Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বন্যায় কৃষি ক্ষতি ও উত্তোরণে করণীয়

 বন্যায় কৃষি ক্ষতি ও উত্তোরণে করণীয়
ড. মো. জামাল উদ্দিন
আমাদের দেশে ভৌগোলিক অবস্থান জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়।  এসব দুর্যাগের মধ্যে বন্যা অন্যতম। দেশের ইতিহাসে গত বছর ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক ও আকস্মিক বন্যায় মানুষের ঘরবাড়ি, মুরগীর খামার, প্রাণিসম্পদ, বীজতলা ও ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে অবর্ণনীয়ভাবে। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, বাংলাদেশে এবারের বন্যা চলতি বছরে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন-সংশ্লিষ্ট চতুর্থ বড় দুর্যোগ। এ দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে। 
জাতীয় ইংরেজী দৈনিক দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র উল্লেখপূর্বক ১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রি. তারিখের প্রতিবেদন মতে, গত বছরে বন্যায় দেশের ২৩ জেলায় ৩,৩৪৬ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে এবং ১৪.১৪ লাখেরও বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদন মতে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির হিসাব অনুযায়ী-আউশ, আমন ধান, শাকসবজি, আদা, হলুদ, ফলবাগান, মরিচ, পান, তরমুজ, পেঁপে, টমেটোসহ বিভিন্ন ফসলের ৯ লাখ ৮৬ হাজার ২১৪ মেট্রিক টন ফসলের উৎপাদন একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে বলে উক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে  আমন ধান (৪.১২ লাখ মেট্রিক টন) ও এর বীজতলা। উহা যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা থেকে ৬ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন ধান পাওয়া যেত, যা পুরোপুরিই নষ্ট হয়ে গেছে। এর বাইরে প্রায় ১ লাখ সাড়ে ৬ হাজার মেট্রিক টন আউশ ধানের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে। সবমিলিয়ে ২ হাজার ৫১৯ কোটি টাকার ধানের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে। 
ক্ষতির তালিকায় আমন-আউশ ধানের পরই রয়েছে শাকসবজি। বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি উৎপাদনের ১ লাখ ৭৬ হাজার মেট্রিক টন নষ্ট হয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। উক্ত প্রতিবেদন মতে, ২০ কোটি টাকা মূল্যের আদা, ১১ কোটি টাকার হলুদ, ১৭ কোটি টাকার আখ, ৪০ কোটি টাকার পান, কলাসহ অন্যান্য ফলের ৩১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। মৎস ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর হিসাব মতে, বন্যায় মাছ, মাছ চাষের অবকাঠামো এবং লাইভস্টক সেক্টরের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। শুধু কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফেনী জেলায় চার হাজার পোল্ট্রি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দীপ্ত টেলিভিশনের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। 
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) তথ্য মতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পানি নেমে যাওয়ার পর যে এলাকায় যে ফসল উপযুক্ত তা স্থানীয় চাহিদা ও আর্থসামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনায় নিয়ে আবাদ করা উচিত। যেসব জমিতে আমন ধান আবাদ করা সম্ভব হবে না, সেখানে সব্জি ও মসলা জাতীয় ফসল দেওয়া যেতে পারে। তার জন্য বিভিন্ন উচ্চফলনশীল জাতসমূহের চারা/ বীজ বিনামূল্যে বিতরণের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত সহায়তা দিলে কৃষকদের ক্ষতি অনেকটা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। 
স্বল্পমেয়াদি আমন ধান, যেমন- বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রি ধান ৩৪, ব্রি ধান ৪৬সহ অন্যান্য উপযুক্ত জাত এলাকাভেদে বীজতলায় চারা উৎপাদন করে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোপণ করা যাবে। এছাড়াও বিনা ধান-৭, বিনাধান-১৭, বিনাধান-২২ জাতসমূহ উপযুক্ততা রয়েছে। এ ছাড়া মাসকলাই জাতীয় ফসল নরম মাটিতে বিনা চাষেই করা যেতে পারে। একইভাবে গিমা কলমি, ডাঁটা, পালং শাকসহ শীতকালীন আগাম সবজি  চাষ করা সম্ভব। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর গবাদিপশুর রোগবালাই বেড়ে যায়। রোগবালাই থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন। 
প্রতি বছরই এধরনের আকস্মিক ও অস্বাভাবিক বন্যার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই কৃষকদের আগাম সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে সরকারিভাবে বন্যার আগাম সতর্কবার্তা জারি করা এবং কৃষকদের করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করা; কৃষক সংগঠনের মাধ্যমে কৃষকদের করণীয়সমূহ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বন্যাপূর্বত্তোর ও বন্যাপরবর্তী করণীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান বিশেষ করে, ভাসমান বেডে বীজতলা তৈরির প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সম্পর্কে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাকরণ, কৃষকপর্যায়ে পর্যাপ্ত বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ বিষয়ে উৎসাহ ও সুযোগ সুবিধা প্রদান; আগাম ফসল আবাদ, মিশ্র বা আন্তঃফসলের আবাদ বৃদ্ধি এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় বীজ ও সহায়তা প্রদান; সবজি চাষাবাদের জন্য উঁচু এলাকা নির্বাচন এবং চাষাবাদে উদ্বুদ্ধকরণ; প্রতিটি কৃষক পরিববারে বীজ সংরক্ষণ করা জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারি সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি বীজ কোম্পানি কৃষকদের মানসম্মত বীজ সংরক্ষণে সহায়তা প্রদান করতে পারে; বন্যাপ্রবণ এলাকায় হাস-মুরগীর ও গবাদিপশুর স্থান নিরাপদ রাখা অথবা বন্যা পূর্বাভাসকে গুরুত্ব দেওয়া এবং সেমতে দ্রুততার সহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বন্যাপরবর্তী সময়ে বসতবাড়ি এলাকায় সমন্বিত খামার পদ্ধতি গড়ে তুলতে পারলে ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া কিছুটা হলেও সম্ভব হবে। এসব দুর্যোগ মোকাবেলায় কৃষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু অভিযোজন কৌশলসমূহ রপ্ত করার বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা গেলে সুফল মিলবে বেশ। নিচু এলাকার জন্য জলাবদ্ধতা সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন ও বিস্তার ঘটানো এবং আপৎকালীন সময়ে সারের মজুদ ও সরবরাহ নিশ্চিত রাখা জরুরি। পানি চলাচলের রাস্তায় প্লাস্টিক বর্জ্য না ফেলার জন্য উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা হিসাবে শস্যবীমা চালুকরণ; বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাওয়ার জন্য খাল, নালা দ্রুত সংস্কার জরুরি; কৃষিখাতে বণিক শ্রেণির এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর আন্তঃসম্পর্ক জোরদারকরণের মধ্য দিয়ে সমন্বিত কৃষি ব্যাবস্থপনা গড়ে তোলা গেলে বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে। 

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (গ্রেড-৪), সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বারি, কুমিল্লা। সাবেক ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট, এফএও- জাতিসংঘ। মোবাইল : ০১৮১৫৪২৫৮৫৭,  ই-মেইল : jamaluddin1971@yahoo.com