Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

দুর্যোগকালে পশুপাখির জন্য করণীয়

বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের মানুষ, পশুপাখি, উদ্ভিদ প্রতিনিয়তই প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে থাকে, খরা, শীত, সিডর, আইলা, তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়া, অতি বৃষ্টি, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খাদ্যের অভাব, মারাত্মক সংক্রামক রোগ ইত্যাদি নানাবিধ দুর্যোগ উল্লেখযোগ্য।
বছরের বেশির ভাগ সময় আর্দ্র জলবায়ুর প্রভাবে জীব জগতের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে। দেশীয় (
Indigenous) জাতের পশুপাখি এ আবহাওয়ায় কিছু মানানসই কিন্তু উন্নত জাতের (Exotic) মুরগি, শংকর জাতের গবাদিপশু এ আবহাওয়া সহজে সহ্য করতে পারে না। শীতকালে প্রচণ্ড শীতে গ্রামের অসংখ্য হাঁস-মুরগি মারা যায়, দেশে প্রতি বছর বন্যার ফলেও বহু পশুপাখি বিভিন্ন কারণে মারা যায়। প্রাকৃতিক বৈরী আচরণে এসব অবলা প্রাণী সবার আগে আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং কৃষক ভাইয়েরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন।
বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকার দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে মানুষের জন্য বিভিন্ন প্রকার ব্যবস্থা নেয়া হলেও পশুপাখির জন্য যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। বিভিন্ন প্রকার দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য নিম্নে কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হলো-
দুর্যোগকালে গবাদিপশুর জন্য করণীয়
১. খরা-অতিরিক্ত তাপমাত্রার সময় করণীয়  
* এ সময় গবাদিপশুকে শেড বা গাছের নিচে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে।
* তাপমাত্রা কমানোর জন্য শেডের চালের ওপর সম্ভব হলে পানি স্প্রে করতে হবে। পানির পাত্রে বেশিক্ষণ ‘পানি জমিয়ে রাখা যাবে না, পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করতে হবে এবং পানির পাত্রের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে হবে। ট্যাংক থেকে পানি সরবরাহ করা হলে ট্যাংকটিকে কোনো কিছু দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে, যাতে ট্যাংকের পানি গরম হতে না পারে।
* ঘরে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে সিলিং ফ্যান স্থাপন করতে হবে। গরমের সময় পশুর ঘনত্ব কমিয়ে দিতে হবে।
* গরমে পশুর খাদ্য গ্রহণ কমে যায় তাই খাদ্যে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার সরবরাহ করতে হবে। অত্যাধিক গরমের সময় সন্ধ্যা, রাতে ও সকালে খাবার সরবরাহ করতে হবে।
* গরমে গবাদি পশু হিটস্ট্রোক, ধকল,
Mastitis, Anaplasmosis, Thaileriosis, Babesissis, H.S (গলাফুলা), মশা-মাছি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে তাই এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।
২. অতিরিক্ত ঠাণ্ডাকালে করণীয়
* শেডে বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে অথবা চারিদিকে চট-প্লাস্টিকের পর্দা ঝুলিয়ে দিতে হবে, যাতে বাতাস না লাগে, টিনের শেডের ওপর চট-খড় বিছিয়ে দিতে হবে। শেডে অবশ্যই সিলিং থাকতে হবে।
