Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কামরাঙা শিম

কামরাঙা শিম বরবটি ও দেশি শিমের মতো লতা জাতীয় উদ্ভিদ। এ শিম গাছের ফুল, ফল, লতা, পাতা, শিকড় সব অংশই খাওয়া যায়। এ শিমের আদি স্থান পশ্চিম আফ্রিকা। কারও মতে এ সবজি ভারতে প্রথমে চাষ শুরু হয়। দক্ষিণ ও পূর্ব দক্ষিণ এশিয়ায় কামরাঙা শিম আবাদ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। এছাড়া মিয়ানমার, মাদাগাসকার, পাপুয়া নিউগিনি, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় বহু আগে থেকেই এ শিমের অস্তিত্ব দেখা গেছে।  সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশি উচ্চতা (১৫০০-২৫০০ ফুট) বিশিষ্ট স্থানে এ সবজি আবাদের জন্য বেশি উপযোগী। এ সুবিধার কারণে দেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে কামরাঙা শিমের আবাদ প্রচলন বেশি। দেশের উত্তরাঞ্চলেও কোনো কোনো পরিবার সীমিত আকারে এ শিম আবাদ করে। বেশি আর্দ্রতা বিশিষ্ট উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া এ শিম চাষের জন্য বেশি ভালো।
এ সবজি আবাদে পানির প্রয়োজনীয়তা কম হওয়ায় অপেক্ষাকৃত শুকনা এলাকায় কামরাঙা শিম চাষের প্রচলন বেশি। এ ফসল মূলত বসতবাড়ি ও তদসংলগ্ন এলাকায় পরিবারের চাহিদা মেটাতে সীমিত আকারে আবাদ করা হয়। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অন্যান্য সবজির মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিসমৃদ্ধ এ কামরাঙা শিম আবাদ প্রবণতা বেশি দেখা যায় না। ডাল জাতীয় ফসলের মতো জমিতে নাইট্রোজেন যোগ করার ক্ষমতা এ সবজির আছে।  


পুষ্টিমান  ও খাবার উপযোগী অংশ :  কামরাঙা শিম অতি পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ সবজি। মানুষসহ সব প্রাণিকুলের জন্য এ শিম অতি উপাদেয় ও পুষ্টিকর। কচি পাতা সুস্বাদু, পুষ্টিকর শাক হিসেবে খাওয়া যায়। এ শিমের হালকা নীল ফুল সালাদ ও সবজি হিসেবে খেতে অতি চমৎকার। কচি পাতা শুকিয়ে পাউডার করে চায়ের বিকল্প পানীয় হিসেবে ব্যবহার প্রচলন অনেক দেশেই আছে। চার কোণা বিশিষ্ট কচি শিম লম্বায় ১.র্৫র্ -র্২র্  (৪-৫ সেন্টিমিটার) হলে তা সংগ্রহ করে সবজি হিসেবে অতি  সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। সবজি হিসেবে ব্যবহার উপযোগী একেকটা শিমের ওজন প্রায় ৫০-৬০ গ্রাম।  পরিপক্ব শিম লম্বায় র্৫র্ -র্৬র্  ইঞ্চি (১৫-২০ সেন্টিমিটার) হতে পারে। প্রতিটা শিমে ৫-৭টা বীজ থাকে। পুষ্ট বীজ সংগ্রহ করে তা মটরশুঁটি বা শিম বীজের মতো সবজি হিসেবে মুখরোচক ও  উপাদেয়। পুষ্ট কামরাঙা শিমের বীজ শুকিয়ে পাউডার করে কফির বিকল্প পানীয় হিসেবে পান করার প্রচলন অনেক দেশেই আছে। এ গাছের শিকড় মিষ্টি আলুর মতো টিউবার বা মূল গঠন করে। এ আলু বা মূল বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সবজি হিসেবে ও চিপস তৈরি করে আহার করার সুবিধা আছে। গাছের ফুল ও কচি ফল সবজি হিসেবে নিয়মিত সংগ্রহ করা হলে শিকড়ের আকার বেশি বড় হয়। তাতে মূল বা আলুর ফলন বেশি হয়। শাকসবজিতে সাধারণত প্রোটিনের পরিমাণ কম। তবে কামরাঙা শিম গাছের সব অংশই প্রোটিনের উপস্থিতি তুলনায় অনেক বেশি। বীজে প্রোটিনের পরিমাণ সয়াবিনের মতো অত্যাধিক (৩০-৩৯%)। এতে আরও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ভিটামিনস ও মিনারেলস। সোডিয়াম ও কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বেশি থাকে এবং এ সবজি কোলেস্টেরলমুক্ত। অন্যান্য প্রজাতির শিমের চেয়ে ক্যালসিয়ামের উপস্থিতি এতে খুব বেশি, যা হাড় ও দাঁতের সুস্বাস্থ্যের জন্য অতি উপকারী। এ শিমের শিকড়েও প্রচুর প্রোটিন থাকে যা অন্য কোনো প্রকার আলু বা টিউবার জাতীয় ফসলে দেখা যায় না। টিউবার বা শিকড়ে প্রোটিনের উপস্থিতি প্রায় ২০%।  নানা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে এ সবজি বিভিন্ন হারবাল মেডিসিন তৈরির কাজে ব্যবহার প্রচলন বেশি। এ ফসল পুষ্টিকর ‘ফডার’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটি লিগুমিনাস দলীয় ফসল হওয়ার কারণে জমির স্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়োজনে ফসল চক্রে এ শিম আবাদে প্রাধান্য  অন্যান্য দেশে বেশি দেয়া হয়।


