Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ইলিশের অব্যাহত উৎপাদনে অনুসরণীয় কার্যক্রম

বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে লোনা ও স্বাদু পানিতে বিচরিত মাছের বাস্তুসংস্থানের পরিবর্তন হয়। যার সাথে মাছের প্রজননচক্র, মাছের দেশান্তর গতিবেগ, বাঁচা ও মরার হার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। ফলে মাছের মোট উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। অনুরূপভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ও জলজ দূষণের ফলে ইলিশ মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন, নতুন ইলিশের সংযোজন (Recruitment) পদ্ধতি এবং দেশান্তর প্রকৃতির স্বাভাবিক আচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ।


জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে নিম্নে বর্ণিত ইলিশের মজুদের সম্ভাব্য পরিবর্তন হতে পারে-


ক. ইলিশের ঝাঁক মোহনার নিম্নাঞ্চলে স্থানান্তরের সম্ভাবনা;
খ. সাধারণ জেলেদের ইলিশ আহরণ নাগালের বাইরে চলে যাবে;
গ. অস্বভাবিক জলবায়ু এর পরিবর্তনের সাথে সাথে বঙ্গোপসাগরে সাইক্লোনের তীব্রতা বাড়তে থাকবে যার ফলে সাধারণ জেলেদের ইলিশ আহরণ প্রক্রিয়া প্রায় অসম্ভব হবে;
ঘ. গঙ্গা, ব্রক্ষ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর অববাহিকার পানি প্রবাহ হ্রাস পেলে ইলিশের প্রজননে ব্যহত হতে পারে;
ঙ. পানি দূষণের (শিল্পবর্জ্য ও কীটনাশক) ফলে অদূর ভবিষ্যতে ইলিশের প্রজনন ধারাবাহিকতা ব্যাহত হবে।
নিম্নে ইলিশের স্বাদু ও লোনা পানির বার্ষিক আহরণ থেকে বলা যেতে পারে যে, ইলিশের আহরণ দিনে দিনে লোনা পানিতে বাড়ছে (চিত্র-১)। এতে প্রতীয়মান হয় যে, ইলিশের প্রজনন মোহনার নিম্নাঞ্চলে সরে যাচ্ছে ।


ইলিশ আমাদের দেশের মাছ যা ভৌগোলিক নির্দেশক (Geographical Indicator) হিসাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। ইলিশ মাছ প্রাকৃতিকভাবে দ্রুত দেশান্তর প্রকৃতির তবে নদীগুলোর পানির দূষণ ও জলবায়ু ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকলে দীর্ঘমেয়াদে ইলিশের দেশান্তর প্রকৃতির গতি (Migration Route) পরিবর্তন হতে পারে । ইলিশ ডিম পাড়ে স্বাদু পানিতে এবং পরে লবণাক্ত পানিতে ফিরে যায় । অতএব দ্রুত স্থান পরিবর্তনশীল এ প্রজাতির মাছের (ইলিশ) ওপর বাংলাদেশে আরও ফলপ্রসূ গবেষণার প্রয়োজন আছে যেমন-


-ইলিশের প্রকৃত প্রজনন ক্ষেত্র চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়ায় চলমান গবেষণার প্রয়োজন;
 

-শুধু ২২ দিনব্যাপী ইলিশ ধরা ও বিক্রি বন্ধ রাখলেই সন্তোষজনক উৎপাদন সম্ভব নাও হতে পারে যে কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে কৃত্রিম প্রজননও অত্যাবশ্যক;
 

-মোহনার নিম্নাঞ্চলে কৃত্রিম হ্যাচারি ও গবেষণাগার স্থাপন;
 

-দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার জন্য দক্ষ বৈজ্ঞানিকদের কাজ করা;
 

-প্রত্যেক বছর জাতীয় সেমিনারের মাধ্যমে গবেষণার দিকনির্দেশনা প্রদান;
 

-ঞধংশ ঋড়ৎপব গঠন করে ইলিশ মাছের গবেষণার ওপর জোরদার করা ।
 

ইলিশ মাছের ডিমধারণ ক্ষমতা (Fecundity) :
ইলিশ মাছের ডিমধারণ ক্ষমতা ১.৫-২০ লাখ। তবে জলবায়ু পরিবর্তন এর সাথে সাথে ইলিশের ডিম ধারণ ক্ষমতা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে যা গড়ে ১২ লাখে দাঁড়িয়েছে যা ইলিশের মোট উৎপাদন দীর্ঘমেয়াদে উল্লেখ যোগ্যহারে ব্যাহত করবে (Akter, et, ২০০৭)। উল্লেখ্য যে, উভয় প্রকার (স্বাদু ও লবণাক্ত) পানিতে ইলিশের ঝাঁকের ডিম ধারণ ক্ষমতা কমছে ।


জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে ইলিশের লিঙ্গ বৈষম্য (Sex Ratio) :
ইলিশের মজুদ ব্যবস্থপনায় লিঙ্গ বৈষম্য একটি অন্যতম বিশেষ দিক। নিম্নে সময়ের সাথে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্রের লিঙ্গ বৈষম্যের একটি চিত্র বিভিন্ন গবেষকের গবেষণার ফল (টেবিল-১) দেখানো হলো-