* প্রচ- ঠা-ায় সময় গবাদিপশুর গায়ে চট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। সম্ভব হলে শেডের ভেতরের তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্য ১০০-২০০ ওয়াটের বাল্ব, বৈদ্যুতিক হিটার সংযোজন বা আগুন জ্বালিয়ে রাখা যেতে পারে।
* সুষম খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। কুসুম গরম পানি খাবার দিতে হবে।
* ঠাণ্ডার সময় গর্ভবতী গাভী ও বাছুরের প্রতি বিশেষ যতœ নিতে হবে।
* ঠাণ্ডায় গবাদিপশু সর্দি কাশি ও নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হতে পারে তাই সাবধানে রাখতে হবে।
৩. ঝড়-বৃষ্টি-বন্যার সময় করণীয়
* ঝড় বৃষ্টিতে গবাদিপশুকে ভিজানো যাবে না,
* বন্যার, ঝড়ের অথবা জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস পাওয়ামাত্র পশুকে উঁচু স্থানে স্থানান্তর, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সম্ভব না হলে সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সড়কে বা আশ্রয় কেন্দ্রে নিতে হবে।
* বন্যা বা অতিবৃষ্টির আগে কিছু খড় ও দানাদার খাদ্য সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। বর্ষাকালে সাইলেজ তৈরি করে অথবা ইউরিয়া দ্বারা খড় প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
* বন্যার সময় খুব সমস্যা হলে উঁচু স্থান পাওয়া না গেলে নৌকায় অথবা মাচার উপরে গবাদিপশুকে রাখতে হবে।
* বন্যার  সময় পশু সাধারণত ডায়রিয়া, বাদলা, তড়কা, ক্ষুরারোগ, খাদ্যে বিষক্রিয়াতে আক্রান্ত হতে পারে তাই এ ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।
দুর্যোগকালে হাঁস-মুরগির জন্য করণীয়
১. খরা/অত্যধিক গরমকালীন সময়ে করণীয়
* খামারের হাঁস-মুরগির ঘরে অবাধ বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্সজাস্ট ফ্যানের ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রয়োজনে সিলিং ফ্যানের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
* পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ ঠাণ্ডা পানি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পাত্রের পানি বার বার বদলাতে হবে। ঠাণ্ডা পানির সাথে ভিটামিন ‘সি’ ও ইলেকট্রোলাইট্স দিতে হবে।
* হাঁস-মুরগির ঘরের চালার ওপর চট বিছিয়ে তার ওপর বার বার ঠাণ্ডা পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
* দুপুরে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ রেখে ভোরে ও সন্ধ্যায় খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
* লাইটিং প্রোগ্রামে রাত ২টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে রাত ২টার পর থেকে খাদ্য ও পানি সরবরাহ করতে হবে।
* খামারে জায়গার সংস্থান থাকলে হাঁস-মুরগির ঘনত্ব কমিয়ে দিতে হবে অর্থাৎ ঘরে জায়গার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। রুমের তাপমাত্রা জানার জন্য থার্মোমিটার ঝুলিয়ে রাখতে হবে।
* তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সে. -এ চলে গেলে ঠাণ্ডা পানি মুরগির ওপর স্প্রে করতে হবে। প্রয়োজনে ঘরের মেঝেতে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে।
* রাতে বা খুব ভোরে প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে, অত্যাধিক গরমে নির্ধারিত শিডিউলের ২-৩ দিন পর ভ্যাকসিন দেয়া যেতে পারে।
২. অত্যধিক ঠাণ্ডাকালীন সময়ে করণীয়
* শেডের চারিদিকে চটের বস্তা দিয়ে দিতে হবে যাতে বাতাস প্রবেশ করতে না পারে। শেডের  ভেতরে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা রক্ষা করতে হবে।
