Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষিখাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও সম্ভাবনা

কৃষিখাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও সম্ভাবনা
প্রফেসর ড. ইকবাল আহমেদ
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষিখাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কৃষিখাতের অবদান ছিল ১১.৩৮%। এছাড়া, দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৫.৪% কৃষিতে নিয়োজিত, যা কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। দেশের মোট ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ১৬০.৫৭ লক্ষ হেক্টর, যার মধ্যে নিট ফসলি জমি ৮১.২৬ লক্ষ হেক্টর। এই বিশাল কৃষিভূমি দেশের প্রায় ৭০% জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল (বিবিএস, ২০২২)। কৃষক ও কৃষি বাঁচলে দেশ বাচঁবে- এই সত্যাটি আমাদের সকলেরই উপলব্ধি করা উচিত। তবে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার না হলে ভবিষ্যতে এইখাতে কাক্সিক্ষত উন্নতি অর্জন করা সম্ভব নয়। এই প্রবন্ধে আমরা কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহারের উপযোগিতা, সম্ভাব্য সমস্যা এবং সমস্যা সমাধানে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে            কৃষিখাত শুধু খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যম নয়, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচিত। এসব দেশে কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে এবং ফসলের গুণগত মান উন্নত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে উন্নত যান্ত্রিকীকরণ, যেমন স্বয়ংক্রিয় ট্রাক্টর, ড্রোন এবং জিপিএস নির্ভর কৃষি ব্যবস্থাপনা, কৃষিকাজকে আরও দ্রুত ও সাশ্রয়ী করেছে। নেদারল্যান্ডসের মতো দেশ, যা তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃষি পণ্য রপ্তানিকারক, সেখানে হাইড্রোপনিক্স ও অ্যারোপনিক্স প্রযুক্তির মাধ্যমে মাটির প্রয়োজন ছাড়াই ফসল উৎপাদন করা হয়। জাপানে রোটিক ফামিং সিস্টেম ব্যবহার করে শ্রমিকের ঘাটতি কাটিয়ে তোলা হচ্ছে, যেখানে রোবট ফসল রোপণ, পরিচর্যা এবং সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করে। উন্নত দেশগুলোতে স্মার্ট সেচ প্রযুক্তি এবং ড্রোনের মাধ্যমে ফসলের স্বাস্থ্য মনিটরিং এবং রোগবালাই শনাক্তকরণ কৃষিকে আরও কার্যকর করেছে। এছাড়া, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা(অও) এবং ইন্টারনেট অর থিংস (ওড়ঞ) প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকেরা আবহাওয়ার পূর্বাভাস, ফসলের সঠিক পরিচর্যা এবং বাজারদরের তথ্য পেয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়। এসব উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, উন্নত দেশগুলোতে প্রয্ুিক্ত ব্যবহার কৃষি খাতকে শুধু উৎপাদনশীলই নয় বরং পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়েছে।
বাংলাদেশের কৃষিতে প্রযুক্তির উপযোগিতা 
বাংলাদেশের কৃষিতে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার উৎপাদনশীলতা ও টেকসই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন: ট্রাক্টর, কম্বাইন হারভেস্টার এবং পাওয়ার টিলার ব্যবহার করে কৃষকরা সহজে ধান কাটা, মাড়াই এবং বাছাইয়ের কাজ সম্পন্ন করতে পারেন, যা সময় ও খরচ সাশ্রয়ী করে তোলে। স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি যেমন ড্রোন ব্যবহার করে ফসলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও রোগ শনাক্তকরণ এবং স্মার্ট ইরিগেশন সিস্টেমের মাধ্যমে পানির অপচয় রোধ করে সঠিক সেচ নিশ্চিত করা সম্ভব। কৃষি ডেটা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে কৃষকদের আবহাওয়ার পূর্বাভাস, বাজারদর এবং রোগবালাই সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহ করা যায়। কৃষি বিষয়ক মোবাইল অ্যাপস ফসল পরিচর্যা এবং সারওষুধের সঠিক পরিমাণ নির্ধারণে সাহায্য করে, আর ই-কমার্সের মাধ্যমে কৃষকরা সরাসরি ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারেন, যা মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ন্য কমায়। পাশাপাশি জৈব প্রযুক্তি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং উন্নত বীজ এবং জৈবসারের ব্যবহার নিশ্চত করে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষকের প্রধান সমস্যা 
বাংলাদেশের কৃষিখাতে প্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও এর সফল বাস্তবায়নে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা কৃষকদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করছে। উন্নত যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে অতিরিক্ত খরচ অন্যতম প্রধান বাধা, কারণ দেশের অধিকাংশে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক বড় অঙ্কের আর্থিক বিনিয়োগে অক্ষম। একই সঙ্গে গ্রামীন কৃষকদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং প্রশিক্ষনের ঘাটতি তাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা অর্জনে বাধা দেয়। প্রশিক্ষনের অভাবে তারা প্রায়ই এই প্রযুক্তির সুবিধা নিতে পারে না। এছাড়া দেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগের অভাব কৃষি বিষয়ক তথ্য ও পরামর্শ সঠিক সময়ে পাওয়াকে কঠিন করে তোলে যার ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ন্যও প্রযুক্তির সুফল থেকে কৃষকদের বঞ্চিত করে, কারণ কৃষকরা সরাসরি বাজারে প্রবেশের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রায়ই তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য হন। অপরদিকে, সরকারি ভর্তুকি ও সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়ার জটিলতা এবং দীর্ঘসূত্রতা অনেক কৃষকের জন্য প্রযুক্তি গ্রহণকে অসম্ভব করে তোলে। এ সব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন প্রযুক্তির সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণ এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান অত্যন্ত জরুরি। একমাত্র সমন্বিত উদ্যেগের মাধ্যমেই বাংলাদেশের কৃষিতে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে কৃষিখাতের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব।
