পানের রোগ ও দমন কৌশল
ড. মোঃ হাফিজুর রহমান
পান একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল। পান বহুবর্ষজীবী ডায়োসিয়াস লতানো জাতীয় উদ্ভিদ। ইহার পাতা বিভিন্ন আকৃতির তবে পাতা মোটামুটি ডিম্বাকার। পানের উৎপত্তিস্থল মালয়েশিয়া। সেখান থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করেছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠান- বিবাহ, জন্মদিন, সুন্নাতে খতনা প্রভৃতিতে পানের ব্যবহার হয়। অনেক সময় গল্পগুজবের ফাঁকে ফাঁকে পান খাওয়া আমাদের দেশের মানুষের সংস্কৃতি। পানে ভিটামিন, মিনারেলস, এ্যানজাইম, প্রোটিন ও অপরিহার্য তেল আছে। এ ছাড়া পানে লিভার ও হার্টের সুরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে। জেলাভেদে শীতকাল ব্যতীত বিভিন্ন ঋতুতে পান চাষ করা হয়। আমাদের দেশে ২০২২-২০২৩ সালে প্রায় ২২০৫৮ হেক্টর জমিতে ২১১৫৭০.২৭ মেট্রিক টন পান উৎপাদন হয়েছিল যার গড় ফলন ৯.৫৯ টন/হেক্টর। তবে ভাল পরিচর্যা করলে ১৮ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। প্রতি বছর কৃষকেরা পান চাষে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ সমস্যাগুলোর মধ্যে রোগবালাই অন্যতম। অনেকগুলো রোগ দ্বারা পান গাছ আক্রান্ত হয়ে থাকে। তন্মধ্যে পাতা পচা, ক্ষতরোগ, লতাপচা বা ঢলেপড়া, গোড়া পচা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পানের লতা ও পাতা পচা রোগ
এই রোগটি ফাইটোফথোরা প্যারাসাইটিকা (চযুঃড়ঢ়যঃযড়ৎধ ঢ়ধৎধংরঃরপধ) নামক ছত্রাক দ্বারা বিস্তার লাভ করে। সাধারণত বর্ষা মৌসুমে এ রোগের আক্রমণ বেড়ে যায়। অবিরত বৃষ্টিপাত হলে আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগ ক্রমে পাতা হতে বোঁটায় ও পরে গাছের লতায় সংক্রমিত হয় এবং ঐ সকল স্থানের মধ্যকার গ্রন্থি বিবর্ণ হয়ে যায়। রাত্রির তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রি সে. বা তার নিচে হলেও রোগের প্রকোপ বাড়ে। পাতা পচা রোগের কারণে ক্ষতির পরিমাণ ৩০-৪০% হতে পারে।
রোগের লক্ষণ : প্রথমে পাতার যে কোন অংশে পানি ভেজা হলুদাভ বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়; একবার সংক্রামিত হলে উপসর্গগুলো দ্রুত অগ্রসর হয়। প্রথমে পান পাতা গ্লেস (চকচকে ভাব) হারায় এবং হলুদ হয়; রোগটি অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে পাতাগুলো ভেতর থেকে পচে যায়; পাতায় ভেজা দাগ বা প্যাচ হিসাবে পচন দেখা দেয়; আক্রান্ত পাতা ও লতায় একপ্রকার কালো দাগ পড়ে। ঐ দাগের মাঝখানে বিবর্ণ হয়ে পচে যায়; রসাল কা- বাদামি ভঙ্গুর ও শুকিয়ে খড়ের মতো হয়; আক্রমণ বেশি হলে গাছ মারা যায়।
দমন ব্যবস্থপনা : পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করতে হবে; রোগাক্রান্ত পাতা তুলে পুড়িয়ে ফেলা; রোগমুক্ত লতা বীজ হিসাবে ব্যবহার করা; মে মাসের শুরু থেকে প্রতি ১৫ দিন অন্তর তিনবার ১% বর্দোমিক্সার/ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক/রিডোমিল গোল্ড এম জেড-৭২ ডব্লিউপি প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম হারে মিশিয়ে দিয়ে পানের গোড়ার মাটি এবং গাছ ভালভাবে স্প্রে করতে হবে; লতায় আক্রমণ দেখা দিলে রিভাস ২৫০ এসসি ছত্রাকনাশক ১.০ মিলি. প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছে ভালভাবে স্প্রে করে এ রোগ দমন করা যায়; প্রতিরোধী জাত (যেমন-বারি পান-৩) ব্যবহার করা যেতে পারে।
পাতার দাগ বা ক্ষত রোগ
