Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

গলদা চিংড়ির ব্রুড ও পোনা উৎপাদনে করণীয়

কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে গলদা চিংড়ি চাষ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক খাতে পরিণত হয়েছে। তাই রপ্তানি পণ্য হিসেবে এর গ্রহণযোগ্যতা প্রতিনিয়ত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। লক্ষণীয় যে, দেশের রপ্তানিকৃত মোট চিংড়ির মধ্যে গলদার অবদান শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ।
মাটি ও পানির গুণাগুণ তথা অনুকূল জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে শীর্ষস্থানীয় একটি গলদা চিংড়ি উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। উচ্চ বাজার মূল্য, দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা, এছাড়া স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এই পণ্যের চাষ দেশব্যাপী উত্তরোত্তর সম্প্রসারিত হচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথ করেছে সুপ্রশস্ত।


সাম্প্রতিককালে কোনো কোনো অঞ্চলে ভাইরাসঘটিত সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে কিছু চিংড়ি চাষি বাগদার পরিবর্তে গলদা চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে। প্রাকৃতিক উৎসের পোনা দ্বারা গলদার চাষ শুরু হলেও ক্রমবর্ধমান দ্রুতগতিতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এর চাষ সম্প্রসারিত হয়। চাষের এলাকা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে চাহিদাও বেড়ে যায় অবিশ্বাস্য স্বল্প সময়ে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গলদা চিংড়ির হ্যাচারি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এরই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ১৯৮৬ সনে প্রথম গলদা চিংড়ি হ্যাচারি প্রতিষ্ঠিত হয়।


নির্বিচারে প্রাকৃতিক পোনা সংগ্রহের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে ২০০০ সনে সরকার প্রাকৃতিক উৎস হতে গলদা পোনা সংগ্রহের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলশ্রুতিতে দেশে গলদা চিংড়ি হ্যাচারি শিল্পের বিস্তার ত্বরান্বিত হয়। বর্তমানে দেশে মোট ৮০টি গলদা হ্যাচারি রয়েছে, যা সম্প্রতিপ্রাপ্ত এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়।
গুণাগত মানসম্পন্ন গলদা পোনা উৎপাদনের একমাত্র লক্ষ্য হলো উন্নত গুণাবলির ব্রুড উৎপাদন। গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে মূলত ব্রুড প্রতিপালন করা হয় না। হ্যাচারি ব্যবস্থাপকেরা মধ্যস্বত্ব ভোগীদের কাছ থেকে ডিমওয়ালা মা চিংড়ি সংগ্রহ করে পোনা উৎপাদন করে থাকেন। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, একটি গলদা চিংড়ি হ্যাচারি এক মৌসুমে গড়ে ৫২০টি  ডিমওয়ালা মা গলদা চিংড়ি ব্যবহার করে থাকে। প্রাপ্ত এই তথ্য মোতাবেক ডিমওয়ালা মা চিংড়ির বার্ষিক মোট চাহিদা দাঁড়ায় ৪২,১২০টি। লক্ষণীয় যে, উক্ত চাহিদা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, হ্যাচারিতে ব্যবহৃত মা চিংড়ির শতকরা মাত্র ১৫ ভাগ প্রাকৃতিক উৎস এবং বাকি ৮৫ ভাগ চাষকৃত ঘের বা পুকুর থেকে সংগৃহীত হয়।


মৎস্য বিজ্ঞানীদের সূত্র থেকে জানা যায়, চাষের উৎস হতে সংগৃহীত ব্রুড চিংড়ি বছরের পর বছর ক্রমাগত ব্যবহারের কারণে অন্তঃপ্রজনন সমস্যা দেখা দেয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, থাইল্যান্ডে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া, অন্তঃপ্রজননজনিত কারণে নব্বইয়ের দশকে তাইওয়ানের গলদা চিংড়ির বার্ষিক উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। অন্তঃপ্রজননজনিত কারণে হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, বেঁচে থাকার হার ইত্যাদি হ্রাস পেতে থাকে। ফলে গলদা চিংড়ির বার্ষিক উৎপাদন হার ক্রমে কমে যায়। ফলে গলদা চিংড়ির বার্ষিক উৎপাদন হার কমে যায়।

বাংলাদেশে কার্পজাতীয় মাছের হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার অন্তঃপ্রজননজনিত সমস্যার কারণে উদঘাটন সম্ভব হলেও অদ্যাবধি গলদা চিংড়ির হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার কৌলিতাত্ত্বিক গুণাবলি নিরূপণে কোনো গবেষণা পরিচালিত হয়নি।


