Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বালুকাময় চরে সবুজের প্রতিশ্রুত সমারোহ

বাংলাদেশের উত্তর জনপদ, কেউ বলেন উত্তরবঙ্গ। সব সময় একটু আলাদা। আমাদের কষ্ট জাগানিয়ার ভিন্নতর ইতিহাস গড়া অঞ্চল। কষ্টের করুণ পরিণতিতে মাঝে মধ্যে আমরা বাকস্তব্ধ হয়ে যেতাম ক’দিন আগেও। একটা সময় ছিল যখন প্রতি বছর আশ্বিন-কার্তিক মাসে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী এবং রংপুর জেলায় কর্মসংস্থান আর খাদ্যের অভাব দেখা দিত। ১৯৪৭ সাল উত্তর জনপদে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল এবং তখন থেকেই এ সমস্যাটি প্রকট হয়। সে সময় কৃষকরা কর্মসংস্থানের অভাবে নিরুপায় হয়ে আগাম শ্রম বিক্রি করত। ঘরে তিলতিল করে ঘামের ফসল সব সঞ্চয় জমা বিকিয়ে দুমুঠো ভাতের জোগান পাওয়ার জন্য চেষ্টা করত। একেই বলা হতো মঙ্গা। মঙ্গার লক্ষণ হলো ঘরে খাবার নেই, মাঠে কাজ নেই, গবাদিপশুর খাবার নেই, অনাহারে অর্ধাহারে জীবন চলত এলাকার অধিকাংশ মানুষের।
 
সংশ্লিষ্টরা বলেন শুধু আশ্বিন-কার্তিক মাসে কর্মসংস্থান/বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে উদ্ভূত পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বছরব্যাপী স্থায়ী কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বার্ষিক নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম এবং আয় বাড়ানোর প্রচেষ্টা। মঙ্গা বিনাশি ধান বিনা ৭, বিনা ১৪, ব্রিধান ৩৩, ব্রিধান ৩৯, ব্রিধান ৬২ আমাদের মঙ্গাকে জাদুঘরে নিয়ে গেছে। এসব জাতের ধানের আগাম ফলন, উৎপাদন মঙ্গাকে গুডবাই জানিয়েছে কতদিন আগেই। বর্তমানে সেখানকার পুরুষ মহিলাদের কর্মচাঞ্চল্যতা প্রমাণ করে মন আছে প্রাণ আছে প্রাণোশক্তি আছে। যে কারণে উত্তরবঙ্গের জনপদ এখন প্রাণের উচ্ছ্বাসে টইটম্বুর। ধানসহ অন্যান্য ফসলের পর সেখানে চিবিয়ে খাওয়া এবং গুড় তৈরির উপযোগী আখের জাত চাষ করে আপদকালীন সময়ে বাড়তি আয়ের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে দারিদ্র্য নিরসন সম্ভব হয়েছে। এ আগাম শ্রম বিক্রি রোধে আগাম পরিপক্ব আখ চাষাবাদের ফলে চারা তৈরি ও বিক্রি, ফাঁকা জায়গা পূরণ, মাটি আলগা করে দেয়া, আগাছা পরিষ্কার, সারের উপরিপ্রয়োগ, আখ বাঁধাই, গোড়ায় মাটি দেয়া, আখ কাটা, পরিবহন, গুড় তৈরি, বিক্রয় ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা এ অঞ্চলের দারিদ্র্য নিরসনে স্থায়ীভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আমরা জানি আখ বারো মাসের ফসল। আবার বারো মাস আখক্ষেতে টুকটাক কাজ করতেই হয়। সে কারণে সেখানে এখন গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্তে দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ সকাল থেকে সন্ধ্যা অবদি পরম মমতায় নিবিড়ভাবে শ্রম বিনিয়োগে ব্যস্ত থাকে চরের গহীন সীমাহীন চত্বরে।
 
