Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

অপার সম্ভাবনার প্রতিশ্রুত দিগন্ত আমাদের হাওর

নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। আবার ভাটির দেশও বালাদেশ। আমাদের দিগন্ত বিস্তৃত খণ্ড খণ্ড হাওরগুলো তাদের চৌহর্দি মিলে আমাদের ভাটির বাংলা বা ভাটি অঞ্চল গঠন করেছে। হাওর শব্দটির উৎপত্তিও সাগর থেকে সায়র; আর সায়র অপভ্রংশ হয়ে হাওর হয়েছে বলে ভাষা বিজ্ঞানীদের মতো। হাওরের আছে ব্যাঞ্জরিত নাম। টাঙুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, শনির হাওর, টগার হাওর, মাটিয়ান হাওর, দেখার হাওর, হালির হাওর, সানুয়াডাকুয়া হাওর, শৈলচকরা হাওর, বড় হাওর, হৈমান হাওর, কড়চা হাওর, ধলা পাকনা হাওর, আঙ্গরখালি হাওর, নখলা হাওর, চন্দ্রসোনার থাল হাওর, ডিঙ্গাপুতা হাওর আরও কত নাম। ছোট ছোট নদী খাল নালা ডোবা আর বিস্তৃর্ণ এলাকাজুড়ে সীমাহীন বিল মিলিয়ে এ হাওরাঞ্চল ভাটির বাংলাকে যেন পরম মমতায় অপরূপ রূপে সাজিয়েছে এ বাংলার রূপকে মাতিয়েছে প্রকৃতিকে। হাওরের অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা ঋতুতে ঋতুতে পরিবর্তন হয় ভিন্ন অবয়বে। বর্ষায় দিগন্ত জোড়া অথৈ জল উদ্দাম ঢেউয়ের অবিরাম মাতামাতি আর মন উদাসি মাতাল করা হাওয়া পর্যটকদের মন উদাস করে দেয় অহরহ। বর্ষার জলকেলি যিনি জীবনে একবার দেখেছেন তিনি বারবার ফিরে যাবেন হাওরের টানে। বর্ষায় যৌবনবতী হাওর সাগরের মতো অনন্ত অসীম জলাধারে একাকার। দূরের আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমানোর মনোরম দৃশ্য হৃদয়কাড়া সৌন্দর্য বলে শেষ করার মতো নয়। হাওরে নৌকা ভ্রমণে চাঁদনি রাতের স্মৃতি জীবনে একবার গেঁথে নিলে আমৃত্যু তার তৃষ্ণা থেকে যাবে।


আর পাহাড়ের জলের তলে ভাটি বাংলার স্বর্ণগর্ভা সোনালি ফসলের দিগন্তজোড়া মাঠ ভেসে উঠে সুদিন শীতের প্রাক্কালে। বাংলার ষড়ঋতুর ঋতু বৈচিত্র্য আর বৈশিষ্ট্য, লীলাখেলা এত সুন্দর ও প্রাণ জুড়ানো মাধকতা হাওর ব্যতীরেকে দেশের আর কোথাও দেখা যায় না। হাওর হচ্ছে ঋতু বৈচিত্র্যের চারণভূমি, লীলা নিকেতন। বাংলার আদি ও আসল রূপ অপরূপ হয়ে একমাত্র হাওরেই দেখা সম্ভব। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদে ভরপুর, লোক সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের লালন, পালন, ধারণ ও বাহন করছে হাওর এলাকা। হাওরের দুটি রূপ। শুকনো মৌসুমের শীতকালে এবং বর্ষায় একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরিত রূপ ও বৈশিষ্ট্য ধারণ করে জলে থৈ থৈ করা সীমাহীন জলাধারের হাওর হয়েছে রূপের রানী। হাওরের এ রূপ সাগরে অবগাহনের অপার সম্ভাবনা আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে বারবার, এসো জলপুরীতে।


