Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

উত্তরাঞ্চলে খাটো জাতের নারিকেল চাষ

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে নারিকেল বেশি উৎপন্ন হলেও উত্তরাঞ্চলে অনেক নারিকেল গাছ দেখা যায়। এসব গাছ থেকে যে সংখ্যক নারিকেল পাওয়া যায় তা জমির ব্যবহারের তুলনায় অনেক কম। এজন্য নারিকেলের জাত চিনে সঠিক পদ্ধতিতে রোপণ করে নিয়মিত পরিচর্যা করলে বেশি সংখ্যক নারিকেল পাওয়া সম্ভব যা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করবে। কারণ নারিকেলের কচি অবস্থায় ডাব এবং  পরিপক্ব অবস্থায় ঝুনা নারিকেলের ব্যবহার প্রায় সারা বছরই হয়ে থাকে। এছাড়াও নারিকেলের প্রায় প্রতিটি অংশই কোনো না কোন কাজে ব্যবহার করা যায়। এর পাতা, ফুল, ফল, কাণ্ড, শিকড় সবকিছ্ইু ছোট বড় বিভিন্ন শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রচুর পরিমাণে আমিষ, শর্করা, ভিটামিন, চর্বি ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ পুষ্টিতে ভরপুর নারিকেলের শাঁস বিভিন্ন পদের মুখরোচক সুস্বাদু খাবার তৈরির উপকরণ হিসেবে অনেকের কাছেই প্রিয়। এছাড়া কচি নারিকেল যা ডাব নামে পরিচিত তার পানি তৃষ্ণা নিবারণে ও রোগীর পথ্য হিসেবেও সমাদৃত। ডাবের পানিতে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশিয়াম থাকে।


অর্থনৈতিকভাবে নারিকেল একটি  গুরুত্বপূর্ণ ফল হওয়ায় এর বাণিজ্যিক চাষের প্রচুর সম্ভাবনা আছে। তবে উত্তরাঞ্চলের আবাদি জমিতে বাগান আকারে চাষ না করে যদি বসতবাড়ি, নদী-খাল-বিল ও পুকুরপাড়ে, রাস্তার পাশে, সরকারি-বেসরকারি অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চারদিকে সুবিধাজনক স্থানে এবং আম, লিচু বাগানের পশ্চিম ও উত্তর দিকে বাতাস প্রতিরোধী গাছ হিসেবে  নারিকেল চাষ করা যায় তাহলে যেমন বাড়তি আয়ের সংস্থান হতে পারে তেমনি পরিবেশেরও উন্নয়ন সম্ভব হবে। বিশেষ করে খাল-বিল-নদীর বাঁধে পরিকল্পিতভাবে নারিকেল গাছ লাগালে এগুলোকে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।


নারিকেলের সব জাতকে গাছের ধরন অনুযায়ী প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। লম্বা জাতের গাছ ও খাটো জাতের গাছ। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে আগে থেকেই লম্বা জাতের নারিকেল চাষ হয়ে আসছে। এগুলো দীর্ঘজীবী, কাণ্ড বেশ লম্বা হয়, প্রায় ৮-১০ বছরের আগে ফুল-ফল ধরে না, পরপরাগায়িত এবং এ গাছগুলো কষ্টসহিষ্ণু ও বেশি মাত্রায় রোগ-পোকামাকড় প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন।


বর্তমানে বাংলাদেশে নারিকেলের তিনটি খাটো জাতের চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ জাতের গাছগুলোতে দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে ফুল আসে এবং তিন থেকে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে ডাব ও ঝুনা নারিকেল সংগ্রহ করা যায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এ জাতগুলোর চাষ সম্প্রসারণে কৃষকদেরসহ সব পর্যায়ের জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ যাতে প্রতারিত না হয় সেজন্য শুধুমাত্র হর্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে খাটো জাতের নারিকেল চারা সংগ্রহ ও বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।


খাটো জাতের হাইব্রিড নারিকেল ডিজে সম্পূর্ণা ডোয়ার্ফ গাছে আড়াই থেকে তিন বছরের মধ্যেই ফল ধরে ও সংগ্রহ উপযোগী হয়। প্রতিটি গাছে বছরে গড়ে ২৫০টি নারিকেল ধরে। এ জাতটি হাইব্রিড হওয়ায় অর্থাৎ এ জাতের গাছ থেকে যেসব পুষ্ট নারিকেল পাওয়া যায় সেগুলো দিয়ে চারা তৈরি করে আবার রোপণ করা যায় না।


এছাড়া ভিয়েতনাম থেকে নারিকেলের  দুটি খাটো জাত আনা হয়েছে। সিয়াম-১ এবং সিয়াম-২ নামের দুটো জাত ভিয়েতনাম থেকে সম্প্রতি আনা হয়েছে। এ জাতের গাছগুলো থেকে আড়াই থেকে তিন বছরে ফল পাওয়া যায়। প্রতিটি গাছে গড়ে ১৫০টি করে নারিকেল ধরে। এ জাতগুলো মুক্ত পরাগায়িত অর্থাৎ এ জাতের গাছ থেকে যেসব পুষ্ট নারিকেল পাওয়া যায় সেগুলো দিয়ে চারা তৈরি করে আবার রোপণ করা যায়।


নারিকেলের জন্য সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ থেকে বেলে দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে উত্তম। বেশি শীত বা বেশি গরম নারিকেলের জন্য যেমন ভালো নয়, তেমনি বেশি বৃষ্টিও ভালো নয়। রোদ থাকলে নারিকেল গাছের বৃদ্ধি ভালো হয়।


