Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য ও অঙ্কুরোদগম হার পরীক্ষা

ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য ও অঙ্কুরোদগম হার পরীক্ষা
মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম
গাছের যে অংশ নতুন আরেকটি গাছ জন্মানোর কাজে ব্যবহার করা হয় তাকে বীজ বলা হয়। মূল বীজ হিসেবে কিছু কিছু গাছের ফল, কিছু গাছের পাতা, কিছু গাছের কা- ব্যবহার করা হয়ে থাকে। একটি সুস্থ সুন্দর সন্তানের জন্য যেমন বাবা-মায়ের ভূমিকা অনেক, ঠিক তেমনি ভালো বীজের জন্য এর পূর্বপুরুষ বা যে উদ্ভিদ থেকে এসেছে তার গুরুত্ব অনেক। সুস্থ, সাবলীল এবং রোগমুক্ত গাছের ফল থেকে বীজ আসলে সেই বীজ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। অন্য দিকে যেসব গাছ ভাইরাস বা রোগে আক্রান্ত সেসব গাছের ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করলে সেই বীজ ওই ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে এবং পরবর্তী গাছ ভাইরাসযুক্ত হয়। যা ভালো ফলনের জন্য হুমকিস্বরূপ। বীজ যদি গুণগত মানসম্পন্ন না হয় তাহলে ভালো গাছ জন্মায় না।
ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ
ফসল উৎপাদনের জন্য সার, সেচ, কীটনাশক প্রয়োগ করা যেমন জরুরি ঠিক তেমনি ভালো মানের বীজ সংগ্রহ করা ও খুব জরুরি। ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ নিচে তুলে ধরা হলো : 
অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা হতে হবে ৮০ শতাংশ : ভালো বীজের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ১০০টি বীজ বপন করলে আপনি কতটি সুস্থ চারা পাবেন তা নির্ভর করে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতার উপর। বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা যদি ৬০ থেকে ৮০ ভাগের মধ্যে হয় তাহলে আপনি আপনার জমিতে প্রচুর পরিমাণে সুস্থ চারা পাবেন।
জাতীয় বীজ বোর্ড এর গবেষণা অনুযায়ী, ধান এবং গম বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা হতে হবে কমপক্ষে ৮০ শতাংশ। এবং ডাঁটা শাক, লালশাকসহ অন্যান্য সবজির বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা থাকতে হবে ৬০ শতাংশ। বীজের অঙ্কুরোদগুম ক্ষমতা কেমন হবে তা নির্ভর করে ফসলের ধরনের ওপর। 
উজ্জ্বল রঙের বীজ নির্বাচন : উজ্জ্বল রঙের বীজ হলো ভালো বীজের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। কেননা ফসলভেদে বীজের রং আলাদা হয়ে থাকে। কিন্তু বীজ যে রঙেরই হোক না কেন যেন চকচকে এবং উজ্জ্বল রঙের হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বীজ যদি ফ্যাকাস রংয়ের হয়ে থাকে তাহলে সেখান থেকে ভালো চারা কখনোই উৎপন্ন করা সম্ভব হবে না। আবার বীজ যেন ময়লা মুক্ত হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। 
 বীজের আর্দ্রতা : ভালো বীজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর আর্দ্রতা। ধান, গম এবং ভুট্টা বীজের আর্দ্রতা থাকতে হবে কমপক্ষে ১২ শতাংশ। যেকোনো শস্য জাতীয় ফসলের বীজের আর্দ্রতা থাকতে হবে কমপক্ষে ৯ শতাংশ। পাট এবং সূর্যমুখী বীজের আর্দ্রতা থাকতে হবে ৯ শতাংশ, ফুলকপি বীজের আর্দ্রতা থাকতে হবে ৭ শতাংশ। সরিষা বীজের আর্দ্রতা থাকতে হবে ৮ শতাংশ। বাঁধাকপি ও শালগম বীজের আর্দ্রতা থাকবে যথাক্রমে ৭ শতাংশ এবং ৬ শতাংশ। এক্ষেত্রে প্রত্যায়িত বীজের সর্বোচ্চ আর্দ্রতা থাকবে ৬-১২ শতাংশ।