এ কথা সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশের বেশির ভাগ গলদা চিংড়ি হ্যাচারি ব্যবস্থাপক গুণগতমান সম্পন্ন পোনা উৎপাদনের উদ্দেশ্যে প্রাকৃতিক উৎস  থেকে ডিমওয়ালা গলদা চিংড়ি সংগ্রহ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। লক্ষণীয় যে, অতিআহরণ প্রাকৃতিক  আবাসস্থল নষ্ট, দূষণ ইত্যাদি কারণে প্রাকৃতিক উৎসের ডিমওয়ালা গলদা চিংড়ি অনেকটা দুষ্পাপ্য হয়ে পড়েছে। ফলে অনেক হ্যাচারি ব্যবস্থাপক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রাকৃতিক উৎসের ডিমওয়ালা গলদা চিংড়ি সংগ্রহ করতে পারেন না। অপরপক্ষে, চাহিদা বেশি থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই সরবরাহ ও হ্রাস পায়। এ অবস্থায় এদের বাজারমূল্যও হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। প্রায় লক্ষ করা যায়, হ্যাচারি ব্যবস্থাপকগণ অসাধু মধ্যস্বত্ব ভোগীদের কারণে বাধ্য হয়ে ঘের বা পুকুরে উৎপাদিত ডিমওয়ালা গলদা চিংড়ি ব্যবহার করেন। ব্রুড হিসেবে প্রতিপালনের জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়মমাফিক এদের কোনো পরিচর্যা করা হয় না। তাই চাষকৃত উৎসের এসব চিংড়ি হতে কাক্সিক্ষত মানের কোনো পোনা উৎপাদন সম্ভব হয় না। ফলে অনেক হ্যাচারি  ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এমনও দেখা যায়, বারবার ক্ষতির কবলে পড়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গলদা হ্যাচারি বন্ধ হয়ে গেছে। উপরন্তু, বছরের পর বছর এ ধরনের নিম্নমানের ব্রুড ব্যবহারের ফলে অন্তঃপ্রজনন সমস্যা দেখা দিতে পারে, তা, সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তাই অন্তঃপ্রজনন সমস্যামুক্ত পোনা উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রাকৃতিক উৎস হতে সংগৃহীত ব্রুড অথবা এর সমকক্ষ কৌলিতাত্ত্বিক গুণগতমানসম্পন্ন ব্রুড ব্যবহার করা একান্ত অপরিহার্য।


তবে এ কথাও অনস্বীকার্য যে, প্রাকৃতিক উৎস হতে নির্বিচারে গলদা পোনা ধরার পাশাপাশি খাবারের জন্য চিংড়ির অতিআহরণ এবং এভাবে ডিমওয়ালা চিংড়ি সংগ্রহ করা অব্যাহত থাকলে প্রকৃতিতে ডিমওয়ালা চিংড়ি মজুদের ওপর যে ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সংশ্লিষ্ট বিষয়টি পর্যালোচনা করে নিঃসন্দেহে বলা যায়, হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিক উৎস হতে ব্যাপকভাবে গলদা ব্রুড সংগ্রহ করা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয় এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে গলদা চিংড়ির প্রাকৃতিক মজুদ সংরক্ষণের পাশাপাশি হ্যাচারিতে গুণগতমানসম্পন্ন পিএল উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রাকৃতিক ব্রুডের সমকক্ষ ব্রুড উৎপাদনের কলাকৌশল উদ্ভাবন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।


গুণগতমান সম্পন্ন গলদা ব্রুড উৎপাদন কৌশল
সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে গুণগতমান সম্পন্ন গলদা ব্রুড উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবনের গবেষণা কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে। এই গবেষণামূলক কর্মসূচিতে গলদা চিংড়ির ব্রুড প্রতিপালনের জন্য কতিপয় খাদ্য উপাদানের সমন্বয়ে বিশেষ গুণাবলি সম্পন্ন এক ধরনের খাদ্য তৈরি করা হয়। গুণগতমান সম্পন্ন ব্রুড উৎপাদনে এই খাদ্য দেশীয় বাণিজ্যিক কোম্পানি কর্তৃক উদ্ভাবিত চিংড়ি খাদ্যের তুলনায় উন্নত ও অধিক কার্যকর যা, সংশ্লিষ্ট মৎস্য বিজ্ঞানীদের  অভিমত থেকে জানা গেছে।


গুণগতমান সম্পন্ন ব্রুড উৎপাদন উদ্ভাবিত গলদা চিংড়ির খাবারের ফর্মুলা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
এক. অটোকুঁড়া, মিশ্রণের হার ১১.৫০%। দুই. গমের ভুসি (মিহি) মিশ্রণের হার ১০%। তিন. ভুট্টা মিশ্রণের হার ১২%। চার. সরিষার খৈল মিশ্রণের হার ১০% পাঁচ. সয়াবিন খৈল মিশ্রণের হার ১০%। ছয়. মিট অ্যান্ড বোন মিল মিশ্রণের হার ৩০%। সাত. ফিশ প্রোটিন কনসেনট্রেড মিশ্রণের হার ১০%। আট.  ক্যালসিয়াম মিশ্রণের হার ৫.৩০%। নয়. ভিটামিন মিনারেল প্রিমিক্স মিশ্রণের হার ১%। দশ. বাইন্ডার মিশ্রণের হার ০.২০%।


