আউশ ধানের আবাদ ও ফলন বৃদ্ধিতে করণীয়
কৃষিবিদ ড. এম আব্দুল মোমিন
আউশ শব্দের অর্থ আগাম। বাংলা আশু শব্দ থেকে আউশ শব্দের উৎপত্তি। আউশ মানে আশু ধান্য। আশি থেকে একশ বিশ দিনের মধ্যে এ ধান ঘরে তোলা যায়। ধারণা করা হয় দ্রুত (আশু) ফসল উৎপন্ন হওয়ার বিচারে এই ধানের এমন নামকরণ হয়েছে। খনার বচনে আছে ‘আউশ ধানের চাষ, লাগে তিন মাস, কোল পাতলা ডাগর গুছি, লক্ষ্মী বলে হেথায় আছি’ অর্থাৎ আউশ ধান চাষে তিন মাস লাগে। ফাঁক ফাঁক করে লাগালে গোছা মোটা হয় এবং ফলনও বেশি হয়। আরো সহজ কথায় আউশে আমন-বোরোর মতো যত্ন নিলে ফলন কোন অংশেই কম হয় না। আউশ সালোকসংশ্লেষণ বেশি হয়, জীবনকাল কম এবং পানি সাশ্রয়ী। কথায় আছে ‘জ্যৈষ্ঠে খরা ধানের ভরা’ অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ মাসে একটু বৃষ্টি পেলেই আউশের জমি সবুজ ধানে ভরে যায়। এজন্য আউশ আবাদে বৃষ্টি ছাড়া অতিরিক্ত পানির দরকার হয় না। সার দেয়ার প্রয়োজনীয়তাও অনেক কম। কোনো কোনো আউশ ধান নিজে থেকেই আগাছা সহনশীল।
জমি তৈরি
বোরো মৌসুমের অনেকগুলো জাত আউশ মৌসুমে ভালোভাবে চাষ করা যায়। এগুলোর ফলন ৩.৫-৫টন/হেক্টর। তবে বোনা আউশে আগাছার উৎপাত রোপা ধানের তুলনায় অনেক বেশি। এ জন্য মৌসুম শুরুর আগেই শুকনো জমিতে ২-৩টি চাষের পর মই না দিয়ে জমি খোলা অবস্থায় রেখে দিতে হবে। এতে মাটি ভালোভাবে শুকিয়ে যাবে ফলে অনেক আগাছা এবং পোকামাকড় ও রোগজীবাণু মরে যায়। তাছাড়া এ অবস্থায় বৃষ্টি হলে জমিতে আগাছার বীজ সহজেই গজাতে পারে। জমির আগাছা গজানো সম্পন্ন হলে আবারো চাষ ও মই দিয়ে (জো থাকা অবস্থায়) মাটিকে ঝুর-ঝুরে করে বীজ বপন করতে হবে।
আউশের প্রকারভেদ
দুইরকমের আউশ হয়। যথা- বোনা ও রোপা আউশ।
বোনা আউশ
বোনা আউশে সাধারণত মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের ২৫ তারিখের মধ্যে (১০ই চৈত্র হতে ১০ই বৈশাখ) বীজ বপন করতে হয়। বীজ বপনের জন্য হেক্টরপ্রতি ৭০-৮০ কেজি বীজ ছিটিয়ে বপন করে হালকাভাবে একটা চাষ ও মই দিয়ে মাটি সমান করতে হয়। সারি করে ২৫ সেমি. দূরত্বে ৪-৫ সেমি. গভীর সারি করতে হয়। এতে হেক্টরপ্রতি ৪০-৫০ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়।
রোপা আউশ
বীজ বপনের সময় হলো ১৫ চৈত্র হতে ৫ বৈশাখ (৩০মার্চ-১৫ই এপ্রিল) এবং চারা রোপণের সময় ৫-৩০ বৈশাখ (১৫এপ্রিল -১০ মে)। ঊর্বর ও উঁচু জমিতে বীজতলা করতে হবে যেখানে হঠাৎ বৃষ্টিতে/বন্যায় পানি ওঠার সম্ভাবনা নেই। এক্ষেত্রে চারার বয়স হবে ১৫-২০ দিনের এবং রোপণ দূরত্ব রাখতে হবে সারি থেকে সারি ২০-২৫ সেমি. ও চারার দূরত্ব ১৫ সেমি.।
জাত নির্বাচন
আগে আউশ আবাদ স্থানীয় জাতনির্ভর ছিল। স্থানীয় জাতের গড় ফলন ছিল হেক্টরপ্রতি ২.০০ টন থেকে ২.৩৫ টন পর্যন্ত। ব্যতিক্রম ছিল কেবল কটকতারা, যার হেক্টরপ্রতি ফলন ছিল ৩.৩৫ টন। তবে বর্তমানে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট (ব্রি) কর্তৃক উদ্ভাবিত বোনা এবং রোপা আউশ মৌসুম উপযোগী জাতের প্রত্যেকটির ফলন কটকতারার চেয়ে অনেক বেশি।