ক্রমিক নং এলাকার নাম পুরুষের ও মহিলা ইলিশের অনুপাত Reference
প্রজনন ক্ষেত্র (নিম্নাঞ্চল) ১:১.৬০ Shohidullah et al.., 1999
প্রজনন ক্ষেত্র (নিম্নাঞ্চল) ১:১.৮৬ Anisur Rahman et al., 2015
প্রজনন ক্ষেত্র (নিম্নাঞ্চল) ১:১.৯৪ Anisur Rahman et al., 2017
প্রজনন ক্ষেত্র (নিম্নাঞ্চল) ১:২:০০ Anisur Rahman et al., 2017


টেবিল-১ : জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্রের লিঙ্গের অনুপাত
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ইলিশের ঝাঁকের প্রজনন ক্ষেত্র মোহনায় নিম্নাঞ্চলে সরে যাচ্ছে । ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্রে (নিম্নাঞ্চল) ইলিশের লিঙ্গ বৈষম্য ক্রমান্বয়ে  বাড়ছে (টেবিল-১)। বিভিন্ন গবেষকের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে পুরুষ ইলিশের সংখ্যার চেয়ে স্ত্রী ইলিশের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় পুরুষ ও স্ত্রী মাছের সংখ্যার অসংগতিপূর্ণ বৈষম্য হয়ে দীর্ঘমেয়াদে প্রজনন হার কমে যাবে যার ফলে ইলিশের মোট উৎপাদন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বলা যেতে পারে ইলিশের অব্যাহত উৎপাদনের লক্ষ্যে ২২ দিনব্যাপী ইলিশ ধরা ও বিক্রি বন্ধই  যথেষ্ট নয়, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে ইলিশের কৃত্রিম প্রজননের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক ।
 

ইলিশের প্রজনন চক্র (Breeding Cycle) :  
ইলিশ মাছ প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্য মোতাবেক সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে মোহনা অঞ্চলে ডিম পাড়ে। বর্তমানে ইলিশের Breeding Frequency, প্রজননক্ষম ইলিশ সংরক্ষণ ও মজুদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২২ দিনব্যাপী ইলিশ ধরা ও বিক্রি বন্ধ করেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির প্রধান সহায়ক হিসাবে তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে ইলিশের ডিম ধারণ ক্ষমতা ও অসম লিঙ্গ বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে, যা দীর্ঘয়োদে ইলিশের উৎপাদন ব্যাহত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে । এ অবস্থায়, কৃত্রিম প্রজনন বাস্তবায়ন এবং ক্ষেত্র তৈরির মতো বিকল্প ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা অতিব জরুরি।


ইলিশ মাছের কৃত্রিম প্রজনন (Artificial Breeding) :
বর্তমানে বাংলাদেশে এখনও ইলিশের কৃত্রিম প্রজনন এর জন্য কোনো হ্যাচারি স্থাপনাসহ অন্য কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট একটি গতিশীল গবেষণালব্দ ইনস্টিটিউট যেখানে এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। বর্তমানে মৎস্য অধিদপ্তর ইলিশের গবেষণালব্দ ফল সরকারি পর্যায়ে বাস্তবায়ন করছে তা নিঃসন্দেহে  প্রসংশার যোগ্য। প্রবন্ধকার  ড. মো. শহীদুল্লাহ মিয়া ১৯৮৭-১৯৯৯ সাল পর্যন্ত পুকুরে ইলিশ মাছ চাষসহ ইলিশ মাছের মজুদ নিরূপণসহ ইলিশের গতিবিদ্যা গবেষণায় সরাসরি জড়িত ছিলেন।


ইলিশের দেশান্তর প্রকৃতি ও প্রজনন বৈশিষ্ট্য Atlantic Salmon প্রজাতি মাছের অনুরূপ। উন্নত দেশে স্যামন মাছের প্রজনন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন ঘটেছে। উন্নত বিশ্বে (ইউরোপিয়ান দেশ, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও আমেরিকাতে) স্যামন মাছের কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমে সফল হয়েছে যদিও স্যামন মাছ ইলিশ প্রজাতির মতোই দেশান্তর প্রকৃতির Anadromous । এ মাছটিও স্বাদু ও লবণাক্ত পানিতে বিচরণ করে প্রাকৃতিকভাবে স্বাদু পানিতে ডিম পাড়ে। স্যামন মাছের কৃত্রিম প্রজননের ফলে এ মাছের উৎপাদনে ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। স্যামন মাছে দ্বিতীয় বছরে পরিপক্বতা আসে এবং এরা সমুদ্র থেকে বিপরীত স্রোতে নদীতে আসে। স্যামন মাছের কৃত্রিম প্রজনন কৃত্রিম উপায়ে স্রোতের মাধ্যমে করা সম্ভব হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ইলিশ মাছের বেলায় কৃত্রিম প্রজনন সম্ভব হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।


এসব বিষয় বিবেচনা করে ইলিশ মাছের কৃত্রিম প্রজননের জন্য বাস্তবমুখী গবেষণা কার্যক্রম, পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এখন অতিব জরুরি এবং এটি সময়ের দাবি।

 

অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল্লাহ মিয়া*
*পরিচালক, কলেজ অব এগ্রিকালচারাল সাইন্সেস, আইইউবিএটি বিশ্ববিদ্যালয়, drshohidullah@iubat.edu # ০১৭৪৮১৯০৪৭৪