 বীজের আকার : ভালো জাতের বীজ প্রায় সবগুলো একই আকারের হয়। বীজগুলোর পরিপক্বতা এবং পুষ্টতা দেখেই নির্ধারণ করা যায় যে বীজগুলো ভালো মানের কিনা। ভালো বীজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো বীজের আকার যেমন একই থাকে‌ ঠিক তেমনি প্রত্যেকটি বীজের ওজনও ঠিক একই রকমই থাকে।
বর্তমান কৃষকরা যেহেতু যান্ত্রিকভাবে বীজ বপনের উপর আস্থাশীল হয়ে উঠছেন, তাই নিজের আকার যদি সঠিক থাকে তাহলে যান্ত্রিকভাবে বীজ বপনে সুবিধা হবে।
বীজের তেজ : বীজের তেজ যদি বেশি থাকে তাহলে কৃষি জমিতে যতই প্রতিকূল অবস্থা তৈরি হলেও ভালো মানের চারা উৎপাদিত হয়। বীজের তেজ বেশি থাকলে চারা উৎপাদনের ক্ষমতা খুব তাড়াতাড়ি হারায় না। এ ছাড়া বীজের তেজ বেশি থাকলে চারা খুব দ্রুত গজায়। চারা গজানোর পর এক সপ্তাহের মধ্যে চারা দৈর্ঘ্য মাপলে বীজের তেজ সহজেই নির্ধারণ করা যায়।
বীজের সুপ্ততা : বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার জন্য যে পরিবেশ দরকার সেই পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও যখন বীজ অঙ্কুরিত হয় না তখন এ পরিস্থিতিকে বীজের সুপ্ততা বলা হয়ে থাকে। বীজ ভালো রাখার জন্য বীজের সুপ্ততা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বীজ যদি সুপ্ত থাকে তাহলে অনুকূল পরিবেশেও বীজ দীর্ঘমেয়াদি ভালো থাকে এবং নষ্ট হয় না।
তবে বীজের সুপ্ততা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকে এবং পরবর্তীতে তা নষ্ট হয়। বীজের সুপ্ততা কাটানোর জন্য রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়, ভিজিয়ে রাখা হয় এবং তাপ প্রয়োগ করা হয়। প্রত্যেকটি বীজ উৎপাদনের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বীজের সুপ্ততা থাকা জরুরি।
বীজের বিশুদ্ধতা : বীজের বিশুদ্ধতা বলতে বোঝায় বীজ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হবে, ধুলাবালু বিহীন হবে, অন্য বীজের সংমিশ্রণ থাকবে না, পোকামাকড়ের আক্রমণ মুক্ত হতে হবে। এক্ষেত্রে শস্যজাতীয় বিভিন্ন বীজ যেমন- ধান, গম, পাট, মসুর, বাদাম এবং মাষকলাই বীজের বিশুদ্ধতা থাকতে হবে ৯৬ থেকে ৯৮%।
অপরদিকে, ছোলা, মুগডাল এবং সরিষা বীজের বিশুদ্ধতা থাকতে হবে ৯৫ থেকে ৯৭ শতাংশ। বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করার জন্য বীজের নমুনা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
ভালো বীজের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য হলো 
বীজ গজানোর ক্ষমতা বীজের প্রকারভেদ এর ওপর নির্ভর করে ৭০-৮০ ভাগের বেশি হতে হবে।
সবগুলো বীজ একই সাথে গজাবে এবং রোপণের কিছুদিন পরেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে গজাবে।
বীজ সুপরিপক্ব, পুষ্ট, নিটোল হতে হবে।
উচ্চফলনশীল জাতের হতে হবে এবং কৃষক আশানুরূপ ফসল উৎপাদন করতে পারবেন এমন প্রকৃতির হতে হবে।
নিজের সাথে অন্য কোন বীজের মিশ্রণ বা আগাছা থাকবে না।
কোন বীজের মধ্যে যদি উক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া যায়, তাহলে সেই বীজ বপন করে আপনি লাভবান হবেন। এজন্য বীজ ক্রয় করার সময় সচেতন থাকুন।
