Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

সীতালাউ উৎপাদন প্রযুক্তি

সীতালাউ উৎপাদন প্রযুক্তি
কৃষিবিদ ফরহাদ আহামেদ
সীতালাউ বাংলাদেশের স্বল্প পরিচিত সবজি। সিলেট, চট্টগ্রামসহ এ দেশের দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য এলাকায় এর চাষ হয়। বেগুনের মতো খাওয়া যায় বলে এটিকে লতা বেগুন বলে। 
সীতালাউ একটি দীর্ঘজীবী লতানো উদ্ভিদ। একবার রোপণের পর প্রায় ১৫ বছর পর্যন্ত একই লতা থেকে সারা বছর সীতালাউ পাওয়া যায়। এটির মূল কন্দাল, ফুল সাদা বা বেগুনি। ফলত্বক হালকা সবুজ ও মসৃণ। ফলের ফলত্বক ২-৩ সেমি. পুরু, শাঁস সাদাটে, ফলের ফাঁপা অভ্যন্তর ভাগ অনেকগুলো সাদাটে ও রসালো সূক্ষ¥ আঁশযুক্ত খোসায় আবৃত বীজ দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে। পাকা ফলের রস সুঘ্রাণযুক্ত এবং শরবত করে পান করা যায়। শক্তিশালী আকর্ষী থাকায় এ উদ্ভিদটি অনেক উঁচু গাছে আরোহণ করতে পারে এবং টিকে থাকতে পারে।
কচি অবস্থায় ফলত্বকসহ পুরো ফলটিই সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। এর স্বাদ অনেকটা চালকুমড়ার মতো তবে একটু মিষ্টি ভাব আছে। কচি সীতালাউ কুচি করে কেটে ভাজি হিসেবে বা মিশ্র সবজিতে এবং তরকারিতে খাওয়া যায়। পাকা ফলের রসপূর্ণ থলে বা লোম থাকে। পাকা ফলের খোসা ছাড়িয়ে টুকরা করে কেটে তা পেঁপে, আনারস বা কলার সাথে চমৎকার মিশ্র ফল হিসেবে খাওয়া যায়।
জলবায়ু :  ভালো ফলনের জন্য কাক্সিক্ষত গড় তাপমাত্রা হলো ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।  উজ্জ্বল সূর্যালোক প্রয়োজন।  
মাটি বা জমি নির্বাচন : প্রায় সব ধরনের মাটিতেই সীতালাউ চাষ করা যায়। তবে সুনিষ্কাশিত দোআঁশ, এঁটেল দোআঁশ ও  বেলে দো-আঁশ মাটিতে ভালো হয়। সুনিষ্কাশিত, উর্বর, সূর্যের আলো পড়ে এমন উঁচু জমি নির্বাচন করতে হয়। মাটির উপযোগী অম্লমান ৫.৫-৬.৫। পাহাড়ি এলাকায় ফলন ভালো হয়।
জাত:  বারি সীতালাউ-১। 
বীজ হার :  প্রতি শতক বীজতলায় বীজ লাগে ৩.৫ - ৪ গ্রাম।
চারা উৎপাদন : সীতালাউ বীজ, শাখাকলম (লতার কাটিং) ও কন্দমূল (শিকড়) এর মাধ্যমে চারা উৎপাদন করা যায়। বীজ থেকে সীতালাউ চারা তৈরি করা যায়। কিন্তু তা না করাই ভালো। কেননা বীজ থেকে মাত্র ৫০% চারা গজাতে পারে। এ ছাড়াও বীজ থেকে গজানো গাছে ফলন কম হয় এবং জাতের গুণাগুণ ঠিক থাকে না। বীজ দিয়ে চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলার দৈর্ঘ্য ১০ ফুট, প্রস্থ ৩ ফুট ও উচ্চতা ৬ ইঞ্চি। দুই বীজতলার মাঝে ১.৫ ফুট নালা রাখতে হয়। মাটি নরম করে প্রতি বীজতলায় ৩ কেজি জৈবসার মিশিয়ে দিতে হবে। বীজ সারি থেকে সারি ৮ ইঞ্চি বীজ থেকে বীজ ৪ ইঞ্চি দূরে বপন করা হয়। বীজ বপন সময় জুন-জুলাই। বীজ বপনের ১০-১৫ দিন পর চারা গজায়। ৩০-৪০ দিন বয়সের চারা রোপণ করা হয়।
শাখাকলম (লতার কাটিং) থেকে সীতালাউয়ের চারা তৈরি করা ভালো। ৬-৮ মাস বয়সের ১-১.৫ ফুট লম্বা, ৩-৫ টি পর্ব/ গিঁটসহ শাখা কাটতে হয়। এই শাখা মাটি ভর্তি পলিব্যাগে বা বীজতলায় তেরছা করে ৩-৪ ইঞ্চি গভীরে রোপণ করতে হয়। ২-৩ মাসের মধ্যে চারা হয়।
