মাছ চাষে উকুনের আক্রমণ
ও প্রতিকার
মোঃ তোফাজউদ্দিন আহম্মেদ
মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য আজ বিশ্ব পরিম-লে স্বীকৃত। বর্তমানে চাষের অধীনে পুকুরের মাছের গড় উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ৬ টনে হলেও অনেক এলাকায় এ উৎপাদন ১০ টনেরও বেশি। দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে প্রতি নিয়ত, সাথে বাড়ছে মাছের চাহিদা, ফলে চাষি তার পুকুরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সকল কলাকৌশল অবলম্বন করছে সাথে যুক্ত হয়েছে নানা পদ্ধতির মাছচাষ, চাষে ব্যবহার হচ্ছে নানা ধরনের উপকরণ (অয়ঁধ ওহঢ়ঁঃং) এবং যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার। সার্বিকভাবে মাছ চাষে নানা প্রজাতির মাছের সংযোজনের পাশাপাশি চাষ প্রযুক্তিতে এসেছে অনেক পরিবর্তন। চাষের নিবিড়তা বাড়ার সাথে সাথে মাছচাষে উদ্ভব হচ্ছে নানা ধরনের সমস্যা। পুকুরের পানির পরিবেশ সংকটের পাশাপাশি মাছে দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের রোগব্যাধির। সময় মতো ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে চাষি হচ্ছেন বেশ ক্ষতিগ্রস্ত। মাছচাষে যে রোগটির প্রকটতা ও ব্যাপকতা বেশি তার মধ্যে অন্যতম চাষের মাছে উকুন আক্রান্ত হওয়া। বর্তমানে মাছ চাষে মাছের উকুন তথা বহিঃপরজীবীর (ঊপঃড়-চধৎরংঃব) আক্রমণ হয়ে চাষের মাছকে ব্যাপক ক্ষতি করছে। মাছের উকুন একটি উপর নিচে চ্যাপ্টা, স্বচ্ছ, সন্ধিপদি প্রাণী। এদের দু’টি রূপ দেখা যায়। একটি পরিপক্ব এবং ডিম অবস্থা। পরিপক্ব অবস্থায় এরা বেশি ক্ষতিকর ভূমিকা নেয়। সাধারণত উকুন দ্বারা রুই মাছ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে যখন খুব বেশি আকারে এ সমস্যা দেখা দেয় তখন কালবাউশ, কার্পিও ও মৃগেল মাছের এ সমস্যা দেখা দেয়।
চাষের মাছে উকুন সংক্রমণের লক্ষণ
মাছ অস্বাভাবিকভাবে চলাচল করবে, অনেক সময় পুকুরের কিনারে ধীরে চলাচল করতে দেখা যায়।
মাছ লেজের আগার অংশ পানির উপরে ভাসিয়ে দিয়ে ধীরে সাঁতার কাটে।
পুকুরের উপরের স্তরে এসে ঝাক বেধে সাঁতার কাটবে, মাঝেমধ্যে ঝাঁকি ঝাল ফেলার মতো শব্দ তৈরি করবে।
মাছ হঠাৎ হঠাৎ পানির উপরে লাফ দিবে।
যে কোন অবলম্বনের সাথে গাঁ ঘসবে।
আক্রান্ত মাছ পুষ্টি হীনতায় কৃষকায় হয়ে যাবে, মরা মাছের গায়ে অনেক উকুন দেখা যাবে।
উকুন দ্বারা আক্রান্ত হলে চাষের মাছের ক্ষতির ধরন
মাছ খাবার খাওয়া কমিয়ে দেয়ায় মাছের স্বাভাবিক বর্ধন বিঘিœত হবে।
মাছ পিড়ন অবস্থার শিকার হবে, দূর্বল হয়ে যাবে, রুগ্ন দেখাবে।
উকুন দ্বারা সৃষ্ট ক্ষত স্থানে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ ঘটবে।
মাছ রোগে আক্রান্ত হবে, গায়ে লাল ছোপ দেখা দিতে পারে।