আউশ মৌসুমে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বোনা আউশ জাত- বিআর২০, ২১, ২৪, ব্রি ধান২৭, ৪২, ৪৩ ৬৫ এবং ব্রি ধান৮৩ চাষ করা যেতে পারে। এ ছাড়া রোপা আউশ হিসেবে বিআর১, ২, ৩, ৬, ৭, ৮, ৯, ১৪, ১৬, ২৬, ব্রি ধান২৭, ৪৮, ৫৫, ৮২, ৮৫, ৯৮, ১০৬ এবং ব্রি হাইব্রিড ধান৭ চাষ করা যেতে পারে। নতুন জাতগুলোর মধ্যে ব্রি ধান৯৮ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৭ গত আউশ মৌসুমে কৃষকপর্যায়ে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। এর মধ্যে ব্রি ধান৯৮ এর ফলন প্রতি বিঘায় ২২ মণ। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে এটি প্রতি বিঘায় ২৫ মণ পর্যন্ত ফলন দিতে পারে। এর দানা লম্বা ও চিকন, রং সোনালী। এ জাতের জীবনকাল ১১২ দিন, এক হাজারটি পুষ্ট ধানের ওজন গড়ে ২২.৬ গ্রাম। ধানের দানায় অ্যামাইলোজের পরিমাণ শতকরা ২৭.৯ ভাগ এবং প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ৯.৫ ভাগ। ভাত ঝরঝরে ও সু-স্বাদু।
এ ছাড়া আউশে এখন পর্যন্ত একমাত্র হাইব্রিড জাত ব্রি হাইব্রিড ধান৭। এই ধানের জীবনকাল ১১৫দিন, গড় ফলন প্রতি বিঘায় ২৩ মণ। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে এটি প্রতি বিঘায় এই জাত ২৭ মণ পর্যন্ত ফলন দিতে পারে। এর দানায় অ্যামাইলোজের পরিমাণ প্রচলিত অন্যান্য হাইব্রিড ধানের তুলনায় বেশি তাই ভাত ঝরঝরে ও খেতেও বেশ সু-স্বাদু হয়।
বীজ বপন
বোনা আউশের বীজ তিনভাবে বপন করা যায়-
ছিটিয়ে- এতে শতকরা ৮০ ভাগ অঙ্কুরোদগম সম্পন্ন ভালো বীজ হেক্টরপ্রতি ৭০-৮০ কেজি হারে বুনে দিতে হবে, এরপর হাল্কাভাবে একটা চাষ ও মই দ্বারা মাটি সমান করতে হবে।
সারি করে- এতে ২৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে ৪-৫ সেমি. গভীর করে সারি তৈরি করতে হবে এবং হেক্টরপ্রতি ৪৫-৫০ কেজি হারে বীজ বপন করতে হবে। এবার মই দিয়ে মাটি সমান করতে হবে।
ডিবলিং পদ্ধতিতে- এতে বাঁশ বা কাঠের দ- দিয়ে ২০ সেন্টিমিটার পরপর মাটিতে গর্ত করে গর্তপ্রতি ২/৩টি করে বীজ বপন করে মই দিয়ে মাটি সমান করে দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে বপনের জন্য বীজের হার হলো হেক্টরপ্রতি ২৫-৩০ কেজি।
তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোন বীজ মাটির উপরে না থাকে। আবার বেশি গভীর ধান বপন করা হলে অনেক ধান ঠিকমতো গজাতে পারে না। জমিতে রস না থাকলে বীজ বপন না করাই ভালো। এতে কিছু সংখ্যক বীজ গজানোর পর মাটিতে রসের অভাবে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। চারা গজানোর এক সপ্তাহ পর আচড়া দিয়ে জমির মাটি আলগা করে দিতে হবে। এতে চারার ঘনত্ব ঠিক থাকে, গাছের বাড়-বাড়তিও ভালো হয় এবং আগাছা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
সার ব্যবস্থাপনা
মাটি পরীক্ষা করে সারের মাত্রা ঠিক করা প্রয়োজন। বোনা/রোপা আউশে ইউরিয়া-টিএসপি-এমওপি-জিপসাম-দস্তা (মনোহাইড্রেট) হেক্টর প্রতি ১৩৫-৫৫-৭৫-৩৫-৫ হারে প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষের সময় বোনা আউশের সব সারই প্রয়োগ করতে হবে। বৃষ্টিবহুল বোনা আউশে ইউরিয়া সমান দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করলে গাছের বাড় বাড়তি ভালো হয় ও ফলন বৃদ্ধি পায়। ১ম কিস্তি শেষ চাষের সময় ও ২য় কিস্তি ধান বপনের ৩০-৪০ দিন পর। রোপা আউশে ইউরিয়া ১ কিস্তি (১/৩) শেষ চাষের সময়, ২য় কিস্তি (১/৩) ৪-৫টি কুশি দেখা দিলে (সাধারণত রোপণের ১৫-১৮ দিন পর) এবং ৩য় কিস্তি (১/৩) ইউরিয়া কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে গন্ধক এবং দস্তার অভাব থাকলে শুধুমাএ জিপসাম এবং দস্তা (মনোহাইড্রেট) প্রয়োগ করতে হবে।
স¤পূরক সেচ
