অ্যাসপারাগাস (Asparagus officinalis) লিলি গোত্রের বহু বর্ষজীবী গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। আমাদের দেশে এর ব্যবহার নতুন হলেও ইউরোপ আমেরিকাসহ জাপান, চীন ও কোরিয়ায় বহুল ব্যবহৃত একটি জনপ্রিয় সবজি। উন্নত বিশ্বে প্রতি বেলার খাবার মেনুতে অ্যাসপারাগাস খুবই কমন, তবে স্থান কাল পাত্রভেদে এর পরিবেশন পদ্ধতিতে ভিন্নতা রয়েছে। কখনো বা খাবারের আগে অ্যাপিটাইজার হিসেবে, কখনো বা স্যুপে, কখনো সবজির সাথে ব্যবহৃত হয় অ্যাসপ্যারাগাস। পশ্চিমা বিশ্বের হোটেল রেস্তোরাঁগুলোতে হালকা চিকেন বা টোনাফিস স্লাইস সহযোগে অ্যাসপারাগাস সালাদ খুবই প্রচলিত। জাপানে ম্যায়নিজ মিশ্রিত আলু ভর্তায় অ্যাসপারাগাস ব্যবহার খুবই জনপ্রিয়। তবে ফ্রাইপ্যানে হালকা তেলে ভেঁজে বা ভাঁপে সিদ্ধ করে অ্যাসপারাগাস সহজেই খাওয়া যায়। এছাড়া মুরগি বা গরুর মাংস অথবা চিংড়ি বিভিন্ন সস দিয়ে রান্নায় অ্যাসপারাগাস দিলে বেশ সুস্বাদু হয়, পাশাপাশি পরিবেশনের সময় ডিসটাও দেখতে সুন্দর দেখাবে। বিশ্বব্যাপী অ্যাপারাগাসের রকমারি ব্যবহার এটি আরও জনপ্রিয় এবং আবশ্যকীয় হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে দিন দিন। অ্যাসপারাগাস-এর বাংলা নাম শতমূলী।
ঔষধি গুণের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোতে অ্যাসপারাগাস বহুল সমাদৃত। এর আছে বহুমাত্রিক পুষ্টিগুণ। অ্যাসপারাগাস মূলত প্রোটিনসহ ভিটামিন B6, A, C, E ও K, থায়ামিন, রিভোফ্লাভিন, রুটিন, নায়াসিন, ফলিক এসিড, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, পটাসিয়াম, কপার ও ম্যাঙ্গানিজসমৃদ্ধ। অ্যাসপারাগাসে প্রচুর পরিমাণে প্লান্টপ্রোটিন হিস্টোন এবং গ্লটাথিয়ন থাকে, যা এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে দেহের ক্ষতিকারক ফ্রিরেডিক্যালের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত কাজ করে। যা ক্যান্সার প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং দেহের টনিক হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া ফলিক এসিড থাকার কারণে অ্যাসপারাগাস হার্টে ব্লক সৃষ্টিতে সরাসরি বাধা দেয়। এজন্য হৃদরোগীদের জন্য আ্যাসপ্যারাগাস বেশ উপকারী। উচ্চতর গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, মানব দেহের ত্বক ও ফুসফুসের ক্যান্সারসহ কিডনি ইনফেকশান ও পিত্ত থলিতে পাথর প্রতিরোধেও অ্যাসপারাগাস উল্লেখযোগ্য কাজ করে। প্রতিদিন ২ বার সকাল সন্ধ্যায় ২-৩টি অ্যাসপারাগাস স্টিক খেলে ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যেই এসব রোগের উপশম হয়।
উপকারিতা
* উচ্চ রক্তচাপ কমায়;
* এসিডিটি, দুর্বলতা, যে কোনো ধরনের ব্যথা, ডায়রিয়া, আমাশয় দূর করে;
* শরীরের নানা ধরনের প্রদাহ, পাইল্স সারিয়ে তোলে;
* চোখ ও রক্তের যে কোনো সমস্যা দূর করে;
* নার্ভে কার্যক্ষমতা ঠিক রাখে;
* শতমূলির শিকড় লিভার, কিডনি ও গনোরিয়ার জন্য উপকারী;
* যাদের বদহজমের সমস্যা রয়েছে, তারা শতমূলির শিকড় রস করে তাতে মধু মিশিয়ে খান, উপকার পাবেন।