চারা উৎপাদন না করে বীজ বা শাখা সরাসরি জমিতে মাদায় বা গর্তে বপন করা যায়। এতে ফল দেরিতে ধরে ও ফলন কম হয়।
রোপণ সময় : সারা বছর সবজি হিসেবে চাষ করা যায়। তবে শাখা/ কাটিং রোপণের উপযুক্ত সময় মধ্য ফাল্গুন- মধ্য বৈশাখ (ফেব্রুয়ারি- মে) । চারা রোপণের সময় হচ্ছে মধ্য জ্যৈষ্ঠ-মধ্য শ্রাবণ (জুন-জুলাই)।
জমি তৈরি : জমি ২-৩ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে সমতল করে তৈরি করতে হয়। জমি থেকে আগাছা ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে পুুড়িয়ে দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে জৈবসার হয়।
সার প্রয়োগ : প্রতি মাদায় জৈবসার ২০ কেজি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে ১৫ দিন রাখতে হয়। তারপর চারা রোপণ করতে হয়। মাদা না করলে প্রতি শতকে ৮০ কেজি জৈবসার দিতে হয়। অথবা- প্রতি মাদায় জৈবসার ৮-১০ কেজি , ইউরিয়া  ৫০০ গ্রাম, টিএসপি ৪০০ গ্রাম এবং এমওপি ৩০০ গ্রাম সার দিতে হয়। মাদা তৈরি করে ইউরিয়া ছাড়া সকল সার মাটির সাথে মিশিয়ে ১৫ দিন রাখতে হয়। চারা লাগানোর ২ মাস পরপর প্রতি গাছে ১০০ গ্রাম করে ইউরিয়া দিতে হয়। মাদা না করলে প্রতি শতকে ৪০ কেজি জৈবসার, ইউরিয়া  ১২০০ গ্রাম, টিএসপি ৬০০ গ্রাম এবং এমওপি ৫০০ গ্রাম সার দিতে হয়।   
চারা রোপণ : বেডে বা সমতল জমিতে সীতালাউ চাষ করা যায়। বেডে ফলন বেশি হয় ও বর্ষাকালে জমি নষ্ট হয় না। বেডের প্রস্থ ৪-৫ ফুট, দুই বেডের মাঝে ১ ফুট প্রস্থ ও ৮ ইঞ্চি গভীর নালা রাখতে হয়। প্রতি বেডে ৫ ফুট দূরে দূরে মাদা তৈরি করতে হয়। মাদার গর্তের আকার- র্দৈঘ্য ১.৫ ফুট, প্রস্থ ১.৫ ফুট ও গভীরতা ১.৫ ফুট। বেড না করলে সারি থেকে সারি ৭ ফুট ও প্রতি সারিতে মাদা থেকে মাদার দূরত্ব ৫ ফুট। মাদায় চারার দূরত্ব-৩-৪ ইঞ্চি। প্রতি মাদায় ২-৩ টি চারা রোপণ করতে হয়। মাদা তৈরি না করলে সারি থেকে সারি ৭ ফুট ও প্রতি সারিতে চারা থেকে চারার দূরত্ব ৪ ফুট। 
মাচা বা বাউনি তৈরি : সীতালাউ লতানো উদ্ভিদ। মাচা সাধারণত দুই ধরনের হয়- বাঁশের আনুভূমিক মাচা ও রশি / তার দিয়ে তৈরি উলম্ব মাচা। প্রতি মাদায় একটি করে বাঁশ বা গাছের ডালের ঝোপালো অগ্রভাগ পুঁতে দিতে হয়। এই ঝাড়ে গাছ তুলে দিতে হবে। এরপর বাঁশ/ জিআই তার দিয়ে মাচা তৈরি করতে হবে।  
আগাছা দমন : নিয়মিত আগাছা দমন করলে  ফলন বেশি হয়।  চারা গজানোর ২০-৩০ দিন পর পর অবশ্যই আগাছা দমন করা উচিত।  
সেচ ও নিকাশ : বীজ বপনের সময় মাটি শুকনা থাকলে হাল্কা সেচ দিতে হয়। দৈহিক বৃদ্ধির সময় হাল্কা সেচ দিলে ভালো হয়। অতি বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
পরির্চযা : গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে ও মাটি তুলে উঁচু করে দিতে হবে। মরা লতাপাতা ও জমি পরিষ্কার রাখা। নতুন শাখায় সীতালাউ ধরে। এজন্য পুরাতন শাখা প্রশাখা মাঝে মাঝে কেটে দিতে হয়। শীতের শেষে অবশ্যই পুরাতন শাখা প্রশাখা কেটে দিতে হয়। এতে ফলন বাড়ে।
পোকা দমন 
মাছি পোকা আক্রমণে ফসলে ক্ষতির প্রকৃতি : কচি লাউ ছিদ্র করে ডিম পাড়ে। কীড়া লাউ খেয়ে পচিয়ে ফেলে। কচি লাউ ঝরে পড়ে। এ পোকা দ্বারা বড় লাউয়ের ক্ষতি হয় না। লাউয়ে ক্ষত থাকলে এ পোকা বেশি আক্রমণ করে। 