পৃথিবীর তাবৎ সুস্থ ও সুন্দর বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছে পানিকে কেন্দ্র করে, পানির কিনারে কিংবা পানির মাঝে। পানিভিত্তিক আলো আঁধারের অপরূপ সৌন্দর্য আমাদের কল্পনা বিলাশে নিয়ে যায় আলতো করে। পানি আর পানি। আর সে পানি যদি হয় মিঠা পানি, তবে তো সোনায় সোহাগা। হাওর হচ্ছে মিঠা পানির প্রকৃতি প্রদত্ত এক অপার মহিমা উৎস ও অবারিত জলভাণ্ডার। পুরো পৃথিবীর মাঝে মিঠা পানির এত বড় একক ওয়াটার বডি আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা জানা নেই। বর্ষার ৭ মাসে এর আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৫ হাজার বর্গমাইলের ওপরে। কোন কুল নাই কিনার নাই এমন অবস্থা। চারদিকে পানি শুধু অথৈ পানি কেবল থৈ থৈ করে। প্রায় ২ কোটি লোক এখানে বসবাস করে। হাওর হচ্ছে সাগরেরই অপর প্রতিরূপ। সাগরের সব রূপ বৈশিষ্ট্য হওরে রয়েছে শুধু সাগরের গহিন গভীরতা নেই।


দেশের পূর্ব-উত্তরাংশের কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার হবিগঞ্জ ও ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার ৫৭টি উপজেলা নিয়ে ভাটির বাংলার হাওর এলাকা গঠিত। হাওর হচ্ছে একটা বিশাল চ্যাপ্টা বাটির মতো, বেসিন বিশেষ, যাতে বর্ষায় পানি জমে সাগরের রূপ ধারণ করে। আর শুকনো মৌসুমে দিগন্ত জোড়া নয়নাভিরাম মাঠে সবুজ শ্যামলের সমারোহ। সবুজ ধান ক্ষেতের বুক চিড়ে বহমান সর্পিল মেঠো পথ বা  ডুবা সড়ক কিংবা কৃষকের ব্যস্ত কর্মযজ্ঞ কার্যক্রম দেখার আকর্ষণ যে কাউকেই ঘুরে বেড়ানোর নেশায় মাতোয়ারা করবে হাতছানি দিয়ে ডাকবে। সাগরের মতো বিশাল ও বড় বড় হাওরের মাঝে রয়েছে কচুরিপানার মতো ভাসমান দ্বীপ-গ্রাম। কাকের চোখের ন্যায় কালো ও স্বচ্ছ জলরাশির মাঝে  দ্বীপের মতো এক একটি গ্রামের প্রতিবিম্ব সেরা আঁকিয়ের সেরা ছবি হয়ে ভেসে উঠবে আমাদের মনোজগতে। দূরে বহু দূরে বিরাগী দুপুরে কিংবা নিশুতি রাতে পানিতে কুপি বাতির নিবু নিবু আলোর নাচন অথবা জোনাকি পোকার মতো সৌরবিদ্যুতের আলোর ছটা মনটাকে বিমোহিত করবে ছাত করে আলোর বর্তিকা জ্বালিয়ে আমাদের মনের আঁধারী দুয়ারকে আলোকিত করে। মন পবনের নাও কিংবা সাধের ডিঙি নাওয়ে চড়ে নিরবে স্রোতের অনুকূলে ভেসে ঘুরে বেড়াতে মন চাইবে। যদিও এত প্রাণ রসের মধ্যে হাওরের গ্রামীণ জীবনের কষ্ট জাগানিয়া সামান্য সময়ের জন্য হলেও আমাদের স্থবির করে দেয় ক্ষণিকের জন্য। এ স্থবিরতা বড়ই কষ্টের। প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল কষ্ট সহিষ্ণু হাওরবাসীর জীবন যাত্রা থেকেও জানা যায় অনেক অজানা কাহিনীর কাব্যগাঁথা গল্পগাঁথা যা আমাদের অনন্য সুন্দরকে আরও মহিমান্বিত করে।


প্রায় ৮ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের হাওর এলাকায় প্রায় ২০ মিলিয়ন লোক বসবাস করে। ভাটির বাংলায় রয়েছে মোট ৩৭৩টি হাওর। চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ০.৭৩ মিলিয়ন হেক্টর, বছরে ধান উৎপাদ হয় ৫.২৩ মিলিয়ন টন যা আমাদের শস্য ভাণ্ডারকেই টইটুম্বুর করে না বরং আমাদের মোট খাদ্য নিরাপত্তাকে আরও সমৃদ্ধ করছে পুষ্টিসম্মত করছে। হাওরে শস্য নিবিড়তা বা Crop intensity হচ্ছে ১৪৭%। জিডিপিতে হাওরের অবদান ০৩% এর ২৫% আসে কৃষি থেকে। হাওরে ৩% লোক ভূমিহীন (জাতীয় ১৪%)। ৮১% অকৃষিজীবীর কোনো কৃষি জমি নাই। হাওরে বছরে কৃষি জমি কমছে ০.৩৩% হারে। জাতীয়ভাবে যা ৭৪%। হাওর এলাকায় ৩৪% পরিবার প্রান্তিক কৃষক, ৫% পরিবার জাতীয় পর্যায়ের অনেক নিচে এবং  ৫১% পরিবার ছোট কৃষক (জাতীয় ৪৯.৫%)। ২৮% লোক অতি দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে।