আউশ চাষাবাদ পুরোটাই বৃষ্টিনির্ভর। তবে প্রতি বছর সকল স্থানে বৃষ্টিপাতের ধরন এক রকম হয় না। এমন কি একই বছরে একই স্থানে সবসময় সমানভাবে বৃষ্টিপাত হয় না। বিশেষত বোনা আউশে বৃষ্টিপাতের পর জমিতে জো আসলে বীজ ছিটানো হয়। যদি সময়মতো বৃষ্টিপাত না হয় তাহলে যেকোন পর্যায়ে সাময়িকভাবে বৃষ্টির অভাব দেখা দিলে অবশ্যই সম্পূরক সেচ দিতে হবে। একইভাবে রোপা আউশের সময়ও যদি প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত না হয় তবে বৃষ্টির আশায় না থেকে প্রয়োজনে একাধিক সম্পূরক সেচ দেয়া যেতে পারে। এজন্য আউশ মওসুমে নিশ্চিত ভালো ফলনের জন্য ধান জমিতে প্রতিষ্ঠিত করতে সম্পূরক সেচের প্রয়োজন পড়ে।
আগাছা ব্যবস্থাপনা
উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কারণে বোনা আউশ ধানে আগাছার খুবই উপদ্রব হয়। সময়মতো আগাছা দমন না করলে শতকরা ৮০-১০০ ভাগ ফলন কমে যায়। সাধারনত হাত দিয়ে, নিড়ানি যন্ত্রের সাহায্যে অথবা আগাছানাশক ব্যবহারের মাধ্যমে আগাছা দমন করা যায়। হাত দিয়ে আগাছা নিড়ানো কষ্টকর ও শ্রমসাধ্য। এক্ষেত্রে বীজ বপনের ১৫-২০দিন পর প্রথমবার এবং ৩৫-৪০দিন পর দ্বিতীয়বার আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। সারি করে বপন বা রোপণ না করলে নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহার করা যায় না। আগাছানাশক ব্যবহারের মাধ্যমে আগাছা দমন করা সহজ ও সাশ্রয়ী। এক্ষেত্রে বোনা আউশের জন্য প্রি-ইমারজেন্স আগাছানাশক হিসেবে পেনডামিথাইলিন, অক্সাডায়ারজিল এবং অক্সাডায়াজন গ্রুপের যেকোন আগাছানাশক বপনের ২/৩ দিনের মধ্যে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে জমি ভেজা থাকলেও কোন দাড়ানো পানি রাখা যাবে না।রোপা আউশ ধানের ক্ষেত্রে প্রি-ইমারজেন্স আগাছানাশক হিসেবে বেনসালফিউরান মিথাইল+এসিটাফ্লোর, মেফেনেসেট+ বেনসালফিউরান মিথাইল, সালফেনট্রাজোন ইত্যাদি গ্রুপের আগাছানাশক রোপণের ৩ দিনের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে। রোপা/বোনা আউশ ধানের ক্ষেত্রে পোস্ট ইমারজেন্স আগাছানাশক প্রয়োগেও আগাছা ভালভাবে পরিষ্কার হয়। সে ক্ষেত্রে বিসপাইরিবেক সোডিয়াম, বেনসালফিউরাল মিথাইল, ডায়াফিমনি, ইথক্সিসালফিউরান এবং ফেনক্সলাম গ্রুপের আগাছানাশক জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। পরবর্তীতে আগাছার অবস্থা বুঝে ৩৫-৪০ দিন পর একবার হাতে নিড়ানি দিতে হবে।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
নিবিড় চাষাবাদের কারণে আউশে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ আগের চেয়ে বেড়েছে। ফলে ক্ষতিকর পোকা দমন এবং ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। আউশে মুখ্য পোকাগুলো হলো- মাজরা পোকা, নলি মাছি, পাতা মাছি, পামরী পোকা, চুংগী পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, লেদা পোকা, লম্বাশুঁড় উড়চুঙ্গা, ঘাস, ফড়িং, সবুজ শুঁড় লেদা পোকা, ঘোড়া পোকা, সবুজ পাতা ফড়িং, আঁকাবাঁকা পাতাফড়িং, থ্রিপস, বাদামি গাছ ফড়িং, সাদা পিঠ গাছফড়িং, ছাতরা পোকা, গান্ধি পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা, উরচুংগা ইত্যাদি। পোকার ক্ষতির মাত্রা পোকার প্রজাতি, পোকার সংখ্যা, এলাকার সামগ্রিক পরিবেশ, জমি বা তার আশেপাশের অবস্থা, ধানের জাত, ধানগাছের বয়স, উপকারী পরভোজী ও পরজীবী পোকামাকড়ের সংখ্যা ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। ধান ক্ষেতে ক্ষতিকারক পোকা দেখা গেলে এর সাথে বন্ধু পোকা, যেমন-মাকড়সা, লেডি-বার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটলসহ অনেক পরজীবী ও পরভোজী পোকামাকড় কি পরিমাণে আছে তা দেখতে হবে এবং শুধু প্রয়োজনে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