দমন : হাতজালের সাহায্যে এই পোকা আটকানো যায় । সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ ব্যবহার করা। বিষটোপ ফাঁদ ব্যবহার করা। জমি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। আক্রান্ত ফল মাটির নিচে পুঁতে ফেলা।
সাদামাছি আক্রমণে ফসলে ক্ষতির প্রকৃতি : কচি ফল, পাতা ও কচি ডগা থেকে রস চুষে খায়। ভাইরাস ছড়ায়।
দমন : জমি সম্পূর্ণ পরিষ্কার ও আগাছামুক্ত রাখতে হবে। পোকা, ডিম ও কীড়া মেরে ফেলা। ৩০ থেকে ৪০ গ্রাম নিমবীজের মিহিগুঁড়া এক লিটার পানিতে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে পানি ছেঁকে নিয়ে ওই পানি আক্রান্ত পাতাসহ সব গাছে স্প্রে করতে হবে। ৫০ গ্রাম সাবানের গুঁড়া ১০ লিটার পানিতে গুলে পাতায় সপ্তাহে ২/৩ বার ভাল করে স্প্রে করা। 
ফলছেদক পোকা আক্রমণে ফসলে ক্ষতির প্রকৃতি : ফলছেদক পোকার শুককীট (লার্ভা/কীড়া) প্রথমে পাতার সবুজ অংশ তারপর কুঁড়ি, ফুল এবং লাউয়ে আক্রমণ করে। শুককীটগুলো লাউ ছিদ্র করে শরীরের কিছু অংশ লাউয়ের ভিতর ঢুকিয়ে কুরে কুরে  খায়।
দমন : ক্ষেত পরিষ্কার রাখতে হবে। প্রতি গাছে দুই বা ততোধিক শুককীট দেখা দিলে হাত দিয়ে ধরে মাটির গর্তে চাপা দিয়ে মারতে হবে। জমিতে প্রতি শতাংশে ৪-৫টি ব্রাকন হেবিটর পোকা ছাড়তে হবে। জৈব বালাইনাশক এমএনপিভি (০.২ গ্রাম/লিটার) প্রয়োগ করতে হবে। 
রোগ দমন
পাউডারি মিলিডিউ : ছত্রাকের কারণে পাউডারি মিলিডিউ হয়ে থাকে। পাতার উপর বিক্ষিপ্ত সাদা সাদা দাগ হয় । দাগগুলো বড় হয়ে বাদামি হয়। পাতা নিস্তেজ হয়ে মারা যায়। লতা ও কা- সাদা ও বাদামি হয়।
দমন : কুমড়া জাতীয় আগাছা দমন করতে হবে। আক্রান্ত পাতা ছিঁড়ে বা পুড়ে ফেলে দিতে হবে। 
ডাউনি মিলডিউ : ছত্রাকের কারণে হয়ে থাকে। আক্রান্ত পাতায় নানা আকারের দাগ পড়ে। পাতা কুঁচকে যায় । 
দমন : কুমড়া জাতীয় আগাছা দমন করতে হবে। আক্রান্ত পাতা ছিঁড়ে বা পুড়ে ফেলে দিতে হবে। বোর্দমিকচার প্রয়োগ করা যেতে পারে। 
লতা পচা ও পাতায় দাগ রোগ : ছত্রাকের কারণে এই রোগ হয়ে থাকে। পাতার উপর বিক্ষিপ্ত কালো- বাদামি দাগ হয়। দাগগুলো বড় হয়ে বাদামি হয়। লতা ও পাতা নিস্তেজ হয়ে মারা যায়। লতা ও ফলে পানি ভেজা দাগ হয়।
দমন: আক্রান্ত লতা, পাতা ও ফল ছিঁড়ে বা পুড়ে ফেলে দিতে হবে। 
ফসল সংগ্রহ ও ফলন : চারা লাগানোর ৪-৬ মাসের মধ্যে গাছে ফুল আসে এবং ফুল ফোটার ২৫-৩৫ দিনের মধ্যে ফলের ওজন ৪০০-৮০০ গ্রাম হলে সবজি হিসেবে খাওয়া। পাকা ফল পাকতে আরো ২ মাস লাগে।
সারা বছর সীতালাউ ধরে এবং ২-৩ বছরের একটি গাছ থেকে বছরে ১৬-৫০টি পর্যন্ত ও ৫-৭ বছরের একটি গাছে বছরে  ৩০-৪০টি ফল ধরে। লম্বায় ১২-১৪ সেন্টিমিটার, বেড় ৮-৯ সেন্টিমিটার। ফলের গড় ওজন ৭০০ গ্রাম। শতক প্রতি ফলন ২১০-২৪০ কেজি, একরে ২১-২৪ টন ও হেক্টরে ৫৫-৬০ টন।
(তথ্য সূত্র : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট) 

লেখক : সহকারী অধ্যাপক (কৃষি শিক্ষা), শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূয়াপুর, টাঙ্গাইল। মোবাইল : ০১৭১১৯৫৪১৪৩, ই-মেইল :farhadinfo1968@gmail.com