চরাঞ্চলে কৃষি পণ্য ধান, পাট, আখ, আলু সবজি, ভুট্টা খুব সীমিত আকারে চাষাবাদ হয়। অধিকাংশ জমিই পতিত থাকে এবং বন্যাকালীন সময়ে চাষকৃত ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আখই হচ্ছে প্রধান ফসল যার সাথে সাথীফসল হিসেবে অন্যান্য ফসলের চাষ করে পতিত জমির পুরোপুরি সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব। সে কারণেই আবাদযোগ্য জমির সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য ও সার্বিক উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রচলিত ফসল বিন্যাসের সাথে আখ ও সাথী ফসলের আবাদ সমন্বয়ের মাধ্যমে বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে এসব চর অঞ্চলের দারিদ্র্য নিরসনে আরো বেশি কার্যক্রম নেয়া প্রয়োজন। এমনিতেই আমাদের নদীগুলো মমতার পরশে আমাদের জরাজীর্ণতা থেকে আমাদের ধুয়ে মুছে শূচি শুদ্ধ করে নেয়। উপরন্তু মিহি পলির পরশে আমাদের জমিনগুলোকে উর্বর যৌবনা করে দেয়। বিশেষ করে নদীর বুকে জেগে উঠা চরে শুধুই বালু আর বালুর মাঝে এ পলির আশাতীত পলি স্তরের কারণে অভাবনীয় গাত্রবৃদ্ধিতে বিভিন্ন ফসলের আবাদ অনায়াসে হয়। আখ এমন একটি ফসল যা চরাঞ্চলের পতিত জমিতেও ভালো ফলন দেয় এবং চাষিকে খরা, বন্যা কিংবা জলাবদ্ধতা থেকে ফসলহানির আশঙ্কা নিশ্চিতভাবে দূর করে। বিশেষ করে অন্যান্য ফসল চাষ করে চাষিরা যখন বন্যার হাত থেকে রক্ষা করে তা ঘরে তুলতে পারে না, সেখানে আখ প্রায় ১২-১৫ ফুট লম্বা হয় এবং বন্যাসহিষ্ণু জাত চাষাবাদের মাধ্যমে তা বন্যা কিংবা জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। আর আখচাষিরা আখ বড় হলে কয়েকটি আখের পাতা দিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ করে আখ বেঁধে বন্যা বাতাস ঝড়ের কবল থেকে দারুণভাবে রক্ষা করে।
 
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মত অনুযায়ী একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ প্রতি বছরে ১৩ কেজি চিনি খাওয়ার প্রয়োজন। মানুষের ব্রেনের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য রক্তে পরিমাণ মতো চিনির উপস্থিতি দরকার। আমাদের দেশে এ পরিমাণ একসময় স্বপ্ন ছিল। এখন তা চলমান বাস্তবতার আলোকিত অংশ। যা বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটের নিরলস অবদানের জন্য। আখ শুধু আমাদের মিষ্টি ফসলই না। আখের আছে বহুমুখী ব্যবহার এবং সক্ষমতা। আখ থেকে আসে চিনি, গুড়, চিটাগুড়, ছোবড়া, ভিনেগার, জুস প্রোটিন জ্বালানি, পশুখাদ্য, মোম, চিবিয়ে খাওয়া রস, ওষুধের পথ্য, ঘরের চাল আচ্ছাদন এসব। আমাদের দেশের উৎপাদিত আখ থেকে গুড় হয় ৫৭%, চিনি হয় ২৭%, চিবিয়ে খাওয়া রস ১০%, বীজ হিসেবে রাখা হয় ৬%। বর্তমানে চিনি কল এলাকায় ৯৯% এবং গুড় উৎপাদনকারী এলাকায় ৬০% আখ বিএসআরআই উদ্ভাবিত জাত আবাদ হচ্ছে। আখের গড় ফলন কম বেশি ১০০ টনের মতো। এ যাবত ৪৩-৪৪টি আধুনিক কাক্সিক্ষত জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে সাধারণ আধুনিক জাত উদ্ভাবনের সাথে বন্যা খরা লবণাক্ত জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে এগোতে পারলে আখ দিয়ে আমরা আমাদের কৃষি সমৃদ্ধিকে আরো বেগবান করতে পারবো।
 
বৃহত্তর রংপুরের চরাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আখ চাষ প্রকল্পের মাঠের অভিজ্ঞতা থেকেই দেখা যায় বালুময় পতিত যে চরে বিঘাপ্রতি ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকার ধইঞ্চা হতো, ধইঞ্চা ছাড়া অন্য কোনো ফসল হতো না, সে চরেও এবার ৫০ হাজার টাকার আখ বিক্রি করেছেন চাষিরা। ফলে প্রাথমিক লাভ পাচ্ছেন জমির মালিকগণ। আর আখ আবাদের ফলে দ্বিতীয় সুবিধাভোগীরা হচ্ছেন মাঠের শ্রমিক। কেননা আখ বারোমাসী ফসল বলে শ্রমিকরা সারা বছর তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পেরেছে। অন্যদিকে কাজের সুযোগ পেয়ে লাভ করেছেন আরো দুটি শ্রেণি ০১. গুড় উৎপাদনকারী এবং ০২. গুড় ব্যবসায়ী। চর এলাকার উৎপাদিত এসব বিষমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত নির্ভেজাল গুড় চলে আসছে দেশের বিভিন্ন বাজারে। প্রতি কেজি গুড় কমপক্ষে ৫০ টাকা হারে বিক্রি হয়। এলাকার মানুষের নিত্যদিন ব্যবহারের জন্য শতভাগ বিশুদ্ধ গুড়তো রয়েছেই। এছাড়া আখের ছোবড়া জৈবসার ও জ্বালানি এবং আখ পাতা জ্বালানির উৎকৃষ্ট উৎস হিসেবে অভাবণীয় কাজ করে।
 