রোগ ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশে ধান ফসলে ৩১টি রোগ ক্ষতি করে বলে জানা গেছে। তবে এসব রোগের মধ্যে আউশে ১০টি রোগকে প্রধান বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এগুলো হলো- ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া রোগ, পাতার লালচে রেখা রোগ, গুঁড়িপচা রোগ, ব্লাস্ট রোগ, খোলপোড়া রোগ, ভুয়াঝুল রোগ, বাদামি দাগ রোগ, সরু বাদামি দাগ রোগ, কা-পচা রোগ, খোল পচা রোগ, পাতার ফোস্কাপড়া রোগ, টুংরো রোগ, হলদে বামন রোগ, উফরা রোগ, শিকড়ে গিঁট রোগ, বাঁকানি রোগ ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ রোগ হলো টুংরো, খোলপোড়া, ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া ও উফরা রোগ।
ফসল কাটা, মাড়াই ও সংরক্ষণ
শীষে ধান পেকে গেলেই ফসল কাটতে হবে। অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝরে পড়ে, শীষ ভেঙে যায়, শীষকাটা লেদাপোকা এবং পাখির আক্রমণ হতে পারে। তাই মাঠে গিয়ে ফসল পাকা পরীক্ষা করতে হবে। শীষের অগ্রভাগের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ এবং শীষের নিচের অংশে শতকরা ২০ ভাগ ধানের চাল আংশিক শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। এ সময়ে ফসল কেটে মাঠেই বা উঠানে এনে মাড়াই করতে হবে। তাড়াতাড়ি মাড়াইয়ের জন্য ব্রি উদ্ভাবিত মাড়াইযন্ত্র ব্যবহার করা যায়। ধান মাড়াই করার জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গা বেছে নিন। কাঁচা খলায় সরাসরি ধান মাড়াই করার সময় চাটাই, চট বা পলিথিন বিছিয়ে নেয়া উচিত। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রঙ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে। মাড়াই করার পর অন্তত ৪-৫ বার রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। ভালভাবে শুকানোর পর ঝেড়ে নিয়ে গোলাজাত করুন। বাদলা দিনে কোনো উপায় না থাকলে ধান মাড়াই করে সাধ্যমতো ঝেড়ে বস্তায় ভরে যে কোনো জলাশয়ে ২/৩ হাত গভীর পানিতে খুঁটির সাথে বেঁধে ডুবিয়ে রাখুন যেন ধানের বস্তা ডুবন্ত অবস্থায় মাটির সংস্পর্শে না আসে। এভাবে ১০ দিন পর্যন্ত পানির নিচে রাখলেও ধান নষ্ট হয় না। ধান পানিতে ডুবানোর ফলে কিছুটা গন্ধ হলেও সিদ্ধ করার পর ভালভাবে শুকানো হলে আর গন্ধ থাকে না।
ধানের বীজ সংরক্ষণ
ভাল ফলন পেতে হলে ভালো বীজের প্রয়োজন। এ কথা মনে রেখেই কৃষকভাইদের ঠিক করতে হবে কোন জমির ধান বীজ হিসেবে রাখবেন। যে জমির ধান ভালভাব পেকেছে, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়নি এবং আগাছামুক্ত সে জমির ধান বীজ হিসেবে রাখতে হবে। ধান কাটার আগেই বিজাতীয় গাছ সরিয়ে ফেলতে হবে। মনে রাখতে হবে গাছের আকার-আকৃতি ও রঙ, ফুল ফোটার সময় ও শীষের ধরন, ধানের আকার আকৃতি, রঙ ও শুঙ এবং সর্বশেষ ধান পাকার সময় আগে-পিছে হলেই তা বিজাতীয় গাছ। সকল রোগাক্রান্ত গাছ অপসারণ করতে হবে। এরপর বীজ হিসেবে ফসল কেটে এবং আলাদা মাড়াই, ঝাড়াই ও ভালভাবে রোদে শুকিয়ে মজুদ করুন। বীজ ধান সংরক্ষণে যেসব পদক্ষেপ নেয়া উচিত সেগুলো হলো -