বাগান আকারে নারিকেলের চারা রোপণ বর্গাকার বা ষড়ভূজী পদ্ধতিতে রোপণ করা ভালো। বর্ষার আগে এক পশলা বৃষ্টি হলে মধ্য জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য আষাঢ় বা জুন মাস এবং বর্ষার পরে মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য আশ্বিন বা সেপ্টেম্বর মাস নারিকেল চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। একটি চারা থেকে আরেকটি চারা ৬ থেকে বা ১৮ ফুট দূরে দূরে রোপণ করতে হয়। এ হিসাবে প্রতি হেক্টরে ২৭৮টি বা প্রতি বিঘায় ৩৭টি নারিকেল চারা রোপণ করা যায়।


রোপণের আগে ১ মিটার  বা ৩ ফুট চওড়া ও ৩ ফুট গভীর করে গর্ত তৈরি করে গর্তের মাটির সাথে ১৫  থেকে ২০ কেজি শুকনো পচা গোবর বা আবর্জনা পচা সার মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হয়। এর সাথে ফুরাডান জাতীয় কীটনাশক ৫০ গ্রাম মিশিয়ে দিলে মাটিতে থাকা পোকার আক্রমণ থেকে চারা গাছকে রক্ষা করা যায়। গর্তে সার মেশানোর সপ্তাহ খানেক পর সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করে গর্তের মাঝ বরাবর এমনভাবে মাটি সরিয়ে চারা রোপণ করতে হয়, যাতে নারিকেলের খোসা সংলগ্ন চারার গোড়ার অংশ মাটির ওপরে থাকে এবং গোড়ায় মাটি দিয়ে নিচের দিকে ভালোভাবে চেপে দিতে হয়। এতে চারাটি শক্তভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।  রোপণের পর প্রয়োজনমত পানি দিতে হয়।
প্রথম থেকে তৃতীয় মাস পর্যন্ত শুকনো মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা করতে হয় এবং বর্ষায় যাতে গোড়ায় পানি না জমে সেজন্য নিকাশের ব্যবস্থা করতে হয়। ২০ দিন পর পর গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করাসহ পোকা ও রোগের আক্রমণ রোধে দুই সপ্তাহ পর পর বালাইনাশক স্প্রে  করতে হয়।


চতুর্থ, অষ্টম ও ১২তম মাসে চারা প্রতি ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০০ গ্রাম টিএসপি, ৪০০ গ্রাম এমওপি ও ১০ কেজি গোবর সার ভালোভাবে গাছের গোড়ার চারদিকের মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয় এবং ১৫তম মাসে দ্বিগুণ পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হয়। ১৮তম ও ২১তম মাসে ৬৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১২৫০ গ্রাম টিএসপি ও ৮৫০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হয়। সব সময়ই সার প্রয়োগের পর সেচ দিতে হয়। ১৮তম মাসে গাছ প্রতি ১০০ গ্রাম হারে বোরন সার দিতে হয়। ২৪তম মাস বা ২ বছর পর গাছে ৮০০ গ্রাম ইউরিয়া, টিএসপি ২০০০ গ্রাম এবং ১১০০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হয়।


গরু-ছাগল থেকে চারা গাছকে রক্ষা করতে ঘেরা-বেড়ার ব্যবস্থা করতে হয়। আশ্বিন মাসে নারিকেলের গাছ পরিষ্কার করতে হলে শুধুমাত্র শুকনো হেলে পড়া শুকনো ডালই ছাঁটাই করতে হয়। কখনোই সবুজ ডাল বা ডালের অংশ কাটা উচিত নয়। পুষ্পমঞ্জরির যে অংশগুলো শুকিয়ে যায় এবং টান দিলে সহজে উঠে আসে শুধুমাত্র সেগুলোই পরিষ্কার করতে হয়। কখনোই জোর করে বা কাঁচি দিয়ে কেটে গাছ পরিষ্কার করা উচিত নয়। এতে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। একটি বয়স্ক বা ফলন্ত নারিকেল গাছে কমপক্ষে ৩৫ থেকে ৪০টি ডাল থাকলে সে গাছ সর্বোচ্চ সংখ্যক ফল দিয়ে থাকে। হাইব্রিড জাতে দুই বছর পর এবং মুক্ত পরাগায়িত জাতে আড়াই বছর পর ফুল আসে এবং ফলের বয়স ছয় মাস হলে সেগুলো ডাব হিসেবে সংগ্রহ করা যায়। আর ফলের বয়স এক বছর হলে ঝুনা নারিকেল হিসেবে গাছ থেকে পাড়তে হয়।


যদি বিশ্বস্ত উৎস থেকে সঠিক জাত সংগ্রহ ও সঠিক পদ্ধতিতে রোপণ করে নিয়মিত বিভিন্ন পরিচর্যা সুষ্ঠুভাবে করা যায়, তাহলে রোপণ করা নারিকেলের চারার সুষ্ঠু বাড়-বাড়তি নিশ্চিত করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাক্সিক্ষত ফলন এবং উত্তরাঞ্চলের অব্যবহৃত জায়গায় নারিকেল চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে মোট ফলদ উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

 

কৃষিবিদ খোন্দকার মো. মেসবাহুল ইসলাম*
*উদ্যান বিশেষজ্ঞ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রংপুর অঞ্চল, রংপুর