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার এ চরটিতে ধইঞ্চা ছাড়া অন্যকোন ফসল দেখা যায়নি। সেখানে প্রায় ৪০ বিঘা জমিতে আখ চাষ হয়েছে এর মধ্যে প্রদর্শনী আখক্ষেত রয়েছে মাত্র ৬টি। বাকিগুলো চাষিরা নিজেরাই উদ্বুদ্ধ হয়ে আখ রোপণ করেছেন। চাষিরা বলেন, ধইঞ্চার চেয়ে আখ অনেক লাভজনক এটা তাদের কাছে সহজেই বোধগম্য হয়েছে। তারা আগামী বছর এ চরের অধিকাংশ জমিতে আখের আবাদ করবেন। এখন পর্যন্ত যে সব এলাকায় কাজ করা হয়েছে সর্বত্রই সারা বছর আখক্ষেতে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। চরের বালুময় পতিত জমিতে যেখানে অন্য কোনো ফসল হয় না সেখানেও হতদরিদ্র চাষিরা আখ আবাদ করে লাভবান হচ্ছেন। আরো বিস্তৃত এলাকার কর্মসূচির আওতায় আনা দরকার; চর এলাকায় এখন আর আগের মতো আগাম শ্রম বিক্রি হয় না। এ এলাকায় শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। তারা উন্নত খাবার গ্রহণ করছে এবং উন্নতমানের পোশাক ব্যবহার করছে। মোটকথা জীবনযাত্রার মান আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
 
গুড় উৎপাদনের মাধ্যমে অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। এরা আখ চাষিদের কাছ থেকে আখ কিনে গুড় তৈরি করছে এবং তা বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে। এ ছাড়া আখের চারা বিক্রির মাধ্যমেও অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। যে চরে শরতের কাশ ছাড়া আর কোনো ফসল হতো না সেখানেও আখ চাষ করে চাষিরা উর্ব্বর জমির  লাভবান হচ্ছেন কাশের অতনু ছোঁয়ার পাশে। এতে আবাদি জমির সাথে সাথে সামগ্রিক ফসলের উৎপাদনও বেড়েছে। অনেক মহিলা এখন আখ ক্ষেতে কাজের মাধ্যমে ভালো রোজগার করছেন। এতে তাদের অভাব দূর হয়েছে। তারা নিজেদের তৈরি গুড় পরিবারের সদস্যদের খাওয়াতে পারছেন। তাছাড়া পুষ্টিকর খাবারের ওপর তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ায় তারা এখন স্থানীয় কম মূল্যের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করছেন। নিজেদের পরিবারের ব্যবহারের পর থেকে যাওয়া আখের গুড় তারা অন্তত ৫০ টাকা দামে বিক্রি করছেন।
 
বৃহত্তর রংপুরের তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা নদীর শাখাপ্রশাখা চার দিকে সৃষ্টি করেছে ধু ধু বালুচর ও চরাঞ্চল এলাকা। এ চরাঞ্চল এলাকার অনাবাদি জমি কৃষি চাষের আওতায় এনে সেখানে আখ চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বৃহত্তর রংপুর এলাকায় ধান চাষের পাশাপাশি আখ চাষের মাধ্যমে কৃষি শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজের সুযোগ সৃষ্টিসহ দেশে গুড় শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে আখ চাষের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির কৌশলগত পরিকল্পনা শীর্ষক কর্মশালার এক রিপোর্টে বলা হয়, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় মাত্র ২১ হেক্টর জমিতে গুড় উৎপাদন উপযোগী আখ চাষ করা হচ্ছে। এ ছাড়া রাজিবপুর উপজেলায় ১০ একর, রৌমারী উপজেলায় ১০০ হেক্টরের বেশি ও নাগেশ্বরী উপজেলায় মাত্র ১৫ হেক্টর জমিতে আখের চাষ আছে যার বেশির ভাগ গুড় উৎপাদন উপযোগী এবং অল্প কিছু চিবিয়ে খাওয়ার উপযোগী।
 
বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক পরিচালিত প্রকল্পের মাধ্যমে রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল এলাকা ২০১১-২০১২ রোপণ মৌসুম থেকে আখ চাষের আওতায় আনা হয়েছে। দানাদার গুড় উৎপাদনের জন্য ঈশ্বরদী-৪০ জাতটি চাষ করে সে এলাকায় কৃষকদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। বর্তমানে এ অঞ্চলগুলোতে বৃহত্তর রংপুরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আখ চাষ প্রকল্প এর মাধ্যমে বেশ কিছু জমিতে আখ চাষ করা হচ্ছে। এ ছাড়াও চিবিয়ে খাওয়া যায় এমন জাতের আখ চাষ করে কৃষকরা প্রচুর মুনাফা অর্জন করেছে। চিবিয়ে খাওয়া যায় এমন জাতের আখ চাষ করে ১ বিঘা জমি থেকে বছরে ১ লাখেরও বেশি টাকা লাভ করা যায়। এতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বদলে যাচ্ছে এলাকার জীবনযাত্রার মান, বদলে যাচ্ছে ভাগ্যের চাকা। কৃষকরা আখ চাষের পাশাপাশি একই জমিতে একই সময়ে সাথীফসল চাষ করে লাভের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে তুলতে পারছে। আখের সঙ্গে সাথীফসল হিসেবে তারা পেঁয়াজ, রসুন, আলু চাষ করছে, যা তাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী থেকে আখচাষিদের সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হয়। এ ছাড়াও বৃহত্তর রংপুর এলাকায় অবস্থিত ৫টি প্রকল্প অফিস থেকে আখচাষিদের সার্বক্ষণিক তদারকি ও সহযোগিতা করা হয়। কৃষকরা ভালো জাতের আখের বীজ এখান থেকে সংগ্রহ করতে পারেন।
 
বৃহত্তর রংপুরের চরাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ইক্ষু চাষ প্রকল্প শুরু হয়। প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হয় ০১.০৭.২০১১ শেষ হবে ৩০.০৬.২০১৫। পুরো কার্যক্রম সীমাবদ্ধ আছে নীলফামারী জেলার ৩টি উপজেলা ডোমার, ডিমলা, জলঢাকাতে। এখানে উল্লেখযোগ্য এলাকা হলো  রামডাঙ্গা, বালাপাড়া। লালমনিরহাট জেলার ৩টি উপজেলা সদর, আদিতমারি, হাতিবান্ধা। আর এখানকার প্রকল্পভুক্ত এলাকা হলো বাদিয়ার চর, চর কুলাঘাট, চর মহিষখোচা, চর দক্ষিণ সিন্দুর্না। কুড়িগ্রাম জেলার ৪টি উপজেলা সদর, রৌমারি, রাজিকপুর, নাগেশ্বরী। এসব উপজেলার প্রকল্পভুক্ত এলাকা হলো পাছগাছি, খামর হলোখানা, নারায়ণপুর, কাউয়ারচর, দই খাওয়ার চর, চর সোনাপুর, চরধনতলা। রংপুর জেলার ২টি উপজেলা গঙ্গাছড়া ও কাউনিয়া উপজেলার এলাকাগুলো চর খোলাবাড়িয়া, নলছিয়ার চর, চরদীঘলকান্দা, চরপাতিলাবাড়ি, চর এরেন্দাবাড়ি। গাইবান্ধার উপজেলার ৪টি উপজেলা হলো সদর, ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ। এসব এলাকাতে এখন আখ চাষের ধুম লেগেছে। প্রকল্প লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার একর যা অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। মোট ১শ’ ২৫টি প্রদর্শনী। এর মধ্যে প্রতি উপজেলায় ২৫টি করে। সব ক‘টি সফলভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। ২ হাজার কৃষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ২৫০ টন মানসম্মত আধুনিক বীজ আখ বিতরণ করা হয়েছে। এখানে শুধু আখ চাষই মুখ্য নয়। এর সাথে প্রশিক্ষণ মিশ্র সাথী ফসলের।
 