বৈশিষ্ট্য : এটা বরবটি বা দেশি শিমের মতো লতানো গাছ। ফলের আকৃতি চার পাখা বা শিরা বিশিষ্ট যা দেখতে অনেকটা কামরাঙা ফলের মতো। সম্ভবত এজন্যই কামরাঙা শিম নামে পরিচিত। এ শিম চওড়ায় কম (২-৩ সেন্টিমিটার) এবং লম্বায় বেশি প্রায় ৮ ইঞ্চি (২০ সেন্টিমিটার)। একটা পূর্ণাঙ্গ শিম গাছ প্রায় ১০-১৫ ফুট লম্বা হয়। প্রতি গাছে মৌসুমে ৪০-৫০টা ফল ধরে। দিনের পরিধি অপেক্ষাকৃত ছোট হলে (১০-১১ ঘণ্টা) গাছে ফুল-ফল ধরা আরম্ভ করে। অনুকূল মৌসুমে বীজ রোপণের ৬-৭ সপ্তাহ পর থেকেই গাছে ফুল ধরা আরম্ভ করে। ফুল ও গাছের আকৃতি দেখতে সুন্দর হওয়ার কারণে সৌন্দর্য আহরণেও অনেকেই বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ অংশে চাষ করে থাকে। ফুল ফোটার ১০-১২ দিন পর কচি শিম আহার উপযোগী হয়। বয়স্ক শিম শক্ত হলে সবজি হিসেবে খাওয়া যায় না। তবে পুষ্ট শিম থেকে বীজ বের করে মটরশুঁটির মতো বিভিন্নভাবে খাওয়া করা যায়। লতানো গাছে ফুল-ফল ধরা আরম্ভ করলে তা থেকে এক টানা পর্যায়ক্রমে প্রায় ৩ মাস পর্যন্ত সবজি সংগ্রহ করা যায়। আফ্রিকাতে বিভিন্ন বাগানে অয়েল পাম, পিচ ফল, কোকো, কাজুবাদাম, রাবার আচ্ছাদন ফসল (ঈড়াবৎ পৎড়ঢ়) হিসেবে এ সবজির আবাদ জনপ্রিয়তা বেশি। তাতে আগাছা দমনসহ, লতা-পাতা ও শিকড় পচে বাগানে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ে। এছাড়া এ শিম জমিতে রাইজোবিয়াম (নাইট্রোজেন) সার যোগ করতে সামর্থ্য হয়। এ ব্যবস্থায় জমিতে রস সংরক্ষিত থাকে, পানি সেচ কম লাগে, সর্বোপরি বাগানে গাছের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। আমাদের দেশেও ফল বাগানে এ ফসল অনুরূপভাবে আবাদ করে একই সুফল আহরণ করা দরকার।   