হাওর আমাদের শস্যভাণ্ডার ও মৎস্যভাণ্ডার। হাওরের বিশাল জলরাশির মাতমে মাছের অবাধ প্রজনন বেড়ে উঠা, মৎস্য ঝিলিক এবং মাছভিত্তিক আমিষের অসীম জোগান নিশ্চিত মনে করিয়ে দেয় হাওর সাক্ষাৎ আমাদের মাতৃরূপী লক্ষ্মীদেবী মৎস্যদেবী। হাওরের মাছের খনি থেকে মণিকাঞ্চন আন মানি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মহামূল্যবান ভাণ্ডারের মূর্ত প্রতীক রূপে। বছরে ১০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের মাছ পাওয়া যায়। এসব মাছের মধ্যে আছে শিং, মাগুর, কৈ, পুঁটি, সরপুঁটি, তিতপুঁটি, খৈলসা, বাঁশপাতা, তাপসি, আইড়, বোয়াল, পাবদা, টেংরা, বাইম, চিতল, ফলি, ভেদা, গজার, শোল, মহাশোল, টাকি, চাপিলা, কাকিলা, রুই, কাতল, মৃগেল, কালো বাউশসহ ১৫০ রকমের বাহারি মাছের নিবিড়ভাণ্ডার। মাছ আর নবান্নের ধান কাটার উৎসব আগামী পুরো বছরের খোরাকি যোগানের মহাউৎসব দেখলে আনন্দাশ্রুতে চোখ ভিজে গাল বেয়ে টপ টপ করে গা শরীর ভিজে যায়। বছরের ৫ থেকে ৬ মাস আবাদি ফসল আবার ৬ থেকে ৭ মাস পানি থেকে রূপালি মাছ, হাঁসের মাংস আর ডিম আমাদের জাতীয় সমন্বিত পুষ্টি জোগানকে সচল রেখেছে হাওর। আমিষের ভাণ্ডার আরও শানিত করছে দিনের পর দিন। অকাল বন্যা, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল এবং নানা কারণে সোনালি ফসল নষ্ট হয়। বছরের একমাত্র ফসলের ওপর ভর করেই চলে হাওরবাসীর পুরো বছর। হাওরের ৯০ ভাগ মানুষ কৃষি কাজ করে ৫ ভাগ মৎস্য চাষি আর ৫ ভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরি অন্যান্য কাজে নিয়োজিত। হাওরের জলাবদ্ধ ভূমিকে জারুল হিজল তমাল করচের সাথে জন্মে নলখাগড়া, ইকরা, জিংলা, বাঁশ ও প্রচুর বন সম্পদ।


ভরা বর্ষা হচ্ছে হাওরের যৌবনকাল একই সাথে নিদানকাল। চারদিকে পানি, শুধু পানি, থৈ থৈ করছে। টলমল, উচ্ছ্বাস জলে জলকেলি খেলে প্রকৃতি, পানির মধ্যে দাপাদাপি বড়ই আনন্দের। সমুদ্রের সাথে হাওরের পার্থক্য হচ্ছে সমুদ্রের গভীরে সাঁতার কাটা, ডুব দেয়া, মাছ ধরা বা ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ খুব কম পাওয়া যায়। কিন্তু হাওরে এ সুযোগ অবারিত। ডুব সাঁতার দিয়ে কাঁচের মতো স্বচ্ছ জলে পাতিহাঁসের সাথে পাল্লা দেয়ার কথা কি ভোলা যায়? একবার যারা হাওরের এ জলে অবগাহন করেছেন, বার বার তারা ফিরে আসে যেন কিসের এক অজানা আকর্ষণে। এখন আর রঙবেরঙের পালতোলা সারি সারি নৌকা হয়তো হাওরে আর দেখা যাবে না। কিন্তু সাদা কালো ধোঁয়া তুলে ভটভট শব্দ করে পানি ছিটিয়ে, হাওরের বুক চিড়ে ইঞ্জিন চালিত কঠিন শক্তিরপশরা দিয়ে গয়নানৌকার বা বেপারি নৌকার চলাচল নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। বিয়ের বা বরযাত্রার নৌকা কলাগাছ আর রঙিন কাগজে সাজানো, সানাই বা  বাদ্যযন্ত্র, মাইকের উচ্চ শব্দে, রাতে তা জেনারেটরের সাহায্যে আলোক সজ্জায় সজ্জ্বিত চলমান আলোর নাচন বলেই মনে  হবে। কচুরিপানা বা রাজহাঁস দলের ভেসে বেড়ানো অথবা প্রচণ্ড বড় ঢেউ এর বিপরীতে আনন্দময়ীর যুদ্ধ করে ভিজে একাকার হয়ে হাতে প্রাণ নিয়ে ছোট ডিঙি নৌকায় চড়ে আগুয়ান হওয়া তাদের সংগ্রামী জীবনের কথাই মনে করে দেবে।