অতীতে দেখা যেত, আমন ধান রোপণের পর এবং কাটার আগে কৃষি শ্রমিকদের হাতে তেমন কোনো কাজকর্ম প্রায় থাকত না বললেই চলে। আখ চাষ করে বেকার কৃষি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে। তাছাড়া চরাঞ্চলের বালুময় পতিত জমিতে যেখানে ফসল হয় না বললেই চলে। এমন জমিতেও আখ চাষ করে কৃষকের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট। কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার প্রত্যন্ত চর লাঠিয়ালডাঙ্গার আখ বা গেণ্ডারি রাজিবপুর ও রৌমারী উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রফতানি হচ্ছে। প্রতিদিন রাজিবপুর ও রৌমারী সদর থেকে প্রায় ১শ’ জন ব্যাপারী জাদুর চর ইউনিয়নের চরলাঠিয়ালডাঙ্গা গ্রামে এসে আখ পাইকারি ক্রয়ের জন্য ক্ষেতে ক্ষেতে ভিড় জমায়।
 
ভোরবেলায় মুখরিত হয়ে ওঠে চরলাঠিয়ালডাঙ্গার রাস্তাঘাট। কার আগে কে যাবে আখের ক্ষেতে এ প্রতিযোগিতা শুরু হয় প্রতিদিন ব্যাপারীদের মধ্যে। সরেজমিন এলাকায় গিয়ে কথা হয় আখচাষিদের সাথে। তারা জানান, গত বছর ৩ বারের বন্যায় রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলায় কোনো কৃষকের আবাদ হয়নি। বারবার ক্ষতি হওয়ার ফলে শাকসবজি ও ধানের আবাদ বাদ দিয়ে এবার ১ বিঘা (৬০) শতাংশ জমিতে আখের চাষ করে। আরো জানান, আখ চাষে তুলনামূলকভাবে অন্যান্য ফসলের চেয়ে খরচ ও পরিশ্রম কম হয়। তার ১ বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে লাগানো, নিড়ানি, সার, কীটনাশক সবকিছু মিলে ৩৫ হাজার টাকা। আর আয় হয়েছে ১ লাখ টাকা। নিট লাভ ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। ঢাকা জেলার আখের ব্যাপারী জানান, আখের চাহিদা ঢাকাসহ সারা দেশেই আছে। কারণ অন্য আখের চেয়ে চরলাঠিয়ালডাঙ্গার মাটি অনেক ভালো। ভারতের লালমাটির ঘোলা পানি পেয়ে এ আখ অনেক রস ও মিষ্টি হয়। কিন্তু কেনার পর সরাসরি যানবাহন না চলাতে বিভিন্নভাবে টানাটানি করে কর্তিমারী বাজারে ও রাজিবপুর বাজারে এনে ট্রাকে নিতেই খরচ ও সময় দুটোই বেড়ে যায়। ফলে আমাদের আগ্রহ খুব থাকলেও যোগাযোগের সমস্যার জন্য আগ্রহ কমে যায়
 
রাজিবপুর উপজেলার জহিরম-লপাড়া গ্রামের আখের ব্যাপারী জানান, সরাসরি ক্ষেত থেকে আখ কিনে রাজিবপুর বর্ডার হাটে বিক্রি করি। তাতেও আমার প্রতি হাটে হাজার টাকা লাভ হয়। ভারতের গারোরা এ আখ খুব খায়। ওই হাটে আখের চাহিদা ভারতের লোকের কাছে খুব বেশি। চরলাঠিয়ালডাঙ্গা গ্রামটি রৌমারী উপজেলার জাদুরচর ইউনিয়নের ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা। চারপাশেই নদী মাঝখানে এ দ্বীপচরটিতে এবার প্রায় ১শ’ বিঘা জমিতে আখের আবাদ হয়েছে। যদি রৌমারীর সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ থাকতো তাহলে কৃষকরা আরো বেশি দরে আখ বিক্রি করতে পারতেন বলে জানান। এ বিষয়ে রৌমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, রৌমারী উপজেলায় এ বছর ১৪৫ হেক্টর জমিতে আখের আবাদ হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আখ চাষে আরো ভালো ফল পাওয়া যাবে।
 
যে কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ আমাদের অনেক দূরের বাতিঘরে নিয়ে যায়। তার হাজারো প্রমাণ আছে আমাদের বৃহত্তর কৃষিতে। এর মধ্যে চরাঞ্চলে আখ চাষ একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম। যেখানে মঙ্গা আজ স্মৃতির কণিকা। এটিকে আরো বেগবান করতে সংশ্লিষ্ট সবাই কার্যকরভাবে ভাববেন এবং এগিয়ে নিয়ে যাবেন এ সুন্দরের উপমাকে আরো দূরে বহু দূরে। তখন আমরাই গর্ব করে বলতে পারব নদীর বুকে জেগে ওঠা চর শুধু ধু ধু বালিকায়ময় না এখানে সম্ভব সবুজ সোনালী মিষ্টি ছোয়ার প্রতিশ্রুত সমারোহ।
 
 
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম
* উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা