি কোরাল মাছের পুষ্টি চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করা যায় তাহলে কার্পজাতীয় মাছের থেকে এ মাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। কোরাল মাছ সাধারণত এক থেকে দেড় বছরে ৩-৪ কেজি পর্যন্ত হয়। স্বাদে অতুলনীয় এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর হওয়ায় রুপালি রংয়ের মাছেটির দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা আছে।
কোরাল মাছ চাষে অন্যতম বাধা ছিল পোনার প্রাপ্তি, কোরাল মাছের পোনার সরবরাহ না থাকায় চাষিরা প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত আঙুলে পোনার উপর নির্ভর করে থাকত কিন্তু বর্তমানে কোরাল মাছের কৃত্রিম প্রজনন সফল করেছেন গ্রীন হাউজ মেরিকালচার নামক একটি প্রতিষ্ঠান যারা বাণিজ্যিকভাবে কোরাল মাছের পোনা উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ করছে। কোরাল মাছের পোনা উৎপাদনের মাধ্যমে এ মাছের চাষ সম্প্রসারণে আর কোন বাধা রইল না এবং কোরাল মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
পুকুর নির্বাচন ও পুকুর প্রস্তুতি : কোরাল বা ভেটকি মাছ চাষের জন্য উপকূলীয় স্বাদু, মিঠাপানির জলাশয় বা আধা লবণাক্ত পুকুর যার আয়তন ৮০-১০০ শতাংশ হলে ভাল হয় তবে চাষযোগ্য যেকোন পুকুরেই কোরাল মাছ চাষ করা সম্ভব। চাষকালীন সময়ে রোগবালাইয়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে শুরুতেই ভালভাবে পুকুর প্রস্তুত করে নিতে হবে। চাষের শুরুতে পুকুর ভালভাবে শুকিয়ে শতাংশপ্রতি ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
পোনা সংগ্রহ, নার্সারি ব্যবস্থাপনা : কোরাল বা ভেটকি মাছের পোনা প্রকৃতি থেকেও পাওয়া যায় কিন্তু সেটি খুবই নগণ্য হওয়ার কারণে কৃত্রিম প্রজনন করে যে সকল হ্যাচারি পোনা উৎপাদন করে তারাই একমাত্র উৎস। কক্সবাজার সদর উপজেলায় অবস্থিত গ্রীন হাউজ মেরিকালচার হতে পারে কোরাল মাছের পোনা প্রাপ্তির অন্যতম উৎস। কোরাল মাছ হ্যাচারি থেকে সংগ্রহ করে কমপক্ষে ২-৩ মাস নার্সিং করে চাষের পুকুরে মজুদ করতে হবে তাহলে পোনার টিকে থাকার হার বাড়বে এবং এই সময়ের মধ্যে পোনা চাষকৃত পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপখাইয়ে নিবে। কোরাল মাছ স্বপ্রজাতিভুক শ্রেণীর একটি মাছ হওয়ায় নিজেরা নিজেদের খায় তাই পোনা অবস্থায় অধিক সর্তকতা অবলম্বন না করলে তুলনামূলক বড় আকারের মাছগুলো ছোট মাছগুলোকে খেয়ে ফেলতে পারে। কোরাল মাছ নার্সিং করার বড় কৌশল হল নির্দিষ্ট সময় পর পর মাছের সাইজ অনুযায়ী গ্রেডিং করা এবং তাদের পরিমিত খাবার সরবরাহ করা। কোরাল মাছের নার্সিং করার সময় যে কোন ধরনের রোগের প্রতিরোধ করতে পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ ঠিক রাখতে হবে। কোরাল মাছের নার্সারি পুকুরের গভীরতা ৩.৫-৪ ফুট এবং আয়তন ১৫-২৫ শতাংশ হলে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। কোরাল মাছের নার্সিং করার জন্য পুকুর ভালভাবে শুকিয়ে তলায় পরিমাণমত ব্লিচিং পাউডার বা অন্য কোন জীবাণুনাশক ব্যবহার করে জীবাণুমুক্ত করে পানি প্রবেশ করাতে হয়। পানির পিএইচ নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য শতাংশপ্রতি ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। পানির গুণগুতমান ঠিক থাকলে খাদ্য পরীক্ষণ করে শতাংশপ্রতি ২০০-২৫০টি পোনা যার আকার ১-২ সেমি. তা মজুদ করা যায়। কোরাল মাছ চাষে সফলতার জন্য আরেকটি টার্গেট পয়েন্ট হলো পোনা অবস্থায় মাছের খাবার অভ্যস্তকরণ, কেননা পোনা অবস্থায় যে খাবারে অভ্যস্ত হবে পরবর্তীতে সে খাবার দিয়েই তাকে লালন করা যাবে। কোরাল একটি মাংসভোজী ও উচ্চ আমিষ সমৃদ্ধ মাছ তাই নার্সিংকালীন সময়ে ৫০-৬০% আমিষ সমৃদ্ধ খাবার দিতে পারলে কাক্সিক্ষত ফলাফল পাওযা সম্ভব। শুরুতে পোনার খাদ্য হিসেবে অন্য পুকুর হতে সংগৃহীত জুয়োপ্লাংটন, ছোট চিংড়ি বা তেলাপিয়ার রেণু পোনা সরবরাহ করা যেতে পারে, পরবর্তীতে দেহ ওজনের ১০-১২% হারে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। ৭-৮ সপ্তাহ শেষে এ খাবারের পরিমাণ দৈহিক ওজনের ৩-৪% হারে কমিয়ে এনে ৮০-৯০ দিন পর্যন্ত চলবে, পোনার আকার ১০-১২ সেমি. হলে তা মজুদযোগ্য পোনা বলে বিবেচিত হবে।