জেলেদের টঙ বানিয়ে বান্দইরা জালসহ বিভিন্ন প্রকার জাল, বড়শি বা ডুব দিয়ে অথবা অমাবশ্যার রাতে হ্যাজাক লাইট কিংবা লণ্ঠনের আলোতে রাতভর কুঁচ-টোটা ডালা শিকারে মাছ ধরা বড় আনন্দের। কোথাও কোথাও জলিধান বা জলজ ঘাসে মাছের ঠোকরানোর ফলে নারার নাড়াচারা দেখে মাছের অবস্থান বুঝে কুঁচ দিয়ে নিরাগ মারার সুযোগও পেতে পারেন। হাওরের খোলা আকাশ, নির্মল মুক্ত বাতাস আপনাকে প্রশান্তি এনে দেবে। পলো দিয়ে মাছ ধরার মজাই আলাদা। লাফানো তাজা ফ্রেশ মাছ ভেজে খেতে পারেন। বিভিন্ন রকম নকশি আঁকা পিঠাপুলির জন্যও হাওর বিখ্যাত। বিখ্যাত নকশিকাঁথা ও কুটির শিল্পের বিকাশও সম্ভব। প্রাচীন গ্রন্থে পূর্ববঙ্গকে উড়াল পঙ্খির দ্যাশ বলে অভিহিত করা হতো। হাওর এলাকাকে উড়াল পঙ্খির দ্যাশ নামেও ডাকা হয়। পুঁটি মাছে ঠোকর দেবার আশায় এক টেঙ্গে দাঁড়ানো ধ্যান মগ্ন ঋষি বক, গাঙ চিলের মাছ নিয়ে কাড়াকাড়ি, পান কৌড়ির ডুব, চিলের ছোঁ মারা, বিচিত্র রঙের, বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কিচির মিচির, ডানা জাপ্টার কানফাটা শব্দ শুধু হাওরেই শোনা সম্ভব। সুদূর সাইবেরিয়ার প্রচণ্ড শীত হতে বাঁচতে, প্রজন্ম প্রসারিত করতে, ডিমে তা দিতে বা একটু উম তাপ নেয়ার আশায় উড়াল পঙ্খি অতিথি পাখিরা ছুটে আসে হাওরের প্রকৃতির অবারিত গীতবিতানে। মেঘমুক্ত নীলাকাশে, সাঁঝ বেলায়, মুক্তার মালার মতো দল বেঁধে জঙ্গলি পাখির উড়াউড়ি কেবল উড়াল পঙ্খির দ্যাশ নামে পরিচিত হাওরেই সম্ভব।