মাড়াইয়ের পর থেকে ৫-৬ রোদে ভালভাবে শুকিয়ে নিতে হবে যেন বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে। দাঁত দিয়ে বীজ কাটলে যদি কটকট শব্দ হয় তাহলে বুঝতে হবে বীজ ঠিকমতো শুকিয়েছে।
পুষ্ট ধান বাছাই করতে কুলা দিয়ে কমপক্ষে দুবার ঝেড়ে নেয়া যেতে পারে। বায়ুরোধী পাত্রে বীজ রাখা উচিত। বীজ রাখার জন্য ড্রাম ও বিস্কুট বা কেরোসিনের টিন ব্যবহার করা ভাল। পাত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করে শুকিয়ে নিতে হবে। ধাতব অথবা প্লাস্টিক ড্রাম ব্যবহার করা সম্ভব না হলে, মাটির মটকা, কলস বা মোট পলিথিনের থলি ব্যবহার করা যেতে পারে। মাটির পাত্র হলে পাত্রের বাইরের গায়ে দুবার আলকাতরার প্রলেপ দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে।
রোদে শুকানো বীজ ঠা-া করে পাত্রে ভরতে হবে। পাত্রটি সম্পূর্ণ বীজ দিয়ে ভরে রাখতে হবে। যদি বীজের পরিমাণ কম হয় তবে বীজের উপর কাগজ বিছিয়ে তার উপর শুকনো বালি দিয়ে পাত্র পরিপূর্ণ করতে হবে।
পাত্রের মুখ ভালভাবে বন্ধ করতে হবে যেন বাতাস ঢুকতে না পারে। বীজ পাত্র মাচায় রাখা ভালো, যাতে পাত্রের তলা মাটির সংস্পর্শে না আসে।
গোলায় ধান রাখলে ১ মণ ধানের জন্য আনুমানিক ১২০ গ্রাম নিম বা নিশিন্দা অথবা বিষকাটালীর পাতা গুঁড়া করে মিশিয়ে দিয়ে সংরক্ষণ করলে পোকার আক্রমণ প্রতিহত হয়।
সম্ভাবনা ও সুপারিশ
কৃষি মন্ত্রণালয় এর ওয়েব সাইট থেকে জানা যায়, দেশে মোট আবাদযোগ্য জমি ৮৮.২৯ লক্ষ হেক্টর, মোট সেচকৃত জমি ৭৮.৭৯ লক্ষ হেক্টর, আবাদযোগ্য পতিত জমি আছে প্রায় ৪.৩১ লক্ষ হেক্টর। সেচনির্ভর জমি বোরো উৎপাদনে ছেড়ে দিলেও দেশজুড়ে থাকা আবাদযোগ্য পতিত জমিতে আউশ আবাদ সম্প্রসারণ করা গেলে গড় ফলন ৩.০টন/হে. ধরলেও বর্তমানের চেয়ে প্রায় ১৩ লক্ষ টন অতিরিক্ত ফলন জাতীয় উৎপাদনে যোগ করা সম্ভব হবে।
লেখক: ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ইমেইল smmomin80@gmail.com,০১৭১৬৫৪০৩৮০।
আউশ ধানের আবাদ ও ফলন বৃদ্ধিতে করণীয়
কৃষিবিদ ড. এম আব্দুল মোমিন
আউশ আবাদ স্থানীয় জাতনির্ভর ছিল। স্থানীয় জাতের গড় ফলন ছিল হেক্টরপ্রতি ২.০০ টন থেকে ২.৩৫ টন পর্যন্ত। ব্যতিক্রম ছিল কেবল কটকতারা, যার এর হেক্টরপ্রতি ফলন ছিল ৩.৩৫ টন। তবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট (ব্রি) এখন পর্যন্ত ২৭টি বোনা এবং রোপা আউশ মওসুম উপযোগী জাত উদ্ভাবন করেছে। দুই রকমের আউশ হয়। যথা- বোনা ও রোপা আউশ। বোনা আউশে সাধারণত মাঠের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের ২৫ তারিখের মধ্যে (১০ই চৈত্র হতে ১০ই বৈশাখ) বীজ বপন করতে হয় এবং রোপা আউশের বীজ বপন সময় ১৫ চৈত্র হতে ৫ বৈশাখ (৩০ মার্চ-১৫ এপ্রিল) এবং চারা রোপণের সময় ৫-৩০ বৈশাখ (১৫ এপ্রিল-১০ মে)। তবে বোনা আউশে আগাছার উৎপাত রোপা ধানের তুলনায় অনেক বেশি। এ জন্য মৌসুম শুরুর আগেই শুকনো জমিতে ২-৩টি চাষের পর মই না দিয়ে জমি খোলা অবস্থায় রেখে দিতে হবে। এতে মাটি ভালোভাবে শুকিয়ে যাবে ফলে অনেক আগাছা এবং পোকামাকড় ও রোগজীবাণু মরে যায়। তাছাড়া এ অবস্থায় বৃষ্টি হলে জমিতে আগাছার বীজ সহজেই গজাতে পারে। জমির আগাছা গজানো সম্পন্ন হলে আবারও চাষ ও মই দিয়ে (জো থাকা অবস্থায়) মাটিকে ঝুরঝুরে তৈরি করতে হবে। এবার দেরি না করে বীজ বুনে ফেলতে হবে।
জাত নির্বাচন