পোনা মজুদকরণ ও খাবার ব্যবস্থাপনা : কোরাল মাছের উৎপাদন বেশি পেতে হলে নার্সারির সময় ৪-৬ মাস অথবা পোনার ওজন ৯০-১০০ গ্রাম না হওয়া পর্যন্ত মজুদ করা যাবে না। উন্নত ব্যবস্থাপনায় কোরাল মাছ একরপ্রতি ১৮০০-২০০০টি মজুদ করলে ভাল ফলাফল পাওয়া যাবে। কোরাল মাছের পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের জোগান হিসেবে জুয়োপ্লাংটন চাষ, তেলাপিয়ার রেণু ছাড়া বা অন্য ছোট মাছ ছাড়া যেতে পারে সেক্ষেত্রে তার সম্পূরক খাবারের উপর চাপ কমবে। চাষকালীন শুরুতে আঙুলে পোনাকে ৪৫-৫০% আমিষ সমৃদ্ধ খাবার দৈহিক ওজনের ৮-১০% হারে এবং ৪০-৪৫ দিন পর ৪০-৪২% আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য দৈহিক ওজনের ৪-৫% হারে এবং পরবর্তী চাষকালীন সময় জুড়ে তার দৈহিক ওজনের ২.৫-৩% হারে ৪০% আমিষ সমৃদ্ধ খাবার দিতে পারলে উচ্চফলন পাওয়া সম্ভব।
পানির গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ ও মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা : কোরাল মাছকে যেহেতু উচ্চ আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে চাষকৃত পুকুরের পানি দ্রুত সময়ের মধ্যে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পুকুরের পানির গুণগত মান রক্ষার্থে প্রথমত দেখতে হবে প্রদেয় খাদ্য অপচয় হয়ে তলায় গিয়ে অ্যামোনিয়ায় পরিণত হচ্ছে কি না, কোরাল মাছ চাষের পুকরের পানির পিএইচ, অ্যামোনিয়া ও দ্রভীভূত অক্সিজেন মাত্রা সবসময় কার্পজাতীয় মাছ চাষের জন্য নির্ধারিত মাত্রা সীমার মধ্যে রাখতে হবে। মাছের দৈহিক বৃদ্ধি ঠিক আছে কি না বা মাছ কোন পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হলো কি না তা দেখার জন্য মাসে অত্যন্ত একবার করে নমুনায়ন করতে হবে। পুকুরের পানির গুণাগুণ ঠিক রাখা এবং জলাশয়ের যেকোন ধরনের জীবাণু থেকে মাছকে রক্ষা করতে মাসে একবার করে শতাংশপ্রতি ৪৫০ গ্রাম চুন, ৪০০ গ্রাম লবণ ও ১৫ গ্রাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট প্রয়োগ করতে হবে।
মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ : সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করলে কোরাল মাছ ১৬-১৮ মাসে ২.৫ থেকে ৩ কেজি ওজন হয়ে থাকে, তবে ২-২.৫ কেজি ওজনের কোরাল মাছের বাজারে চাহিদা বেশি। শুরু থেকে মাছকে খাদ্য অভ্যস্থকরণ করে পরিমিত সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করলে ১৫-১৬ মাসের মধ্যে কোরাল মাছ বাজারজাতকরণের উপযোগী হয়ে যায়। দেশের প্রত্যেক বাজারে কোরাল মাছের ব্যাপক চাহিদা থাকায় এ মাছের বাজারমূল্য অন্যান্য মাছের থেকে অনেক বেশি এবং এ মাছ সাধারণত ৭০০-৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা সম্ভব।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে (ভারত, থাইল্যান্ডে) ব্যাপকভাবে কোরাল মাছ চাষ হচ্ছে, যা সারা বিশ্বে রপ্তানি করে তারা বিশ্ববাজার হতে প্রচুর বৈদশিক মুদ্রা অর্জন করছে। আমাদের দেশের জলাশয়ের পরিবেশ কোরাল মাছ চাষের উপযোগী এবং আমাদের দেশ এখন কোরাল মাছের পোনা উৎপাদনে সক্ষম সেহেতু এ মাছ বাংলাদেশের মাছ চাষিদের ভাগ্য পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার। কোরাল মাছের উৎপাদন কার্পজাতীয় মাছের থেকে কোন অংশে কম নয় এবং যেহেতু এ মাছ অন্যান্য স্বাদুপানির মাছের সাথে একত্রে চাষ করা সম্ভব তাই কোরাল মাছ চাষ সম্প্রসারণ করা এখন সময়ের দাবি। দেশে ও বিদেশে কোরাল বা ভেটকি মাছের ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণে এ দেশের মাছচাষিরা কোরাল মাছ চাষে এগিয়ে আসলে তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে তবে সেক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ফিশিং এন্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১২০৭। মোবাইল : ০১৭৪৫৬২৬১৫৩