এটি কোলেটোট্রিকাম পিপারিস (ঈড়ষষবঃড়ঃৎরপযঁস ঢ়রঢ়বৎরং) নামক ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়। বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকলে এ রোগ দ্রুত বাড়ে।
রোগের লক্ষণ : প্রথমে পাতায় উপরের দিকের অংশে বিক্ষিপ্ত ভাবে ছোট ছোট ফোস্কার মতো অসম দাগ পড়ে; দাগগুলো কিনারা থেকে ভেতরের দিকে বেশি দেখা যায়; আস্তে আস্তে দাগগুলো বড় হয় এবং একাধিক দাগ একত্র হয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে; ফলে শুকনা ক্ষতর সৃষ্টি হয় ও প্রতিটি দাগ হলুদ বলয় দ্বারা ঘেরা থাকে; ক্রমে দাগের মাঝখানটি শুকিয়ে যায় এবং সমগ্র পাতাটি নষ্ট হয়ে ঝরে পড়ে; এ রোগের কারণে পানের বাজারমূল্য কমে যায়।
দমনব্যবস্থা : আক্রান্ত পাতা তুলে ধ্বংস করতে হবে; নতুন বাগানের জন্য রোগমুক্ত লতা বীজ হিসাবে ব্যবহার; প্রতি ১০ দিন অন্তর তিনবার ০.৫% বর্দোমিক্সার/০.২% কপারঅক্সিক্লোরাইড/০.০৫% টিল্ট ২৫০ ইসি নামক ছত্রাকনাশক/০.২% রোভরাল নামক ছত্রাকনাশক এ হারে পানিতে মিশিয়ে দিয়ে গাছ ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
পানের কা- পচা/গোড়া পচা রোগ
এটি ক্লেরোসিয়াম রলফসি (ঝপষবৎড়ঃরঁস ৎড়ষভংরর) নামক ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই রোগ দেখা দিলে ১০০% পর্যন্ত ফলন বিঘিœত হতে পারে। মাটি ও সেচের পানির মাধ্যমে এটি বিস্তার লাভ করে। মাটিতে বেশি জৈবসার ও খরকুটো থাকলে এবং পানি সেচের মাধ্যমে আক্রান্ত ফসলের জমি হতে সুস্থ ফসলের মাঠে বিস্তার লাভ করে। আমাদের দেশে আগস্ট মাসের বৃষ্টির শেষের দিকে পান গাছে ব্যাপক পরিমাণে কা- ও গোড়াপচা রোগের লক্ষণ দেখা যায়। উচ্চ তাপমাত্রা ২৮-৩০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় রোগের প্রকোপ বেশি হয়।
রোগের লক্ষণ : জীবাণু প্রথমে গাছের গোড়ায় আক্রমণ করে; পরবর্তীতে লতার গোড়ার মাটির নিচের অংশ আক্রান্ত হয় এবং কালচে বাদামি হয়ে লতার গোড়ার দিকের একটি-দুটি মধ্যপর্ব পচে যায়; কখনো কখনো গ্রীষ্মকালে মাটির উপরের শায়িত লতায় এ রোগ হয়; রোগাক্রান্ত লতা এবং পাতা ধীরে ধীরে হলুদ হয়ে ঢলে পড়ে এবং গাছ মারা যায়; লতার পচা অংশে সাদা তুলার মতো লেগে থাকতে দেখা যায়। অনেক সময় গোড়ায় সরিষার দানার মতো ছোট ছোট দানা দেখা যায়; এ রোগের ফলে ক্ষেতের সমগ্র ফসল ব্যাপকভাবে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
দমনব্যবস্থা : পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ; মরা পচা গাছ শিকড়সহ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলা; নতুন বাগানের জন্য রোগমুক্ত লতা বীজ হিসাবে ব্যবহার; বরজে বৃষ্টি ও সেচের পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকতে না পারে ট্রাইকোর্ডামা কম্পোস্ট সার প্রতি গাছের গোড়ায় ৫ গ্রাম হারে প্রয়োগ করতে হবে; লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউডিজি) অথবা প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি ছত্রাকনাশক মিশিয়ে ৩০ মিনিট ডুবিয়ে লতা শোধন করে রোপণ করা; মে মাসের শুরু থেকে প্রতি ১৫ দিন অন্তর ১% বর্দোমিক্সার/০.৪% ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক /০.২% অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউডিজি/০.২% প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি ছত্রাকনাশক মিশিয়ে পান গাছের গোড়ার মাটি ভালভাবে স্প্রে করতে হবে; ২৫ টন খামারজাত সার/৬ টন খৈল দিয়ে প্রতি হেক্টর জমি শোধন করলে রোগের প্রকোপ কমে যাবে।