জাত :  এ দেশে কামরাঙা শিমের জাত উদ্ভাবনের উদ্যোগ তেমন নেই। তবে বারি কামরাঙা শিম -১ নামে একটা জাত অবমুক্ত করেছে। দেশি জাতগুলো মূলত আলোকসংবেদনশীল। তাই এ সবজি হেমন্ত, শীত ও বসন্তকালে দিনের আকার ছোট থাকা অবস্থায় চাষ করা হয়। বিদেশে নানা প্রজাতির এ শিম দেখা যায়। কোনো কোনো বিদেশি জাত বড় দিনেও অর্থাৎ গ্রীষ্ম-বর্ষায় ফুল-ফল ধরে যা এদেশে আবাদ প্রচলন ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তাতে বছর ধরে এ গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিকর সবজি অসময়ে প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে।


চাষ পদ্ধতি :  বরবটির বা দেশি শিমের মতো সারি করে বীজ বপন করে আবাদ করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতি সারির মাটি ২০-২৫ সেন্টিমিটার গভীর করে কুপিয়ে মাদা তৈরি করে নেয়া প্রয়োজন। বেশি ফলন পেতে তৈরি মাদায় যথেষ্ট পরিমাণ জৈব সার মিশিয়ে নেয়া ভালো। অন্য ফসলের মতো কামরাঙা শিম চাষের জন্য খুব বেশি উর্বর জমির প্রয়োজন হয় না। অনুর্বর বেলে বা এঁটেল মাটিতেও এ ফসল ভালো ফলে। আবাদে খুব একটা বেশি সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। তবে পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত উঁচু জমি এ সবজি আবাদের জন্য বেশি ভালো। ৩০-৪৫ সেন্টিমিটার চওড়া এবং ২.৫৪ সেন্টিমিটার লম্বা মাদায় ৫০০ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি এবং এমওপি মিলে প্রায় ১৫০০ গ্রাম সার জমি তৈরি কালে প্রয়োগ করা হলে ফলন ভালো হয়। চারা গাজানোর প্রায় ৩ সপ্তাহ পর ২০ দিনের ব্যবধানে এতে  আরও ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া সার ২-৩ কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করা ভালো। ঠিকমতো আলো-বাতাস পায় এমন স্থানে এ সবজির ফলন ভালো হয়। উন্মুক্ত আধা ছায়াতেও এ সবজি ফলানো যায়। তবে বেশি ছায়ায় ফসল ভালো হয় না। সাধারণত পরিবারের চাহিদা মেটাতে এ সবজির আবাদ করার প্রচলন বেশি। পার্বত্য জেলার অধিকাংশ পরিবার এ ধরনের শিম চাষে বেশি আগ্রহী। তারা নিজের চাহিদা পূরণ করে অতিরিক্ত শিম বিক্রি করে বাড়তি আয় করে থাকে।


বীজ বপন : বীজের আবরণ খুব শক্ত হওয়ায় অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা কম (৪০-৫০%)। এজন্য বীজ বপনের আগে তা ২০-৩০ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে নেয়া উত্তম। সাধারণত ৮-১০  ইঞ্চি (২০-৩৫ সেন্টিমিটার) দূরত্বে র্১র্  ইঞ্চি (২-৩ সেন্টিমিটার) গভীরতায় বীজ বপন করা হয়। এক সারি হতে অন্য সারির দূরত্ব হবে ৩-৪ ফুট (প্রায় এক মিটার)। বীজ বপনের ৫-৭ দিনের মধ্যে তা গজিয়ে দ্রুত বাড়তে থাকে। এ ভাবে ৪-৫ সপ্তাহ বৃদ্ধির পর অনুকূল আবহাওয়ায় দিনের পরিধি কমে (১০-১১ ঘণ্টা) গেলে গাছে ফুল ফোটা আরম্ভ করে। কাঁকরোলের মতো কামরাঙা শিমের শিকড় থেকেও চারা তৈরি করা হয়। মৌসুম শেষে অনেকে বয়স্ক গাছের শিকড় সংগ্রহ করে রেখে দেয় পরে শরৎ-হেমন্ত কালে তা পুনরায় বীজের বিকল্প হিসেবে রোপণ করে থাকে।  


