Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ

খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ
ড. মোহাম্মদ আফজাল হোসাইন
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রয়োজন একটি লাভজনক, টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব কৃষিব্যবস্থা। টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা অতীব জরুরি। বর্ধিত ফসল উৎপাদন করার জন্য প্রয়োজন উচ্চফলনশীল জাত, উন্নত ফসল ব্যবস্থাপনা এবং একক জমিতে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি করা। ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি করা ও উন্নত ফসল ব্যবস্থাপনার একটি অঙ্গ হচ্ছে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, ফসলের উৎপাদন খরচ ও ফসল কর্তনোত্তর ক্ষতি কমানোর মাধ্যমে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
শ্রমিক স্বল্পতার কারণে ফসল আবাদে বাড়ছে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার। বদলে যাচ্ছে কৃষির দৃশ্যপট। গ্রামীণ কৃষি পরিণত হচ্ছে এক আধুনিক কৃষিতে। এখন জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে ধান কাটা মাড়াই, ঝাড়া ও শুকানো সবই হচ্ছে যন্ত্রের মাধ্যমে। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কৃষি প্রবেশ করেছে যান্ত্রিক যুগে। এতে শুধু ফসল উৎপাদনের ব্যয়ই কমছে না, কমছে ফসল ঘরে তোলার সময়ও। সময়মতো ফসল সংগ্রহ করার ফলে হ্রাস পাচ্ছে সংগ্রহোত্তর ক্ষতি। সাশ্রয় হচ্ছে কৃষকের সময়ও। হ্রাস পাচ্ছে কৃষকের কায়িক শ্রম। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাচ্ছে ফসল। সংগ্রহোত্তর অপচয় হ্রাস পাওয়ায় বেশি ফসল পাচ্ছে কৃষক। উৎপাদন খরচ কমে যাওয়ায় কৃষকের লাভের পরিমাণ বাড়ছে। যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে খোরপোশের কৃষি পরিণত হচ্ছে আধুনিক ও বাণিজ্যিক কৃষিতে।
গবেষণায় দেখা গেছে, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের মাধ্যমে ঘণ্টায় ২.৫ বিঘা জমিতে ধান রোপণ করা যায়। এতে কৃষকের শ্রমিক, সময় ও অর্থের সাশ্রয় হয়। চারা রোপণে যন্ত্রটি ব্যবহার করলে রোপণ খরচ ৫০ থেকে ৭৫ ভাগ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার দিয়ে ঘণ্টায় চার বিঘা জমির ধান কাটা যাচ্ছে। চাষাবাদ থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত সবখানেই যন্ত্র তাদের সাহায্য করছে। বর্তমানে দেশে  জমি চাষ, আগাছা দমন, কীটনাশক প্রয়োগ, সেচ এবং ফসল মাড়াই এর কাজে যথাক্রমে শতকরা ৯০, ৬৫, ৮০, ৯৫ এবং ৭০ ভাগ যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব হয়েছে। কৃষির উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনতে যান্ত্রিকীকরণের প্রসার ঘটাতে হবে। এতে কম খরচে চাষাবাদ করা যাবে। ধান কাটা যাবেও কম খরচে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে কেন্দ্র করে একটি উদ্যোক্তা শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যাদের হয়তো কোনো জমি নেই। কিন্তু তারা যন্ত্র কিনে প্রান্তিক কৃষকদের সেবা দিচ্ছে। এভাবে একটি সার্ভিস মডেল তৈরি হয়েছে। ফলে কৃষক যন্ত্র না কিনেও ভাড়া দিয়ে যান্ত্রিক সেবা নিতে পারছে। এতে প্রথাগত পদ্ধতির চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ কম খরচ পড়ছে। ফলে তাদের উৎপাদন ব্যয়ও কম পড়ছে। আবার উৎপাদন-পরবর্তী ফসলের ক্ষতি কমে আসছে যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে। যেমন হাতে ধান কাটলে ১০-১৫ শতাংশ ফলন নষ্ট হয়। কিন্তু হারভেস্টার দিয়ে কাটলে এটা ২-৩ শতাংশে নেমে আসে। এতে  কৃষক ধান বেশি পাচ্ছে। আবার হাওর এলাকায় আক¯িœক বন্যার কারণে কম সময়ে দ্রুত ধান কাটতে হয়, যা হারভেস্টার দিয়ে করা যায়। কিন্তু একটা কম্বাইন হারেভেস্টারের দাম হয়তো ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু কৃষক অনেক সময় এটা কেনার সামর্থ্য রাখেন না। তাই অল্প ভাড়া দিয়ে তারা এটার সেবা নিতে পারেন।
দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর বিপরীতে কমছে কৃষি জমি। এছাড়াও কৃষি শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান হারে শিল্প, পরিবহন, নির্মাণ ও অন্যান্য খাতে স্থানান্তরের ফলে কৃষিতে নিয়োজিত শ্রমশক্তি ৪৫.৪ শতাংশ (শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২)। ২০৩০ সাল নাগাদ তা কমে ২০ শতাংশ হবে। ফলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ছাড়া আর বিকল্প নেই। এছাড়াও জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে আকস্মিক বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মত দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ। এর ফলে শস্যহানির ঝুঁকি বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এ সকল সমস্যা উত্তরণে দেশে খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ অপরিহার্য।
কৃষিযন্ত্রের কার্যকরী ব্যবহার নিশ্চিতকরণে নি¤েœাক্ত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন 
 কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সকল কৃষককে পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ প্রদান 
 মাঠ প্রদর্শনী আয়োজনের মাধ্যমে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা;
 মেকানিককে কৃষি যন্ত্রপাতি মেরামতের উপর প্রশিক্ষণ দেয়া। সেই সাথে কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারকদেরও মানসম্পন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া;
 চারা রোপণ, সার প্রয়োগ, ফসল কর্তন, ফসল ঝাড়াই, ফসল শুকানো ও গুদামজাতকরণের ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ;
 কৃষিযন্ত্র ও প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে কৃষি প্রকৌশলীদের জন্য আলাদা উইং তৈরি করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণ ও ভৌত সুবিধা বৃদ্ধি করা। একই সাথে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে কৃষি প্রকৌশলীদের পরিমাণ এবং সক্ষমতা  বৃদ্ধি করে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা;
 কৃষক, চালক, মেকানিক, সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, প্রস্তুতকারী, গবেষক, সম্প্রসারণ কর্মী ও নীতি নির্ধারকদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে        কৃষিযন্ত্র ব্যবহার ও উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি করা;
 কৃষিযন্ত্র সেবা প্রদানকারী উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি চালু করা;
 জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষকের মালিকানাধীন জমি ক্রমশ: খ- খ- হয়ে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছে। পূর্ণ দক্ষতায় কৃষিযন্ত্র ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে নানাবিধ ও স্থানীয় উপযোগী কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে চাষযোগ্য জমির সমন্বয়, ফসলের সমন্বিত বপন ও কর্তন করা;
 যেসব এলাকায় ভূগর্ভস্থ ও ভূপরিস্থ সেচ পানির অপর্যাপ্ততা রয়েছে এবং বিভিন্ন কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে সেসব এলাকায় সমন্বিতভাবে সেচ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা;
 দেশের কৃষি জমিতে আধুনিক কৃষিযন্ত্র চলাচলের জন্য সমন্বিতভাবে সরকারি বা ব্যক্তি উদ্যোগে টেকসই রাস্তা তৈরি করা;
 দেশীয় কৃষিযন্ত্র প্রস্তুতকরণ শিল্প স্থাপনকারীদের এবং মাঠ পর্যায়ের যন্ত্র ক্রয়কারী কৃষক/উদ্যোক্তাদের সহজশর্তে ও সরকারি বিশেষ সুবিধার আওতায় ঋণ প্রদান করা।
 নিরাপদ কৃষিযন্ত্র চালনার জন্য প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স প্রদানের ব্যবস্থা করা।
 যন্ত্রনির্ভর আধুনিক ও ঝুঁকিমুক্ত পেশা হিসাবে গড়ে তুলতে কৃষিযন্ত্রের সংশ্লিষ্ট চালক, কৃষিযন্ত্র সেবাপ্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বীমা চালু করা।
উল্লেখিত কর্মকৌশল যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ত্বরান্বিত হবে। কৃষি ক্ষেত্রে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জসমুহ মোকাবিলা করে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনসহ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সম্ভব হবে।
 
লেখক :  প্রধান, মেশিনারি মেইনটেন্যান্স বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর ১৭০১। মোবাইল : ০১৫৫৮-৩৫৬৬৭২,