Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রভাব সচেতনতা বৃদ্ধি এবং চ্যালেঞ্জ

মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রভাব সচেতনতা বৃদ্ধি এবং চ্যালেঞ্জ
ড. যাকীয়াহ রহমান মনি১   মোঃ মাহফুজুর রহমান২
মাইক্রোপ্লাস্টিক হলো প্লাস্টিকের ৫ মিলিমিটারের চেয়ে ছোট অতিক্ষুদ্র কণা। বৈশ্বিক পরিবেশে বর্তমানে মাইক্রোপ্লাস্টিক একটি জটিল সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা মূলত প্লাস্টিক পণ্যগুলোর ক্ষয় প্রাপ্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন উৎস থেকে এগুলো পরিবেশে প্রবেশ করে এবং একবার পরিবেশে প্রবেশ করার পর তা অপসারণ করা অত্যন্ত কঠিন। সমুদ্রে, স্থলভাগে এমনকি বাতাসেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে, যা জীববৈচিত্র্যে, মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। 
মাইক্রোপ্লাস্টিকের উৎস
মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রধান উৎস দুই ধরনের: প্রাথমিক এবং গৌণ। প্রাথমিক উৎসের মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো সরাসরি পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন: প্রসাধনী, পণ্য তৈরির শিল্পে ব্যবহৃত পলিমার কণা। গৌণ উৎসের মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো বৃহৎ প্লাস্টিকের জিনিসপত্র যেমন: বোতল, ব্যাগ, ফিশিং নেট ইত্যাদি ক্ষয় হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। অতিবেগুনী রশ্মি, সমুদ্রের তরঙ্গ এবং বায়ু দ্বারা প্লাস্টিকের ভাঙন ত্বরান্বিত হয়।
মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রধান উৎস হলো প্লাস্টিক বর্জ্য। প্লাস্টিক বর্জ্য ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয়। এর কারণগুলো হলো: প্লাস্টিক সূর্যের আলো পেলে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। বৃষ্টি, বাতাস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক ঘটনায় প্লাস্টিক ধীরে ধীরে ভেঙে যায় যা অবশেষে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়ে নীরব ঘাতক হিসেবে রূপ নেয়। (ঈড়ষব.গ.বঃধষ.২০১১)
এ ছাড়াও বিভিন্ন প্লাস্টিক জাতীয় জিনিসপত্র তৈরির সময় যন্ত্রের প্রভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সৃষ্টি হয় যা দৃষ্টিগোচর হয় না। কিছু মাইক্রোপ্লাস্টিক সরাসরি পরিবেশে প্রবেশ করে যেমন- স্ক্রাব বা অন্যান্য প্রসাধনী পণ্যে থাকা ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা, সিন্থেটিক কাপড় ধোয়ার সময় বের হওয়া ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা এবং কারখানার বর্জ্যের মাধ্যমে সরাসরি পরিবেশে মাইক্রোপ্লাস্টিক নির্গত হচ্ছে। এই প্লাস্টিক কণা অপচনশীল হওয়ায় দীর্ঘদিন পরিবেশে টিকে থাকতে পারে (এবুবৎ.জ.বঃধষ ২০১৭)। অবশেষে সমুদ্র ও মাটিতে  পৌঁছে, যার ফলে সমূদ্র, পুকুর বা অন্যান্য জলাশয়ের পানি মাইক্রোপ্লাস্টিক দ্বারা দূষিত হয় এবং সামুদ্রিক প্রাণীরা এই মাইক্রোপ্লাস্টিক খেয়ে ফেলে এভাবে মানুষ পরোক্ষভাবে এই দূষিত খাদ্য ও পানি গ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মানবদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশের বিভিন্ন উৎস চক্র 
 সামুদ্রিক প্রাণী যেমন মাছ, শামুক, কাকড়া এবং তাদের খাদ্যের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করে। এই প্রাণীগুলো মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
 সামুদ্রিক লবণেও প্রায়ই মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায়, যা মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য চক্রে যুক্ত হয়।
 খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশের পর সেগুলো রক্ত সংবহন তন্ত্রের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা শরীরের বিভিন্ন অংশে, যেমন-ফুসফুস বা অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পৌঁছাতে পারে।
 দীর্ঘমেয়াদে এই কণা ফুসফুসে জমা হতে পারে এবং শ^াসতন্ত্রে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
 মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা ফুসফুসের টিস্যুতে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এটি শ^াসকষ্ট, ক্রনিক ব্রংকাইটিস এবং দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুসের রোগ যেমন অ্যাজমা বা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিবেশেগত প্রভাব
মাইক্রোপ্লাস্টিক সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের ওপর বিভিন্নভাবে পরিবেশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। সামুদ্রিক প্রাণীরা মাইক্রোপ্লাস্টিক খাওয়ার কারণে তাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটে এবং অনেকক্ষেত্রে মৃত্যুও ঘটে। এ ছাড়া মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে মাটি এবং মিঠাপানির গুণগত মানও কমে যায়। পরিবেশের এই অবক্ষয়ের কারণে কৃষি উৎপাদন, মিঠাপানির সরবরাহ এবং খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন।
মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব
মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর বেশ কিছু প্রভাব দেখা দিয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, সমুদ্রের মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। টক্সিকোলজিক্যাল সায়েন্সের জার্নালে ১৭ ফেব্রুয়ারি (২০২৪) প্রকাশিত একটি সমীক্ষায়, ইউএনএম ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্সের বিভাগের রিজেন্টস প্রফেসর ম্যাথিউ ক্যাম্পেনের একটি গবেষণায় ৬২টি প্লাসেন্টা নমুনা পরীক্ষা করে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়ার কথা জানিয়েছে। যার ঘনমাত্রা প্রতি গ্রাম টিস্যুতে ৬.৫ থেকে ৭৯০ মাইক্রেগ্রাম। এ ছাড়াও তিনি পরিবেশের কিছু মাইক্রোপ্লাস্টিকের ওপর গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন সেগুলো ৪০ থেকে ৫০ বছর ধরে পরিবেশে অক্ষত অবস্থায় আছে। যা খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারসহ অন্যান্য গুরুতর রোগের ঝুঁকিও বেড়ে যেতে পারে যথাঃ
শ্বাসযন্ত্রের ক্ষতি : বাতাসের সাথে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে, যা শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তন : মাইক্রোপ্লাস্টিক খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করতে পারে, যা মানুষের খাদ্যে পৌঁছায়। এর ফলে, প্লাস্টিকের বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদানগুলো শরীরে প্রবেশ করার ফলে জিনগত বিরূপ প্রভাবের ফলে জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা : কিছু মাইক্রোপ্লাস্টিক কণায় বিষাক্ত জটিল রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা মানুষের হরমোনের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে। এটা প্রজনন ক্ষমতায় সমস্যা এবং অন্যান্য হরমোন-সংক্রান্ত অসুখের কারণ হতে পারে।
পরিপাকতন্ত্রের ক্ষতি : মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা খাওয়ার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে তা পরিপাকতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে। এটি অন্ত্রের প্রদাহ, আলসার এবং পরিপাকতন্ত্রের অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রভাব : মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে স্নায়ুতন্ত্রে ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে, যা মানসিক অসুস্থতা এবং স্নায়বিক ব্যাধির ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। (ঞযড়সঢ়ংড়হ বঃফ.ধষ.২০০৯)
মাইক্রোপ্লাস্টিক রোধে প্রচেষ্টা ও সচেতনতার গুরুত্ব
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মাইক্রোপ্লাস্টিক রোধে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০১৫ সালে কসমেটিক্সে মাইক্রোপ্লাস্টিক নিষিদ্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘মাইক্রোবিড-ফ্রি ওয়াটার অ্যাক্ট ২০১৫’ অনুযায়ী মাইক্রোবিড সমৃদ্ধ প্রসাধনী উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান মাইক্রোপ্লাস্টিক সংগ্রহ এবং পুনর্ব্যবহারের জন্য নতুন প্রযুক্তি উন্নয়নের চেষ্টা করছে। পরিবেশবাদী সংস্থাগুলো মাইক্রোপ্লাস্টিকের ব্যবহার হ্রাসের জন্য প্রচারাভিযান চালাচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থায় মাইক্রোপ্লাস্টিক সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান, স্থানীয় পর্যায়ে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। (টঘঊচ, ২০১৬)
মাইক্রোপ্লাস্টিক সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। যদি সাধারণ মানুষ মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হয়, তবে তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ কমাতে পারে এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহার করতে উৎসাহী হতে পারে। প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিকল্প পণ্যের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে, মাইক্রোপ্লাস্টিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। যেমন- বিকল্প হিসেবে বর্তমানে দেশের তৈরি সোনালি ব্যাগ ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা। সোনালি ব্যাগ হলো পাট থেকে তৈরি এক ধরনের পলিথিনের বিকল্প ব্যাগ, যা পরিবেশবান্ধব এবং বায়োডিগ্রেডেবল। এটি মূলত সেলুলোজ-ভিত্তিক এক ধরনের বায়োপ্লাস্টিক, যা পরিবেশবান্ধব বলে প্রচলিত প্লাস্টিক ব্যাগের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। পাট থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই সেলুলোজ সংগ্রহ করা হয় এবং যেহেতু পাট পৃথিবীর অন্যতম প্রধান আঁশজাতীয় ফসল, তাই এটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব একটি সমাধান হিসেবে বিবেচিত। তবে বিশ্ব এখন প্রতিনিয়ত প্রযুক্তির হাত ধরে এগিয়ে চলছে, পরিবেশকে টিকে রাখার জন্য গবেষণাগারে চলছে নিত্য নতুন উদ্ভাবন, সম্প্রতি (২ জানুয়ারি ২০২৪, প্রকাশিত) ইন্টারন্যাশনাল  জার্নাল অব মলিকিউলার সায়েন্স এর একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বিভিন্ন প্রকার সামদ্রিক পরিবেশে টিকে থাকা ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে যে, তাদের মধ্যে প্লাস্টিক ডিগ্রেডেবল বা বিনষ্ট করার সক্ষমতা পাওয়া গেছে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক একটি বৈশ্বিক সমস্যা যা পরিবেশ এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা এই সমস্যার সমাধান করতে পারি। ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং সরকারি পর্যায়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি পরিষ্কার ও সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।  
 
লেখক : ১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পুষ্টি ইউনিট), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। ই-মেইল :zakiah@barc.gov.bd মোবাইল : ০১৭১২৬৩৪৩৫২ ২এক্সিকিউটিভ (পুষ্টিবিদ), রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্ট, আকিজ ফুড এন্ড বেভারেজ, বারোবাড়িয়া, ধামরাই, ঢাকা।