উক্ত গবেষণামূলক কার্যক্রমে গলদা ব্রুড প্রতিপালনের জন্য বিশেষ নিয়মাবলি অনুসরণ করা হয়। লক্ষ্য করা যায়, গবেষণালব্ধ খাদ্য প্রয়োগ করে ও সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলি মেনে প্রাকৃতিক উৎস হতে সংগৃহীত কিশোর চিংড়ি, পুকুরে পরিমিত মজুদ ঘনত্বে চাষ করে উন্নতমান সম্পন্ন ব্রুড উৎপাদন সম্ভব।
উৎপাদিত ব্রুডের গুণগতমান পরীক্ষার জন্য হালদা নদী ও বাগেরহাট জেলার একটি ঘের হতে ডিমওয়ালা চিংড়ি সংগ্রহ করে একটি গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে তিন উৎসের ব্রুডের প্রথম প্রজন্মের পোনা উৎপাদন করা হয়।


পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, গবেষণা পুকুরে উৎপাদিত ডিমওয়ালা গলদা চিংড়ির গুণাগুণ হালদা নদী হতে সংগৃহীত ডিমওয়ালা গলদা চিংড়ির সমকক্ষ।
হ্যাচারিতে মূলত বিভিন্ন উৎসের প্রথম প্রজন্মের ব্রুড হতে দ্বিতীয় প্রজন্মের পোনা উৎপাদন করা হয়। দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রত্যেক ব্রুড উৎসের পোনার বেঁচে থাকার হার ও উৎপাদন খুবই কম থাকে, যা বাস্তব অন্তঃপ্রজনন সমস্যারই ইঙ্গিতবহ।


সুপারিশমালা তথা গলদা চিংড়ি হ্যাচারি ব্যবস্থাপকদের এ ক্ষেত্রে যা যা করণীয়
এক. গলদা চিংড়ি হ্যাচারি ব্যবস্থাপকগণ প্রাকৃতিক উৎস হতে সংগৃহীত কিশোর চিংড়ি উপযুক্ত পুকুরে মজুদ করে সুষম খাদ্য প্রয়োগের মাধ্যমে গুণগতমান সম্পন্ন ব্রুড উৎপাদন করবেন, মূলত তাদের নিকট এটিই প্রত্যাশা। এছাড়া প্রতি মাসে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার ভরা জোয়ারে নদীর পানি দ্বারা পুকুরের শতকরা ৫০-৮০ ভাগ পানি পরিবর্তন করে নেয়া জরুরি। পুকুরের পানির গভীরতা সারা বছর ৩ ফুট থেকে ৫ ফুট থাকা বাঞ্ছনীয়।


দুই. গলদা চিংড়ি হ্যাচারি ব্যবস্থাপকগণ বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস হতে সংগৃহীত পোনা ভিন্ন ভিন্ন পুকুরে চাষ করে যথাযথ পরিকল্পনামাফিক প্রজননের মাধ্যমে উৎপাদিত ব্রুড়ের কৌলিতাত্ত্বিক উন্নয়ন ঘটাতে পারেন।


তিন. গলদা চিংড়ি হ্যাচারি ব্যবস্থাপকগণ নিজেদের ব্রুডের উৎপাদিত পোনা ভবিষ্যৎ ব্রুড উৎপাদনে ব্যবহার করবেন না এটাই শ্রেয়। নিজেদের ব্রুডের উৎপাদিত পোনা দ্বারা ভবিষ্যত ব্রুড উৎপাদনের পূর্বে অবশ্যই তাদের কৌলিতাত্ত্বিক গুণাবলি পরীক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে ব্রুডের তুলনায় উৎপাদিত পোনার কৌলিতাত্ত্বিক অবনমন ঘটলে তা হতে ব্রুড উৎপাদন কোনো অবস্থারই কাক্সিক্ষত নয়। চার. গুণগতমান সম্পন্ন ব্রুড উৎপাদনের কৌশল সম্পর্কে গলদা চিংড়ি হ্যাচারি ব্যবস্থাপকদের প্রশিক্ষণ প্রদান একান্তই অপরিহার্য।


গলদা চিংড়ি আমাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি রপ্তানি পণ্য এর মাধ্যমে দেশ পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতার দিকে এগোচ্ছে দ্রুতগতিতে। তাই প্রকৃতিতে এই পণ্যের মজুদ তথা সংরক্ষণ অতীব জরুরি। পুকুরে গলদা চিংড়ির গুণগতমান সম্পন্ন ব্রুড উৎপাদনে উদ্ভাবিত খাদ্য ও প্রতিপালন পদ্ধতি ব্যবহার চিংড়ি হ্যাচারির জন্য যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ডিমওয়ালা মা চিংড়ির জোগান নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক উৎসের চিংড়ি ব্রুডের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় ও প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখবে।

 

দলিল উদ্দিন আহমদ*
*প্রাবন্ধিক ও অবসরপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা, মোবাইল : ০১৭২৪০৫০৪০৩