দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যত দ্রুত সম্ভব ফুড ব্যাংক গড়ে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার কৃষকদের হাতে শস্যবীজের অধিকার সংরক্ষিত রাখার জন্য একটি ‘সার্ক বীজ ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার জন্যও নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। ০৭ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে তৃতীয় সার্ক কৃষিমন্ত্রী পর্যায়ের সভার উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান। বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে তিন দিনব্যাপী এ বৈঠকের আয়োজন করেছে। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অধিবেশনে বিশেষ অতিথি হিসেবে সার্কভুক্ত দেশগুলোর নেতাদের মধ্যে ভারতের কৃষি ও কৃষককল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী রাধা মোহন সিং এবং সার্ক মহাসচিব অর্জুন বাহাদুর থাপা বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। শেখ হাসিনা এই অঞ্চলের দেশগুলোর দারিদ্র্য এবং ক্ষুধা দূরীকরণে একযোগে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সার্ক ফুড ব্যাংক প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নিয়েছি, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। আমরা চাই একটি মানুষও যেন অনাহারে না থাকে, অপুষ্টিতে না ভোগে। আমরা প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে চাই। কিন্তু কোনো একক দেশের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন যৌথ উদ্যোগ।’ এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সব সময়ই আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় এক রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের জীবন-জীবিকার উন্নয়নে আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি প্রথম তুলে ধরেন। তখন থেকেই বাংলাদেশ তার বৈদেশিক নীতিতে আঞ্চলিক সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। তিনি বলেন, ‘টেকসই কৃষি উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে আমাদের বেশ কয়েকটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। এগুলো হচ্ছে ১. স্বল্প দামে উন্নত বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করা। ২. কৃষিকাজে সুষ্ঠু পানি ব্যবস্থাপনা। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস করে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধি। ৩. রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈবপদ্ধতির কৃষির প্রবর্তন। ৪. কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার সম্প্রসারণ। ৫. কৃষি উৎপাদন খরচ হ্রাস। ৬. কৃষক পর্যায়ে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ। ৭. কৃষি বিপণনব্যবস্থা জোরদার। ৮. প্রান্তিক চাষিদের স্বার্থ সুরক্ষা। ৯. গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও মাছের রোগ প্রতিরোধসহ উন্নত চাষপদ্ধতি চালু করা এবং ১০. এসব কর্ম সম্পাদনের জন্য উন্নততর গবেষণা পরিচালনা করা।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, সার্কভুক্ত বেশির ভাগ দেশেরই অর্থনীতি এখনো প্রধানত কৃষিনির্ভর। যদিও কোনো কোনো দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খাদ্য ও পুষ্টির জোগান এবং শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহের ক্ষেত্রে কৃষি এখনো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।’ খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে কৃষি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একই সঙ্গে এটি একটি বহুমাত্রিক এবং জটিল বিষয়। আমি আশা করব, এই বৈঠকে অংশগ্রহণকারী মন্ত্রী এবং বিশেষজ্ঞমহল আলোচনার মাধ্যমে এমন কিছু সুপারিশ দেবেন, যা এই অঞ্চলের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিকে একটি টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করাবে।’ তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশীয় জনগণের জন্য খাদ্য এবং পুষ্টির নিরাপত্তা বিধানই হোক আমাদের এই সম্মেলনের অঙ্গীকার।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশে খাদ্য নিরাপত্তা তৈরির ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত আইনি কাঠামো প্রণয়ন ও প্রয়োগে আমার সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ।’ তিনি দক্ষিণ এশিয়াকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, ‘আমাদের বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষম বেশ কিছু ফসলের জাত এবং কৌশল উদ্ভাবন করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের পাটের জন্মরহস্য উন্মোচন কৃষি গবেষণা এবং উন্নয়নে একটি যুগান্তকারী সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমি মনে করি, সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশেও একই ধরনের সাফল্য রয়েছে। আমরা সবার কল্যাণের জন্য এগুলো বিনিময় করতে পারি। এ অঞ্চলে টেকসই কৃষির উন্নয়ন এবং স্থানীয় ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ ও নাজুক পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের মধ্যে আরো গভীর সহযোগিতার প্রয়োজন।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের বর্তমান কৃষিব্যবস্থা নানা কারণে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো উচ্চমাত্রার দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষ করে সমুদ্রবেষ্টিত এবং সমুদ্র উপকূলীয় দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিধস এবং ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেকোনো সময় আমাদের অর্জনগুলোকে ম্লান করে দিতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমরা প্রতিরোধ করতে পারব না, কিন্তু এসব দুর্যোগের কারণ হ্রাস এবং দুর্যোগ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এবং মানুষের দুর্ভোগ কমানো সম্ভব।’ বাংলাদেশের প্রশংসা সার্ক কৃষিমন্ত্রীদের : সফররত সার্ক দেশগুলোর কৃষিমন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল ও স্বপ্নদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্য অর্জনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। গতকাল সকালে সার্ক কৃষিমন্ত্রীদের তৃতীয় বৈঠকের উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কৃষিমন্ত্রীদের সাক্ষাৎকালে তাঁরা এ অভিমত ব্যক্ত করেন। বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের জানান, সার্ক কৃষিমন্ত্রীরা কৃষি খাতের পাশাপাশি চলতি বছর ৭.০৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং মাথাপিছু আয় বেড়ে এক হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলারে উন্নীত হওয়ায় বাংলাদেশের সাফল্যের প্রশংসা করেন। প্রধানমন্ত্রী দারিদ্র্যকে এ অঞ্চলের ‘অভিন্ন শত্রু’ বলে উল্লেখ করেন এবং দারিদ্র্য নিরসনে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা অবশ্যই এ অঞ্চল থেকে দারিদ্র্য নিরসনে একত্রে কাজ করব।’ বৈঠকের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী সার্ক কৃষিমন্ত্রীদের বাংলাদেশে স্বাগত জানান এবং সার্ক কৃষিমন্ত্রীদের এই বৈঠককে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে অভিহিত করেন। বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, ভারতের কৃষি ও কৃষককল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী রাধা মোহন সিং, নেপালের কৃষি উন্নয়ন মন্ত্রী হরিবল প্রসাদ গাজুরেল, ভুটানের কৃষি ও বন মন্ত্রী ইয়াসি দর্জি, পাকিস্তানের জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা ও গবেষণা মন্ত্রী সিকান্দার হায়াত খান বোসান এবং সার্কের মহাসচিব অর্জুন বাহাদুর থাপা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। সূত্র : বাসস।