অ্যাসপারাগাস পর্যাপ্ত জৈব পদার্থসমৃদ্ধ সুুনিষ্কাশিত মাটিতেই ভালো হয়। মাটিতে যেন পানি না জমে সেদিকে লক্ষ রাখতে হয়। মাটি ঝুরঝুরা হলে স্পেয়ার্স এর সংখ্যা বেশি হয়। মাটির পিএইচ মাত্রা ৬-৭তে অ্যাসপারাগাস ভালো হয়। জমি তৈরি করার সময় বেডে পরিমাণ মতো চুন প্রয়োগ করে নিতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে গোবর সার ও খৈলগুঁড়া প্রয়োগ করতে হবে। মার্চ মাসের দিকে স্পেয়ার্স বের হতে শুরু করলে এবং জুলাই মাসের শেষের দিকে বছরে ২ বার ১:১:২ : ইউরিয়া : টিএসপি : এমপি অনুপাতে প্রতিবার হেক্টর প্রতি ১০০ কেজি সার মাটির উপরিভাগে ছিটিয়ে হালকা করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
বীজ থেকে সহজেই চারা উৎপাদন করা যায়, তবে বীজ থেকে উৎপাদিত অ্যাসপারাগাস থেকে প্রথম বছর কোনো ফলন পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় বছর থেকে ফলন দিতে থাকে এবং পর্যায়ক্রমে ফলন বাড়তে থাকে। সারা বছর স্পেয়ার্স উৎপাদিত হলেও শীতে উৎপাদন কমে যায়। বর্ষায় জমিতে কোনোভাবেই পানি জমতে দেয়া যাবে না, শুকনো মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি সেচ দিতে হবে। অ্যাসপারাগাসে সাধারণত স্ত্রী ও পুরুষ দুই ধরনের গাছ দেখা যায়। পুরুষ গাছে উন্নতমানের স্পেয়ার্স উৎপাদিত হলেও, বীজ কিন্তু স্ত্রী গাছেই হয়। স্ত্রী গাছে স্পেয়ার্স খুব কম হয় ও উৎপাদিত স্পেয়ার্স নিম্নমানের হয়। স্পেয়ার্স ১৫-২০ সেন্টিমিটার লম্বা হলেই ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে নিতে হবে। দ্বিতীয় বছর থেকে গড়ে ৮-১০টি স্পেয়ার্স প্রতি গাছ থেকে সংগ্রহ করা যাবে, তবে বয়সের সাথে সাথে তা বাড়তে থাকবে।
ফিউজারিয়াম রট ও ক্রাউন রট অ্যাসপারাগাসের মারাত্মক ক্ষতি করে। তাই বছরে অন্তত ২-৩ বার রিডোমিল বা ডাইথেন স্প্রে করতে হবে যেন মাটিসহ ভিজে যায়। মাটিতে সেভিন ডাস্ট দিলে স্পেয়ার্সে পিঁপড়া বা বিটলের আক্রমণ হবে না। তা ছাড়া গবেষণায় দেখা যায় যে, সরিসার খৈলের পরিবর্তে নিমের খৈল ব্যবহার অথবা জমিতে নিমপাতা গুঁড়া ব্যবহার করলে ফিউজারিয়াম রট কমে হয়।
অ্যাসপারাগাস যেমন খাবারের পুষ্টিমান বাড়ায় তেমনি ডিস সাজানোতে আনে শৈল্পিক সৌন্দর্য কারুময়তা। নিত্যদিনের খাবার মেনুতে অ্যাসপারাগাস রেখে আমরা কিন্তু আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি অনায়াসে। সংসারের প্রতিদিনের অ্যাসপারাগাস নিজেই বাড়ির আঙিনায়, ব্যালকনিতে বা ছাদে বড় বড় টবেই উৎপাদন করে নেয়া যায়। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে অ্যাসপারাগাসের বাংলাদেশে উৎপাদন উপযোগিতা, উৎপাদন পদ্ধতি ও পুষ্টিমান নিয়ে গবেষণা চলছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে চাষযোগ্য ৩টি লাইন সাউ অ্যাসপারাগাস-১ (মেরী ওয়াশিংটন), সাউ অ্যাসপারাগাস-২ (গ্রীন বাংলা) ও সাউ অ্যাসপারাগাস-৩ (ওয়েলকাম ঢাকা) উৎপাদন শুরু হয়েছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্যানতত্ত্ব খামারে। এ লেখাটির তথ্য সরবরাহকারী ড. এ ফয়েজ এম জামাল উদ্দিন, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
* উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