অধিক আক্রান্ত মাছ স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে মারা যেতে পারে।
হ্যাচারির মাছে উকুন আক্রান্ত হলে ক্ষতির ধরন
কার্পজাতীয় মাছের হ্যাচারিতে রেণু উৎপাদন মৌসুমে কোন কোন পুকুরে ব্রুড মাছ ধরার জন্য প্রায় প্রতিদিন জাল টান দেয়া হয়। ফলে ঐসব পুকুরের ব্রুড মাছের গায়ে যে শ্লাইম থাকে তা অপসারিত হয় ফলে মাছের শরীরের রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে ব্রুড মাছগুলো উকুন দ্বারা আক্রান্ত হয়। উকুনের কারণে হ্যাচারির মাছে আরো বেশ কিছু ক্ষতি হয়ে থাকে যেগুলো হলো :
হ্যাচারির মাছ উকুন দ্বারা আক্রান্ত হলে হ্যাচারির সর্বিক উৎপাদন ব্যাহত হবে।
বিশেষ করে রুই মাছে ডিম দেরিতে আসবে, ডিম আসলেও ডিমে পুষ্টির অভাব ঘটবে।
পুরুষ মাছে শুক্রাণু আসতে দেরি হবে, পাতলা হবে এবং পরিমাণে কমে যাবে।
দুর্বল রেণু (জীবনী শক্তি কম) উৎপাদন হবে এবং রেণু থেকে পোনা উৎপাদন হার কম হবে।
এ ধরনের ব্রুড মাছ থেকে উৎপাদিত পোনা দুর্বল হবে এবং বর্ধন হারও কম হবে।
চাষের পুকুরে উকুন আক্রমণের কারণ
মাছ চাষ ব্যবস্থাপনা ভালো না হওয়ার কারণেই পুকুরে মাছে উকুন সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় মাছের খাদ্য খরচ কমাতে গিয়ে, পুকুরে প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদনে অনেক চাষি অসতর্কতা মূলকভাবে এমন কিছু ক্ষতিকর উপকরণ ব্যবহার করেন যার জন্য চাষের পুকুরের মাছে উকুন সমস্যা দেখা দেয়। প্রধানত যে সব কারণে চাষের মাছে উকুন সমস্যা দেখা দেয় তার প্রধান কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হলো :
পুকুরের জৈব পদার্থ বেড়ে গেলে : পুকুরে নানা কারণে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। যেমন- সরিষার খৈল ২-৩ দিন ভিজিয়ে রেখে পুকুরে প্রয়োগ করলে; গোবর বা মুরগীর পায়খানা পুকুরে প্রয়োগ করলে; পুকুরে পচনশীল আগাছা অধিক জন্মালে; খাদ্য বেশি দিলে অভূক্ত খাদ্য পচে জৈব পদার্থের আধিক্য বাড়িয়ে দিতে পারে; খাদ্য ২-৩ দিন ভিজিয়ে প্রয়োগ করলে; অধিক দিন ধরে গাজনকৃত খাদ্য বা ঘনঘন গাজনকৃত খাদ্য প্রয়োগ করলে; প্লাংটন উৎপাদনের জন্য বারবার বা বেশি দিন ভিজিয়ে জুস (প্রিবায়টিক্স) ব্যবহার করলে; ইউরিয়া সার এর সাথে আটা, কুড়া কয়েকদিন ভিজিয়ে প্রয়োগ করলে; মুরগীর নাড়িভূড়িসহ উচ্ছিষ্ট খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করলে পুুকরে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। পোনা পটাশ কিংবা লবণ পানিতে শোধন না করে ছাড়লে; উকুন আক্রান্ত পুকুরে জাল টেনে সে ভিজা জাল পুকুরে নামালে; পুকুরে শক্ত অবলম্বন থাকলে (বাঁশ, ইট, পাকা ওয়াল, পাকা ঘাটলা, কাঠ, পাড়ে জিওটেক্স, লাইনার); অধিক ঘনত্বে মাছচাষ করলে; বারবার জাল দিলে মাছের শরীরের শ্লাইম উঠে যাওয়ায় উকুনের আক্রমণ ঘটে; মাছ দীর্ঘ দিন অপুষ্টিতে ভুগলে।
উকুন সমস্যা প্রতিকারে করণীয়
চাষের পুকুরে উকুন সমস্যা দেখা দেবার সাথে সাথে যদিও আক্রান্ত মাছ মারা যায় না, তথাপি সমস্যা প্রতিকারের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশে উকুন সমস্যা সমাধানে প্রচলিত প্রতিকার ব্যবস্থা জনস্বাস্থ্য সম্মত নয় এ জন্য উকুন সমস্যা যাতে পুকুরে না দেখা দেয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ সর্বোত্তম। প্রতিকারের উপায়গুলো নিম্নরূপ-
পরিবেশ সম্মত প্রতিকার ব্যবস্থা : আক্রান্ত মাছ ধরে ১০% খাদ্য লবণ অথবা ০.১% পটাশিয়াম পারমেঙ্গানেট দ্রবণে গোসল করাতে হবে। তাহলে মাছের উকুন শরীর থেকে সরে যাবে। কিন্তু পুকুরের সকল আক্রান্ত মাছ ধরে এভাবে গোসল দেয়া অনেক সময় বাস্তবে সম্ভব হয় না।
কীটনাশক প্রয়োগ : উকুন সমস্যা সমাধানে বহু অনুসরণীয় পদ্ধতি হলো বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ। চাষের পুকুরে উকুন সমস্যা এতো প্রকট যে, প্রতি বছর হাজার হাজার লিটার কীটনাশক বা ওষুধ এ রোগ প্রতিকারে ব্যবহার হয়ে থাকে। এ জন্য দেশের প্রায় সব একোয়ামেডিসিন বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বাণিজ্যিক নামে এ সমস্যা সমাধানের ওষুধ আছে। তবে এ মেডিসিনগুলো মাত্র কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত। যে বাণিজ্যিক নামের ওষুধ বিক্রয় হোক না কেন মাছ চাষিকে দেখতে হবে ওষুধটি কোন গ্রুপে অন্তর্ভূক্ত। উৎপাদন বা বাজারজাতকরণ কোম্পানির নির্দেশনা অনুযায়ী ঔষধ ব্যবহার করা উত্তম। কীটনাশকের গ্রুপ নাম অনুযায়ী ব্যবহারের মাত্রা সারণি দ্রষ্টব্য। উকুনের উপদ্রব মাত্রা কম হলে আমরা প্রাথমিকভাবে আইভারমেকটিন বা সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের ওষুধ ব্যবহার করব। তাতেও কাজ না হলে ডেল্টামেথ্রিন গ্রুপের ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। কারণ ডেল্টামেথ্রিন গ্রুপের ওষুধের ক্ষতিকর প্রভাব বেশি পারত পক্ষে এ ধরনের কীটনাশক পুকুরে ব্যবহার না করায় ভালো। উকুন সমস্যা হলে যে কোন কীটনাশকের ৩টি ডোজ ব্যবহার করতে হবে। ৭ দিন অন্তর এ ডোজ প্রয়োগ করতে হবে। কারণ ঔষধ প্রয়োগ করলে উকুনের পরিপক্ব গুলো মারা যাবে কিন্তু উকুনের ডিম মারা যাবে না। এ ডিম ২-৩ দিন এর মধ্যে ফুটে নতুন বাচ্চা উৎপাদন করবে এবং তারা মাছকে নতুনভাবে আক্রমণ করবে। এ জন্য পরপর ৩টি ডোজ প্রয়োগ না করলে উকুন সমস্যা সম্পূর্ণভাবে দূর হবে না।
পুকুরে ঔষধ প্রয়োগ পদ্ধতি ও সতর্কতা