অন্য ফসলের মতো এ সবজি মাঠ ফসল হিসেবে আবাদ প্রচলন নেই। বাড়ির আঙিনায় শিম, বরবটি, শশা, করলার মতো ১.৫-২.০ সেন্টিমিটার লম্বা কাঠির বাউনি বা ছোট আকারের মাচা তৈরি করে তাতে উঠিয়ে আবাদ ব্যবস্থা নেয়া হয়। সীতাকু- মডেলে কাঠি বা কঞ্চি খাঁড়া করে দিয়ে বাউনির ব্যবস্থা করে খুব সহজেই এ সবজি চাষ করা যায়। এ সবজির লতা, ফুল, ফল সবই দেখতে সুন্দর হওয়ায় এবং সৌন্দর্য ও ফলন উভয় প্রাপ্তির লক্ষ্যে বাগানোর গুরুত্বপূর্ণ অংশে অনেকে এ সবজি আবাদ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।


পরিচর্যা : বীজ বপনের পর মাটি বেশি শুকনা হলে তা গজাতে বিলম্বিত হতে পারে। তাই মাটিতে রসের অভাব হলে ২-৩ দিনের ব্যবধানে হালকাভাবে সেচ দেয়া ভালো। চারা গজিয়ে এক ফুট লম্বা হলে আগা ভেঙে দেয়া প্রয়োজন। তাতে শাখা-প্রশাখার সংখ্যা বাড়বে, ফুল-ফল বেশি দিবে। লতানো গাছে বাউনি হিসেবে ২.৪-৩.০ সেন্টিমিটার লম্বা কাঠি দেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি দুইসারির কাঠির আগা বেঁধে দিলে উভয় দিক থেকে বাড়ন্ত লতা সুন্দরভাবে বাড়তে সহায়ক হয়। বিকল্প ব্যবস্থায় করলা, বরবটি, শশার মতো কম চওড়া বিশিষ্ট মাচা দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। শিম গাছের গোড়ার মাটিতে রসের অভাব হলে মাঝে মাঝে হালকা সেচ দেয়া প্রয়োজন। তবে খেয়াল রাখতে হবে গাছের গোড়ায় কোনো ক্রমেই যেন পানি  না জমে। এজন্য জমিতে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখা জরুরি। জমি সব সময় নিড়ানি দিয়ে আগাছামুক্ত ও মাটিতে চট ধরলে মাটি আগলা করে দেয়া দরকার। এ শিমে পোকা ও রোগের উপদ্রব খুবই কম।


ফলন : প্রতি গাছ থেকে প্রায় ৪০-৬০টা কচি সবজি আহরণ করা যায় এবং সংগৃহীত এ গাছের সবজির পরিমাণ প্রায় ৪-৫ কেজি হয়। এ ব্যবস্থায় প্রতি পরিবারে সীতাকু- মডেলে স্বল্প পরিসরে ২০-৩০টা  এ শিম গাছ রোপণ করা হলে তাতে একেক পরিবারের জন্য প্রায় ১০০-১২৫ কেজি মৌসুমে সবজির প্রয়োজনীয়তা মেটানো যায়।
এ সবজির পাতা, ফুল, ফল, বীজ, শিকড়, সবই অতি পুষ্টিকর ও আহার উপযোগী এবং ভেষজ ঔষধিগুণসমৃদ্ধ  হওয়ার কারণে এ ফসলের সুফল আহরণ করা প্রত্যেকেরই কর্তব্য।  পুষ্টিসমৃদ্ধ এ শিম প্রতিটা বসতবাড়িতে এবং বাড়ির ছাদে আবাদের জন্য অতি উপযোগী। বহুবিদ ব্যবহার উপযোগী মানুষ ও পশুপাখির জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ এ গুরুত্বপূর্ণ সবজি সম্প্রসারণ করার দ্রুত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

এম এনামুল হক*
*মহাপরিচালক (অব.), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং সদস্য বিশেষজ্ঞ টিম (অচঅ), কৃষি মন্ত্রণালয়