আউশ মওসুমে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বোনা আউশ জাত- বিআর২০, বিআর২১, বিআর২৪, ব্রি ধান৪২, ব্রি ধান৪৩ ও ব্রি ধান৮৩ এবং রোপা হিসেবে বিআর২৬, ব্রি ধান২৭, ব্রি ধান৪৮, ব্রি ধান৮২ ব্রি ধান৮৫, ব্রি ধান৯৮, ব্রি ধান১০৬ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৭সহ ১৪টি জাত এখন মাঠপর্যায়ে চাষ হচ্ছে যার প্রত্যেকটি জাতের ফলন কটকতারার চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়াও বোরো মওসুমের অনেকগুলো জাত আউশ মওসুমে ভালোভাবে চাষ করা যায়। এগুলোর ফলন ৩.৫-৫টন/হে.। নতুন জাতগুলোর মধ্যে ব্রি ধান৯৮ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৭ গত আউশ মওসুমে কৃষকপর্যায়ে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। এর মধ্যে ব্রি ধান৯৮ এর ফলন প্রতি বিঘায় ২২ মণ। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে এটি প্রতি বিঘায় ২৫ মণ পর্যন্ত ফলন দিতে পারে। এর দানা লম্বা ও চিকন, রং সোনালি। এ জাতের জীবনকাল ১১২ দিন, এক হাজারটি পুষ্ট ধানের ওজন গড়ে ২২.৬ গ্রাম। ধানের দানায় অ্যামাইলোজের পরিমাণ শতকরা ২৭.৯ ভাগ এবং প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ৯.৫ ভাগ। ভাত ঝরঝরে ও সু-স্বাদু।
এ ছাড়া আউশে এখন পর্যন্ত একমাত্র হাইব্রিড জাত ব্রি হাইব্রিড ধান৭। এই ধানের জীবনকাল ১১৫ দিন, গড় ফলনপ্রতি বিঘায় ২৩ মণ। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে এটি প্রতি বিঘায় এই জাত ২৭ মণ পর্যন্ত ফলন দিতে পারে। এর দানায় অ্যামাইলোজের পরিমাণ প্রচলিত অন্যান্য হাইব্রিড ধানের তুলনায় বেশি তাই ভাত ঝরঝরে ও খেতেও বেশ সু-স্বাদু হয়।
বীজ বপন
বোনা আউশের বীজ তিনভাবে বপন করা যায়-
ছিটিয়ে- এতে শতকরা ৮০ ভাগ অঙ্কুরোদগম সম্পন্ন ভাল বীজ হেক্টরপ্রতি ৭০-৮০ কেজি হারে বুনে দিতে হবে, এরপর হাল্কাভাবে একটা চাষ ও মই দ্বারা মাটি সমান করতে হবে।
সারি করে- এতে ২৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে ৪-৫ সেমি. গভীর করে সারি তৈরি করতে হবে এবং হেক্টরপ্রতি ৪৫-৫০ কেজি হারে বীজ বপন করতে হবে। এবার মই দিয়ে মাটি সমান করতে হবে।
ডিবলিং পদ্ধতিতে- এতে বাঁশ বা কাঠের দ- দিয়ে ২০ সেন্টিমিটার পর পর মাটিতে গর্ত করে গর্ত প্রতি ২/৩টি করে বীজ বপন করে মই দিয়ে মাটি সমান করে দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে বপনের জন্য বীজের হার হলো হেক্টরপ্রতি ২৫-৩০ কেজি।
তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোন বীজ মাটির উপরে না থাকে। আবার বেশি গভীর ধান বপন করা হলে অনেক ধান ঠিকমতো গজাতে পারে না। জমিতে রস না থাকলে বীজ বপন না করাই ভালো। এতে কিছু সংখ্যক বীজ গজানোর পর মাটিতে রসের অভাবে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। চারা গজানোর এক সপ্তাহ পর আচড়া দিয়ে জমির মাটি আলগা করে দিতে হবে। এতে চারার ঘনত্ব ঠিক থাকে, গাছের বাড়-বাড়তিও ভালো হয় এবং আগাছা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
সার ব্যবস্থাপনা
মাটির উর্বরতার মান যাচাই এবং ফলন মাত্রার উপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা ঠিক করা প্রয়োজন। বোনা/রোপা আউশে ইউরিয়া- টিএসপি-এমওপি-জিপসাম-দস্তা (মনোহাইড্রেট) হেক্টরপ্রতি ১৩৫-৫৫-৭৫-৩৫-৫ হারে প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষের সময় বোনা আউশের সব সারই প্রয়োগ করতে হবে। বৃষ্টিবহুল বোনা আউশে ইউরিয়া সমান দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করলে গাছের বাড় বাড়তি ভালো হয় ও ফলন বৃদ্ধি পায়। ১ম কিস্তি শেষ চাষের সময় ও ২য় কিস্তি ধান বপনের ৩০-৪০ দিন পর। রোপা আউশে ইউরিয়া ১ কিস্তি (১/৩) শেষ চাষের সময়, ২য় কিস্তি (১/৩) ৪-৫ টি কুশি দেখা দিলে (সাধারণত রোপণের ১৫-১৮ দিন পর) এবং ৩য় কিস্তি (১/৩) ইউরিয়া কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে গন্ধক এবং দস্তার অভাব থাকলে শুধুমাত্র জিপসাম এবং দস্তা (মনোহাইড্রেট) প্রয়োগ করতে হবে।