বীজের অঙ্কুরোদগম বা গজানোর হার পরীক্ষা : পানি, তাপ, আলো ও বাতাসের অনুকূল পরিবেশে বীজ থেকে সুস্থ-সবল চারা গজানোকে অঙ্কুরোদগম বলে। বাছাই করে বা বাহ্যিকভাবে সতেজ ও সজীব এবং রোগমুক্ত সুস্থ বীজ বুঝা হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু বীজের অঙ্কুরোদগম পরীক্ষার মাধ্যমে সুস্থ সবল চারা দেখে  তা বুঝা সম্ভব। ব্যবহারের পূর্বে বীজ গজানোর পরীক্ষা করা হলে বীজ ভাল আছে নাকি বীজ হিসেবে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে তা সহজেই জানা যায়। বীজ পরীক্ষা করে আগেভাগেই ফলাফল জানা গেলে খারাপ বীজের লোকসান থেকেও বাঁচা যায়। বীজের মুখ ফাটলেই বা অংকুর বের হলেই যে বীজ ভালো আছে -এ ধারণাটি সঠিক নয়। কারণ অংকুর বের হওয়ার পরও খারাপ বীজের কারণে অনেক চারা মারা যেতে দেখা যায়। সে কারণে বীজ থেকে চারা গজানোর পর সম্পূর্ণ চারাটি পরীক্ষা করে দেখা দরকার। এ পরীক্ষার জন্য
-ভেজা বালুভর্তি মাটির থালায় বা প্লাস্টিক পাত্রে ১০০টি বীজ বসিয়ে হালকা করে বালু দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। বালি যেন শুকিয়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বালিতে গজানোর কারণে পরীক্ষার সময় চারা উঠালে শিকড় ছিঁড়ে যাবে না-ফলে শিকড়সহ সম্পূর্ণ চারাটি পরীক্ষা করা সম্ভব হবে।
-মৌসুমভেদে বপণের ৭ থেকে ১০ দিন পর গজানো চারা বালি থেকে তুলে একটা একটা করে পরীক্ষা করে অপেক্ষাকৃত ছোট-বড় ও রোগাক্রান্ত চারা, দুর্বল শিকড়সহ চারা, মৃত-পচা বীজ, অগজানো শক্ত বীজ ইত্যাদি বাদ দিয়ে যদি কমপক্ষে ৮০টি চারা সুস্থ-সবল পাওয়া যায় তা হলে বুঝতে হবে বীজ ভালো আছে।
-ভেজা চটে, লম্বালম্বি দুইভাগ করা কলার/কচুর খোলের কোঠরে, পরানো কাপড়/ডাস্টারে ১০০টি বীজ বসিয়েও গজানোর পরীক্ষা করা যেতে পারে ।
বীজের অঙ্কুরোদগম পরীক্ষার মাধ্যমে : বীজের অঙ্কুরোদগম হার জানা যায়; বীজ রোগ-পোকামাকড়ে আক্রান্ত কি না; বীজহার নির্ণয় অর্থাৎ বীজতলায় কতটুকু বীজ লাগবে তা বের করা যায়।
গজানোর হার বের করার সূত্র : 
বীজ গজানোর শতকরা হার = 
অঙ্কুরোদগম হার পরীক্ষার পরে করণীয় 
বীজের অঙ্কুরোদগম হার কম হলে বীজ হার বেশি হবে।
অবাছাইকৃত বীজের চেয়ে বাছাইকৃত বীজের অঙ্কুরোদগম হার বেশি তাই বীজ বাছাই করে বপন করা ভাল এতে করে বীজের পরিমাণ কম লাগে। 
বাছাইকৃত বীজের চারা রোগবালাই দ্বারা কম আক্রান্ত  হয়। এতে করে মূল জমিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ কমে যায়।
বীজতলায় বীজ বপনের পূর্বে বীজের অঙ্কুরোদগম পরীক্ষা করে নেয়া ভাল এতে কাক্সিক্ষত চারা পেতে কী পরিমাণ বীজ বীজতলায় ফেলতে হবে তা জানা যাবে।
ভালো বীজে ভালো ফসল হয়। তাই ফসল আবাদের শুরুতেই সংরক্ষিত বা কেনা বীজ মানসম্মত কি না তা যাচাই করে নেয়া প্রয়োজন। বীজের বাহ্যিক কিছু বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে ভালো মন্দ বোঝা যায়। তবে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা, সজীবতা বা সতেজতা কতটুকু আছে তা বোঝা সম্ভব হয় না। অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বীজের একটা অন্যতম গুণ। বীজের অঙ্কুরোদগম পরীক্ষা সম্পর্কে চাষিগণ সচেতন হলে শস্য উৎপাদনে বীজ হার নির্ণয়ে সহায়ক হবে। বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা সমন্ধে জ্ঞান না থাকায় চাষিরা অতিরিক্ত বীজ ব্যবহার করে থাকে। তা ছাড়া খারাপ বীজ ব্যবহারের ফলে চারা কম উৎপাদন হবে এবং প্রয়োজনীয় চারার অভাবে সময়মতো ফসল আবাদ ব্যাহত হতে পারে। তাই বীজ বাছাই ও অঙ্কুরোদগম পরীক্ষা অনুসরণ করা প্রয়োজন।

লেখক : উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ অফিসার, ঊপজেলা কৃষি অফিস, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৮৬১২৩৯২, ইমেইল : aquaiyum3@gmail.com