পানের শিকর পচা রোগ : এটি রাইজোকটনিয়া সোলানি (জযরুড়পঃড়হরধ ংড়ষধহর) নামক ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়। মাটি, ফসলের পরিত্যক্ত অংশ ও সেচের পানির মাধ্যমে এটি বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণ : গাছের শিকড়সহ মাটির নিচের সব অংশই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে; প্রাথমিক অবস্থায় পাতা মলিন হয়ে ঢলে পড়ে; পরে লতা ঈষৎ বিবর্ণ হয়ে মরে যায়; এ অবস্থায় শিকড় লাল বর্ণ দেখায় এবং ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়।
দমনব্যবস্থা : পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ; মরাপচা গাছ শিকড়সহ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলা; নতুন বাগানের জন্য রোগমুক্ত লতা বীজ হিসাবে ব্যবহার করা; ট্রাইকোডার্মা কম্পোস্ট সার প্রতি গাছের গোড়ায় ৫ গ্রাম হারে প্রয়োগ করা; লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে কার্বোন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউডিজি) অথবা প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি ছত্রাকনাশক মিশিয়ে ৩০ মিনিট ডুবিয়ে লতা শোধন করে রোপণ করা; মে মাসের শুরু থেকে প্রতি ১৫ দিন অন্তর ১% বর্দোমিক্সার/কারবেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাক নাশক/ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাক নাশক/প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউ পি প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে পান গাছের গোড়ার মাটি ভালোভাবে স্প্রে করা; ২৫ টন খামারজাত সার/৬ টন খৈল দিয়ে প্রতি হেক্টর জমি শোধন করলে রোগের প্রকোপ কমে যাবে।
পানের সাদা গুঁড়া বা পানের পাউডারি মিলডিউ রোগ : এটি অয়িডিয়াম পাইপারিস (ঙরফরঁস ঢ়রঢ়বৎরং) নামক ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়। গরম ও শুষ্ক আবহাওয়া এবং ৫০ থেকে ৬০% বাতাসের আর্দ্রতায় এ রোগ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
রোগের লক্ষণ : পাতার নিচের পিট সাদা থেকে হালকা বাদামি গোলাকৃতি পাউডার লাগানো দাগ পড়ে। পরে দুই পিটেই দাগ হয়; দাগগুলো ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং সব পাতায় ছড়িয়ে পড়ে; দাগপড়া এলাকাটি পরে বাদামি রঙ্গের হয়, শুকনো ও ভঙ্গুর হয়; কচি পাতা আক্রান্ত হলে সে পাতা আর বাড়ে না এবং বিকৃতি হয়ে যায়; আক্রান্ত পাতা বিবর্ণ হয়ে গাছ থেকে ঝরে পড়ে; লতার বৃদ্ধি বাধা প্রাপ্ত হয়।
রোগের প্রতিকার : রোগমুক্ত গাছ থেকে লতা সংগ্রহ; ফসল সংগ্রহের পর অবশিষ্টাংশ এবং আবর্জনা পুড়ে ফেলতে হবে; সুষম সার ব্যবহার ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা; সোডিয়াম বাইকার্বনেট (যেমন-বেকিং সোডা) প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ৩-৫ বার ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে; রোগ দেখা দিলে থিয়োভিট ৮০ ডব্লিউ পি প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ৩ বার ভালোভাবে স্প্রে করা; রোগের আক্রমণ বেশি হলে টিল্ট ২৫০ ইসি নামক ছত্রাকনাশক ০.৫ মিলি. প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
বি.দ্র.ঃ পানের রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রয়োজনে ৭ দিন পর পর পর্যায়ক্রমিক ০.৪% রিডোমিল গোল্ড এম জেড-৭২ ডব্লিউপি, ০.১% রিভাস ২৫০ এসসি ও ০.১% এমিস্টার টপ ৩২৫ এসসি ব্যবহার করা যেতে পারে।
সূত্র : ফসলের রোগ ও তার প্রতিকার- বিজ্ঞানী ড. কে, এম, খালেকুজ্জামান।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, শিবপুর, নরসিংদী, মোবাইল: ০১৭২০৬৪৫৬২৯ ই-মেইল :kbdmhrahman@gmail.com