সম্পূরক সেচ : আউশ চাষাবাদ পুরোটাই বৃষ্টিনির্ভর। তবে প্রতি বছর সকল স্থানে বৃষ্টিপাতের ধরন এক রকম হয় না। এমন কি একই বছরে একই স্থানে সবসময় সমানভাবে বৃষ্টিপাত হয় না। বিশেষত বোনা আউশে একটি বৃষ্টিপাতের পর জমিতে জো আসলে বীজ ছিটানো হয়। যদি সময়মতো বৃষ্টিপাত না হয় তাহলে যেকোন পর্যায়ে সাময়িকভাবে বৃষ্টির অভাব দেখা দিলে অবশ্যই সম্পূরক সেচ দিতে হবে। একইভাবে রোপা আউশের সময়ও যদি প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত না হয় তবে বৃষ্টির আশায় না থেকে প্রয়োজনে একাধিক সম্পূরক সেচ দেয়া যেতে পারে। এজন্য আউশ মওসুমে নিশ্চিত ভালো ফলনের জন্য ধান জমিতে প্রতিষ্ঠিত করতে সম্পূরক সেচের প্রয়োজন পড়ে।
আগাছা ব্যবস্থাপনা
উচ্চতাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কারণে বোনা আউশ ধানে আগাছার খুবই উপদ্রব হয়। সময়মতো আগাছা দমন না করলে শতকরা ৮০-১০০ ভাগ ফলন কমে যায়। বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর প্রথমবার এবং ৩৫-৪০দিন পর দ্বিতীয়বার আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। সারি করে বপন বা রোপণ না করলে নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহার করা যায় না। আগাছানাশক ব্যবহারের মাধ্যমে আগাছা দমন করা সহজ ও সাশ্রয়ী। এক্ষেত্রে বোনা আউশের জন্য প্রি-ইমারজেন্স আগাছানাশক হিসেবে পেনডামিথাইলিন, অক্সাডায়ারজিল এবং অক্সাডায়াজন গ্রুপের যে কোন আগাছানাশক বপনের ২/৩ দিনের মধ্যে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে জমি ভেজা থাকলেও কোন দাঁড়ানো পানি রাখা যাবে না। রোপা আউশ ধানের ক্ষেত্রে প্রি-ইমারজেন্স আগাছানাশক হিসেবে বেনসালফিউরান মিথাইল+ এসিটাফ্লোর, মেফেনেসেট+বেনসালফিউরান মিথাইল, সালফেনট্রাজোন ইত্যাদি গ্রুপের আগাছা নাশক রোপণের ৩ দিনের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
নিবিড় চাষাবাদের কারণে আউশে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ আগের চেয়ে বেড়েছে। ফলে ক্ষতিকর পোকা দমন এবং ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। আউশে মুখ্য পোকাগুলো হলো- মাজরা পোকা, নলি মাছি, পাতা মাছি, পামরী পোকা ইত্যাদি পোকার ক্ষতির মাত্রা পোকার প্রজাতি, পোকার সংখ্যা, এলাকার সামগ্রিক পরিবেশ, জমি বা তার আশেপাশের অবস্থা, ধানের জাত, ধান গাছের বয়স, উপকারী পরভোজী ও পরজীবী পোকামাকড়ের সংখ্যা ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। ধানক্ষেতে ক্ষতিকারক পোকা দেখা গেলে এর সাথে বন্ধু পোকা, যেমন- মাকড়সা, লেডি-বার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটল সহ অনেক পরজীবী ও পরভোজী পোকামাকড় কি পরিমাণে আছে তা দেখতে হবে এবং শুধু প্রয়োজনে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
ফসল কাটা, মাড়াই