চাষের পুকুরে উকুন সমস্যা দূর করার জন্য মানুষের জন্য ক্ষতিকর কীটনাশক (বিষ) প্রযোগ করা হয় এ জন্য এ ওষুধ পুকুরে প্রয়োগ করার সময় কারো শরীরে ক্ষত থাকলে তিনি প্রয়োগ করতে পারবেন না। প্রয়োগকারীর চোখে মুখে যাতে এ কীটনাশক প্রবেশ করতে না পারে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। বাতাসের অনুকূলে ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনীয় ওষুধ পর্যাপ্ত পানির সাথে মিশাতে হবে যাতে পুকুরের সকল স্থানে সমভাবে ছিটিয়ে দেয়া যায়। ওষুধ দিনের ১১-১২ ঘটিকার সময় বিশেষ করে পুকুরের পানিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন থাকার সময় ব্যবহার করতে হবে। কারণ এ ঔষধ ব্যবহার করলে পুকুরে বিদ্যমান অক্সিজেন ব্যবহৃত হয়। এ জন্য ঔষধ প্রয়োগের দিন রাত্রে পুকুরে অক্সিজেন ঘাটতি হতে পারে। সে জন্য রাত্রে উদ্ভূত সমস্যা প্রতিকারের জন্য বাড়তি ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রয়োগকৃত ওষুধ একটি বিষ, যার পরিমাণ বেশি হলে মাছ মারা যেতে পারে। এ জন্য পুকুরের পরিমাপ এবং গভীরতা সতর্কতার সাথে নির্ণয় করতে হবে। পুুকুরে চিংড়ি মাছ থাকলে আইভারমেকটিন ১ ইসি ছাড়া অন্য গ্রুপের ঔষধ ব্যবহার করা যাবে না। চিংড়িও একটি সন্ধিপদি প্রাণী এবং উকুনের সমগোত্রীয় হওয়ায় চিংড়ি মারা যাবে। উকুন দূর করার জন্য ওষুধ প্রয়োগের পাশাপাশি একই দিনে পুকুরে পটাশিয়াম পারমেঙ্গানেট দিতে হবে (বিঘাতে ৪ ফট গভীরতার জন্য ১৫০ গ্রাম) যাতে ক্ষত স্থানে ঘাঁ না হতে পারে। এ সময় খাদ্যের সাথে ভালো মানের ভিটামির সি (৫ গ্রাম/কেজি) খাওয়াতে হবে। উল্লেখ থাকে যে, ভিটামিন সি ক্ষত স্থান দ্রুত শুকাতে সাহায্য করে। মনে রাখতে হবে উকুননাশক পুকুরে প্রয়োগ করলে, সে পুকুরের মাছ কম পক্ষে ২৫ দিন পরে বাজারে নেয়া যাতে কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব দূর হয়।
মাছচাষের পুকুরে উকুন সমস্যা সমাধানে প্রতিরোধ ব্যবস্থা
মাছচাষের পুকরে নির্দিষ্ট সময় অন্তর বিশেষ করে প্রতি ১-২ মাস অন্তর শতকে ২০০-৩০০ গ্রাম হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
মাছচাষের পুুকরের পানিতে দূষণ ঘটলে আংশিক পানি পরিবর্তন করতে হবে।
যে যে কারণে পুকুরে পচনশীল জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় সে কাজগুলো পরিহার করতে হবে।
মাছকে পুষ্টিকর খাবার প্রদান করা।
পুকুরের সর্বিক পরিবেশ ভালো রাখার চেষ্টা করতে হবে।
মাঝে মধ্যে প্রবায়টিক্স প্রয়োগ করা, পুকুরে নিয়মিত হররা টানা।
পুকুর শুকিয়ে প্রস্তুত করা এবং নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় উপ-পরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর। বাসা ১৭৩/১ শাপলা হাউজিং, আগারগাঁও, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৫১৯৩৯৯৩২, ই-মেইল :tofaz2010@gmail.com