সমস্যার সমাধানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ
বাংলদেশের কৃষিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার এবং বেসরকারি খাতের সমন্বিত উদ্যোগ অপরিহার্য। সরকার যদি কৃষি যন্ত্রপাতি কেনার জন্য পর্যাপ্ত ভর্তুক্তি প্রদান করে তাহলে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকরাও আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা নিতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপ ধান কাটার কম্বাইন হারভেস্টার কিংবা পাওয়ার টিলার ব্যবহারে ভর্তুক্তি দিলে এটি অনেক বেশি কৃষকের জন্য সহজলভ্য হবে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন করা দরকার। যেখানে কৃষকদের মাঠপর্যায়ে হাতেকলমে শিক্ষা দেওয়া হবে। এছাড়া একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল হেল্প ডেস্ক বা হটলাইন চালু করা গেলে কৃষকরা তাদের সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান পেতে পারেন। স্বল্প সুদের ঋণ সুবিধা প্রদানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি কৃষকদের প্রযুক্তি কেনার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দেবে। অপরদিকে বেসরকারি খাত কৃষি যন্ত্রপাতি ভাড়া দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারে যেমন: কিছু অঞ্চলে ইতোমধ্যেই পাওয়ার টিলার বা কম্বাইন হারভেস্টার ভাড়া দেওয়ার সেবা চালু হয়েছে। একই সঙ্গে, ই-কমার্স প্লাটফর্মের উন্নয়ন করে কৃষকদের সরাসরি পণ্য বিক্রির সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে, যাতে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমে এবং কৃষকরা ন্যয্যমূল্য পান। গণমাধ্যমে কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল নিয়ে প্রচারণা চালালে কৃষকদের মধ্যে প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের এই সমন্বয় দেশের কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এছাড়াও বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম কৃষিখাতে উদ্ভাবন ও টেকসই উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তারা কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনের জন্য স্টার্টআপ গড়ে তুলতে পারে, যা রপ্তানি খাতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে, তরুণ উদ্যেক্তারা স্থানীয় কৃষিপণ্যের প্রক্তিয়াজাত করে আন্তর্জাতিক মানে রপ্তানি করার মাধ্যমে আয় বাড়াতে পারেন। জৈবসার উৎপাদন ও সরবরাহের মাধ্যমে তরুণরা পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রচলনেও ভূমিকা  রাখতে পারে। ডিজিটাল দক্ষতা ব্যবহার করে তরুনরা কৃষকদের জন্য বিশেষায়িত মোবাইল অ্যাপস বা অনলাইন মার্কেটপ্লেস তৈরি করতে পারেন, যেখানে কৃষকরা সহজেই ফসলের তথ্য পেতে এবং পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। এ ছাড়া উন্নত বীজ বা রোগ প্রতিরোধী ফসল নিয়ে গবেষণা তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণে আরও দ্রুততর হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয়ভাবে সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে তরুণরা কৃষকের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। তরুণরা কৃষকদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করলে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা বাড়বে এবং        কৃষি ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত হবে। পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষি পদ্ধতি প্রচলনেও তরুণদের উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে জৈব চাষ বা সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নে তরুণরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তরুণদের উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা ও উদ্যোগ দেশের কৃষিকে একটি আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর খাতে রূপান্তরিত করতে সহায়ক হবে।
তাই, কৃষিখাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সময়ের দাবি পাশাপাশি আর্থসামাজিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করলে বাংলাদেশ তার কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হবে। সরকার, বেসরকারি খাত এবং তরুণ প্রজন্ম একসঙ্গে কাজ করলে কৃষির চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করে এই খাতকে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদ- হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

লেখক : কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, মোবাইল ঃ ০১৭১১-৪৮১০৮৬।