হাওরের বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত  নৌকা বাইচের তলাতে বিভিন্ন আকার, আকৃতির, রঙের ‘দৌড়র নাও’ এ মাঝি মাল্লা সোয়ারিরা রঙ বেরঙের পোশাক পরে, ড্যামি বাঘ, ভাল্লুক, হাতি ঘোড়া, মুখে সারিগান ‘লাশারিক’ আল্লাহ বলে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতো। হাওরে পর্যটনকে কেন্দ্র করে এ ঐতিহ্যকে পুনঃজীবিত করার সুযোগ রয়েছে এখনও। আমাদের পার্বত্য এলাকা ও বিশ্বের অনেক স্থানে পেশাদার দল দিয়ে পর্যটকদের সামনে নিজস্ব লোকজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করে। ময়মনসিংহ গীতিকার চারণভূমি হচ্ছে হাওর এলাকা। হাওরের আলো বাতাস, জলীয় পরিবেশ বর্ষার অফুরন্ত অলস সময় এবং বৈচিত্র্যের প্রাণান্তর মানসিকতা হয়তো মানুষকে ভাবুক করে সৃষ্টি করেছে অনেক জগত বিখ্যাত মনীষিদের। ভাটি-বাংলার বীর হিসাবে খ্যাত বীর ঈশা খাঁর মতো স্বাধীন চেতা মানুষ বা বর্তমান যুগসাধক শাহ আবদুল করিম, হাছন রাজার মতো মনীষীদের জন্ম এ হাওর ভাটি এলাকায়। হাওর কালচারাল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে এগুলোকে লালন, পালন থারণ করে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা নিলে কতই না ভালো হতো। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য উপজাতি কালচারাল একাডেমি হলেও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ ২ কোটি হাওরবাসীর জীবন, কৃষ্টি, কালচার ও ঐতিহ্য রক্ষায়  আবশ্যকীয়ভাবে কালচারাল একাডেমিসহ আরও সংশ্লিষ্ট কিছু হওয়া সময়ের দাবি। ড. দীনেশ সেন বা আর আমাদের প্রিয় লেখক ড. হুমায়ূন আহমেদ হাওরের কালচারাল খনি হতে কিছু মনি আহরণের চেষ্ঠা করেছিলেন। এতেই বিশ্ববাসী বিস্মিত, চমকিত এবং মাতোয়ারা। কিন্তু এর বিশাল ভাণ্ডার এখনও অনাহরিত রয়েছে অনেক কিছু। সংরক্ষণ না করলে, বর্তমান পরিস্থিতিতে না চর্চায় কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। পর্যটন বিনোদনের অন্যতম উপাদান হতে পারে এরা এদের সংস্কৃতি ও সুন্দরের আবাহন। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন এবং হাওর উন্নয়ন বোর্ডকে হাওরের দিকে নজর ও গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসা দরকার জরুরিভাবে।


পানির মাঝে আকণ্ঠ নিমজ্জিত জারুল হিজল তমাল, জলজ বৃক্ষবাগ এবং জল পাখির উড়াউড়ি, আর মাছ নিয়ে কাড়াকাড়ি অবাক করে দেয় পর্যকদের। বর্ষায় পানির মধ্যে পূর্ণিমা রাতে চাঁদের ঝিকিমিকি আলোর নাচন, পানি ও চাঁদের মিতালি, চাঁদের টানে পানি ফুলে ফেঁপে উঠা আপনার মনের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলবে নিঃসন্দেহে। ভাবুক হয়ে গেয়ে উঠবেন, মন মাঝি তোর বৈঠানেরে, আমি আর বাইতে পারলাম না। বর্ষায় পানির চান কপাইল্ল্যা ঢেউ, আর শীতে সবুজ ধান ক্ষেতে বাতাসের ঢেউ ঢেউ খেলা বড়ই মনোমুগ্ধকর। চাঁদনী রাতে পালাগান, বাউলগান, ভাটিয়ালি, জারিগান, সারিগান, ঘাটুগান, যাত্রা দলের আসর, কীর্তন, লাঠি খেলা বা কিচ্ছার আসর, বাউলের বাহাস এক সময় ছিল বেকার অলস বর্ষায় হাওরে নিত্য নৈমিত্তিক আবশ্যকীয় ঘটনা। পানসি নৌকা হয়ত এখন আর পাওয়া যাবে না কিন্তু বড় বড় গয়না নাও, ট্রলার, লঞ্চ বা স্টিমার জলযানে ভরা বর্ষায় পূর্ণিমার রাতে পরিকল্পিত নৌভ্রমণ রোমাঞ্চকর ঘটনা হবে। এত হরেক রকমের আয়োজন থাকবে।