* ব্রুডারে প্রয়োজনে বেশি ওয়াটের বাল্ব লাগাতে হবে এবং গ্যাস ব্রুডারে তাপমাত্রা বাড়াতে  হবে। বিদ্যুৎ চলে গেলে ঠা-ার সময় তাপমাত্রা বাড়াবার জন্য হারিকেন বা হ্যাজাকের ব্যবস্থা করতে হবে।
* অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় কুসুম কুসুম গরম পানি এবং পানিতে ভিটামিন ‘সি’ ও এ,ডি,ই সরবরাহ করতে  হবে।
* শেডের মেঝেতে ৪ ইঞ্চি পুরু করে লিটার দিতে হবে। যেন- স্যাঁতসেঁতে না হয়।
* বেশি প্রোটিন ও ক্যালরিযুক্ত খাবার দিতে হবে।
* শেডের চালের নিচ দিয়ে আলো বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা করতে হবে।
* ঠাণ্ডায় সর্দি-কাশি, সিআরডি, ব্রুডার নিউমোনিয়া ও আমাশয়ে আক্রান্ত হতে পারে তাই সজাগ থাকতে হবে।
৩. ঝড়, বৃষ্টি কালীন সময়ে করণীয়
* ঝড়, বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য ঘরে শক্ত খুঁটি দিতে হবে।
* আর্দ্রতামুক্ত পরিবেশে খাদ্য সংরক্ষণ করতে হবে।
* ঘরের আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। লিটার ভিজতে দেয়া যাবে না।
* উঁচু স্থানে গুদাম নির্মাণ করে খাদ্য সংরক্ষণ করতে হবে।
* ঝড়, বৃষ্টির মৌসুম শুরুর আগেই মুরগি, ডিম বাজারজাত করার জন্য যোগাযোগ করতে হবে।
* প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই মুরগি, ডিম বাজারজাতের ব্যবস্থা করতে হবে।
* ঝড়, বৃষ্টির পানি যাতে ঘরে না যায় সেজন্য চারিদিকে চটের বস্তা-রেকসিনের পর্দা দিতে হবে।
* মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই আপদকালীন সময়ের জন্য খাদ্য মজুদ রাখতে হবে।
* বর্ষাকালে বিশেষ করে রানীক্ষেত, পরজীবীজনিত ও ছত্রাকজনিত রোগের আক্রমণ বৃদ্ধি পায় এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
৪. বন্যাকবলিত এলাকায় হাঁস-মুরগির জন্য করণীয়
* হাঁস-মুরগিকে যথাসম্ভব উঁচু ও শুকনো জায়গায় রাখতে হবে।
* হাঁস-মুরগিকে বন্যার দূষিত পানি কিংবা পচা খাবার খাওয়ানো যাবে না।
* নিজেদের আহারের উদ্বৃত্ত খাদ্য নষ্ট না করে হাঁস-মুরগিকে খেতে দিতে হবে।
* হাঁস-মুরগিকে রানীক্ষেত, কলেরা, বসন্ত, ডাকপ্লেগ রোগের প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে এবং মৃত হাঁস-মুরগিকে মাটিতে পুঁতে অথবা পুড়ে ফেলতে হবে।
* শেডের মেঝেতে চুন দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে ছাই, তুষ, কাঠের গুঁড়া বা বালু ছড়িয়ে দিতে হবে। নিয়মিতভাবে তা পরিবর্তন করতে হবে।
ঋতু পরিবর্তন ও দুর্যোগে গবাদিপশুর খাদ্য সংরক্ষণ ও করণীয়
* গাছের পাতা-বন্যার সময় অথবা শুষ্ক মৌসুমে গবাদিপশুর বিকল্প খাদ্য হিসাবে কলা, কাঁঠাল, তুঁত, ডুমুর, ডেউয়া, ইপিল-ইপিল, আম, জিগা, বাঁশ, বট, পাকুড় ইত্যাদি গাছের পাতা ব্যবহার করা যেতে পারে।
* সাইলেজ-সাইলেজ তৈরি করে দুর্যোগের সময় ব্যবহার করা যেতে পারে।
* বর্ষাকালে ইউরিয়া দ্বারা খড় সংরক্ষণ করতে হবে।
* বর্ষার শুরুতে গবাদিপশুকে সংক্রামক রোগের টিকা দিতে হবে।
* বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া ঘাস ও বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর গজানো নতুন ঘাস পশুকে খাওয়ানো যাবে না। যে কোনো সমস্যায় নিকটস্থ পশুসম্পদ দপ্তরের পরামর্শ নিতে হবে।

কৃষিবিদ ডা. মনোজিৎ কুমার সরকার*
*ভেটেরিনারি সার্জন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস, কাউনিয়া, রংপুর