শীষে ধান পেকে গেলেই ফসল কাটতে হবে। অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝরে পড়ে, শীষ ভেঙে যায়, শীষকাটা লেদাপোকা এবং পাখির আক্রমণ হতে পারে। তাই মাঠে গিয়ে ফসল পাকা পরীক্ষা করতে হবে। শীষের অগ্রভাগের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ এবং শীষের নিচের অংশে শতকরা ২০ ভাগ ধানের চাল আংশিক শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। এ সময়ে ফসল কেটে মাঠেই বা উঠানে এনে মাড়াই করতে হবে। তাড়াতাড়ি মাড়াইয়ের জন্য ব্রি উদ্ভাবিত মাড়াইযন্ত্র ব্যবহার করা যায়।
ধানের বীজ সংরক্ষণ
ভালো ফলন পেতে হলে ভালো বীজের প্রয়োজন। এ কথা মনে রেখেই কৃষকভাইদের ঠিক করতে হবে কোন জমির ধান বীজ হিসেবে রাখবেন। যে জমির ধান ভালোভাব পেকেছে, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়নি এবং আগাছামুক্ত সে জমির ধান বীজ হিসেবে রাখতে হবে। ধান কাটার আগেই বিজাতীয় গাছ সরিয়ে ফেলতে হবে। মনে রাখতে হবে গাছের আকার-আকৃতি ও রঙ, ফুল ফোটার সময় ও শীষের ধরন, ধানের আকার আকৃতি, রঙ ও শুঙ এবং সর্বশেষ ধান পাকার সময় আগে-পিছে হলেই তা বিজাতীয় গাছ। সকল রোগাক্রান্ত গাছ অপসারণ করতে হবে। এরপর বীজ হিসেবে ফসল কেটে এবং আলাদা মাড়াই, ঝাড়াই ও ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে মজুদ করুন। বীজ ধান সংরক্ষণে যেসব পদক্ষেপ নেয়া উচিত সেগুলো হলো-
মাড়াইয়ের পর থেকে ৫-৬ রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে যেন বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে। দাঁত দিয়ে বীজ কাটলে যদি কটকট শব্দ হয় তাহলে বুঝতে হবে বীজ ঠিকমতো শুকিয়েছে; পুষ্ট ধান বাছাই করতে কুলা দিয়ে কমপক্ষে দুবার ঝেড়ে নেয়া যেতে পারে; বায়ুরোধী পাত্রে বীজ রাখা উচিত। বীজ রাখার জন্য ড্রাম ও বিস্কুট বা কেরোসিনের টিন ব্যবহার করা ভালো। পাত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করে শুকিয়ে নিতে হবে; ধাতব অথবা প্লাস্টিক ড্রাম ব্যবহার করা সম্ভব না হলে, মাটির মটকা, কলস বা মোটা পলিথিনের থলি ব্যবহার করা যেতে পারে। মাটির পাত্র হলে পাত্রের বাইরের গায়ে দুবার আলকাতরার প্রলেপ দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে; রোদে শুকানো বীজ ঠা-া করে পাত্রে ভরতে হবে। পাত্রটি সম্পূর্ণ বীজ দিয়ে ভরে রাখতে হবে। যদি বীজের পরিমাণ কম হয় তবে বীজের উপর কাগজ বিছিয়ে তার উপর শুকনো বালু দিয়ে পাত্র পরিপূর্ণ করতে হবে; পাত্রের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে যেন বাতাস ঢুকতে না পারে। বীজ পাত্র মাচায় রাখা ভালো, যাতে পাত্রের তলা মাটির সংস্পর্শে না আসে; গোলায় ধান রাখলে ১ মণ ধানের জন্য আনুমানিক ১২০ গ্রাম নিম বা নিশিন্দা অথবা বিষকাটালীর পাতা গুঁড়া করে মিশিয়ে দিয়ে সংরক্ষণ করলে পোকার আক্রমণ প্রতিহত হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইট থেকে জানা যায়, দেশে মোট আবাদযোগ্য জমি ৮৮.২৯ লক্ষ হেক্টর, মোট সেচকৃত জমি ৭৮.৭৯ লক্ষ হেক্টর, আবাদযোগ্য পতিত জমি আছে প্রায় ৪.৩১ লক্ষ হেক্টর। সেচনির্ভর জমি বোরো উৎপাদনে ছেড়ে দিলেও দেশজুড়ে থাকা আবাদযোগ্য পতিত জমিতে আউশ আবাদ সম্প্রসারণ করা গেলে গড় ফলন ৩.০টন/হে. ধরলেও বর্তমানের চেয়ে প্রায় ১৩ লক্ষ টন অতরিক্তি ফলন জাতীয় উৎপাদনে যোগ করা সম্ভব হবে।
লেখক : ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, প্রশিক্ষণ বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ইমেইল smmomin80@gmail.com, ফোন-০১৭১৬৫৪০৩৮০।