দ্বিমুখীরা বলে থাকেন, আমাদের বিপরিতমুখী রাজনীতিবিদদের ভরা বর্ষায় পূর্ণিমার রাতে হাওরে ভাসমান জলযান সোনার তরীর খোলা ছাদে ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দেখবেন, তাদের মাঝে ‘ভাব’ হয়ে গেছে। শূন্য এ বুকে চারদিকে শব্দ ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতো। হাওর পুত্র ড. নিয়াজ পাশার ভাষায়... স্বপ্ন দেখছি, হাওরে সোনার তরী, স্বপ্নডিঙা, ভ্রমণ হবে বৈচিত্র্যপূর্ণ, চিত্তাকর্ষক, মনোমুগ্ধ ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় ভরপুর। নোঙর করবে এ স্বপ্নডিঙা, সমুদ্রের টিপ, সিংহল দ্বীপসম হাওরের কৃত্রিম ও পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট  জলপুরীতে। পানিকে কেন্দ্র করে একে জলপুরী হিসেবে গড়ে বিনোদনের সব উপকরণ ও অবকাঠামো দিয়ে সাজানো হবে। জলপুরীর পাশে পাখি ও মাছের জন্য অভয়ারণ্য তৈরি করে এগুলোর জীবন্ত চিড়িয়াখানায় রূপান্তর করা যায়। পর্যটকরা মন ভরে উপভোগ করবেন এর সৌন্দর্য, লীলা খেলা ও বিচরণ-আচরণ। পর্যটন বিনোদনের এত রসদ, রস, যশ, উপকরণ এক জায়গায় একত্রে একগুচ্ছে সহজে হাওর ছাড়া কি পাওয়া সম্ভব বাংলার কোথায়ও...?


সমুদ্রসম হাওরের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে গ্রাম বা উঁচু ভিটা সৃজন করে এ পুকুরে জলাশয়ে সারা বছর জল ও স্থলের বিভিন্ন স্তরে মাছ, হাঁস, মুক্তা, পাখি ও ফল-ফলাদি চাষের মাধ্যমে নতুন দিগন্তের নবযুগের শুভসূচনা হতে পারে অনায়াসে। হোটেল, মোটেল, আবাসিক জলযানসহ পর্যটনকে সামনে রেখে একে বিভিন্নভাবে সাজানো হবে। হাওর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আধুনিক যুগোপযোগী করতে হবে। নৌভ্রমণ শেষে সপ্তডিঙা, স্বপ্নডিঙা, সোনারতরী, জলপুরী বিনোদন স্পটে নোঙর করবে। জমির সহজলভ্যতা, পলিউর্বর সোনারমাটি আর অবারিত মুক্ত পরিবেশের জন্য লোকজন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে হাওরে বসতি গড়ে ছিল। কিন্তু বর্তমানে হাওর হতে অভিবাসনের উল্টো স্রোতকে এর মাধ্যমে রুখে দেয়া সম্ভব হবে।


ঢাকার বড় বড় হাউজিং এবং এন্টারটেইনন্টম্যান্ট সোসাইটিগুলো হাওরে সমন্বিত গ্রাম- জলপুরী নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে। নিঃসন্দেহে এটি হবে একটা লাভজনক আনন্দআশ্রম যা সুখ ও সমৃদ্ধির নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে যা প্রকৃত বিনিয়োগ হিসাকে বহুগুণে সমৃদ্ধ হয়ে ফিরে আসবে। হাওরে এখনও কালের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধরে থাকা ঐতিহাসিক স্থাপনা ও অবকাঠামোগুলোকে নতুন সাজে সজ্জিত করে আকর্ষণীয় করে তোলা যেতে পারে। পর্যটন শিল্পের অপার সুযোগও এতে সৃষ্টি হবে।


পরিকল্পিতভাবে কম জীবনকাল উফশী ধানের চাষ, ভাসমান শাকসবজি আবাদ, নিয়ন্ত্রিতভাবে সেচ ব্যবস্থাপনা, মাছের অভয়আশ্রম গড়ে তোলা, জেলেদের আকাল সময়ে সাবসিডি প্রদান, পুরো হাওরকে পর্যটন উপযোগী করে গড়ে তোলার সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নেয়া, পরিকল্পিতভাবে হাঁস চাষ আমাদের অনেক দূরের বাতিঘরে নিয়ে যাবে। শুকনা আর ভেজা বর্ষার হাওর অঞ্চলের অমিত সম্ভাবনাকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগাতে পরিকল্পিত বহুমুখী উদ্যোগ বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে খুলে যাবে অপার সম্ভাবনার দখিনা দুয়ার যেমন হাওরের উদ্দাম ঢেউয়ের মতো ফুলে ফেঁপে উঠবে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্রোতের আর পুষ্টিসমৃদ্ধ হবে বাংলার মানুষ বাংলার সোঁদা মাটির জমিন।

 

কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*

* উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা