Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

জলবায়ু সহনশীল গম উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা

গম বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। এর পুষ্টিমান অত্যন্ত বেশি এবং বহুবিদ খাদ্য তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বোরো ধান ও অন্যান্য শীতকালীন ফসলের তুলনায় গম আবাদ করা সুবিধাজনক, যেমন- পানি কম লাগে, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম, পরিবেশবান্ধব ইত্যাদি। বর্তমানে দেশে ৭০ লক্ষ টন বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১১.৫৩ লক্ষ টন। গমের বহুবিদ ব্যবহার ও মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর এ চাহিদার পরিমাণ প্রায় ১৫% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিকূল আবহাওয়া সত্ত্বেও  কৃষক কর্তৃক গমের উচ্চফলনশীল নতুন জাত ও আধুনিক উৎপাদন কলাকৌশল গ্রহণের ফলে সম্প্রতি গমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০১৭-১৮ মৌসুমে হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৩.২৮ টনে উন্নিত হয়েছে। এতদ্বসত্ত্বেও, দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে সারা দেশে গমের উৎপাদনশীলতা আরও বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য প্রয়োজন পরিবর্তনশীল জলবায়ু সহনশীল আধুনিক জাত ও ফসল ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির ব্যাপক প্রচলন।


জাত পরিচিতি    
যে কোনো ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভালো জাত নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গমের নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলো সাধারণত পুরনো জাত অপেক্ষা অধিক ফলনশীল। উচ্চফলনশীলতার গুণ ছাড়াও গমের নতুন জাতগুলো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো :

 

তাপ সহিষ্ণু : শীতের তীব্রতা ও স্থায়িত্ব কম হলেও ফলন তেমন হ্রাস পায় না। দেরিতে বপনেও আশানুরূপ ফলন দেয়। গমের পরিপক্বতা পর্যন্ত পাতা সবুজ থাকে ও পরিপুষ্ট দানা পাওয়া যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন।
 

শীষের সংখ্যা বেশি : গাছে কার্যকর কুশির পরিমাণ বেশি হওয়ায় প্রতি বর্গমিটারে শীষের সংখ্যা বেশি থাকে।
প্রতি শীষে পুষ্ট দানার সংখ্যা বেশি বাংলাদেশে উদ্ভাবিত গমের ৩৩টি জাতের মধ্যে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি যে ৯টি গমের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে সেগুলো পরিবর্তিত আবহাওয়াতেও ভালো ফলন দিচ্ছে। তবে বারি গম ২৬ জাতটি গমের ব্লাস্ট রোগ সংবেদনশীল হওয়ায় বাংলাদেশের ব্লাস্ট প্রবণ এলাকা বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আবাদ না করে বারি গম ৩০ (গমের ব্লাস্ট রোগ সহনশীল) ও বারি গম ৩৩ (গমের ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী) জাতের আবাদ করা নিরাপদ ও উত্তম। তাছাড়া বারি গম ৩৩ জাতটি জিঙ্কসম্মৃদ্ধ (দানায় জিঙ্কের পরিমাণ ৫০-৫৫ মিগ্রা./কেজি) ও সহজে হেলে পড়ে না।

 

বীজ শোধন : বপনের আগে প্রতি কেজি বীজের সাথে ৩ গ্রাম হারে প্রোভ্যাক্স-২০০ ডব্লিউপি ছত্রাকনাশক মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। বীজ শোধন  করে বীজ বপন করলে বীজবাহিত রোগজীবাণু দমন হবে এবং ফলনও বাড়বে। প্রদর্শনীর জন্য কীটের সাথে সরবরাহকৃত বীজ শোধন করেই দেয়া আছে।


জমি তৈরি ও বীজ বপন : পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর দ্বারা চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে ও আগাছামুক্ত করে জমি তৈরি করতে হবে। শেষ চাষের আগে নির্ধারিত পরিমাণ সার প্রয়োগ করে একটি হালকা চাষ ও মই দিয়ে ২০ সেমি. (৮ ইঞ্চি) পর পর সারি করে বীজ বপন করতে হবে। বীজ বপনের উপযুক্ত সময়  ১-১৫ অগ্রহায়ণ (১৫-৩০ নভেম্বর)। বীজের হার : ৫০-৬০ কেজি/একর।


সারের পরিমাণ (প্রতি একরে) :  ইউরিয়া ঃ ৯০ কেজি (প্রাথমিক প্রয়োগ ৬০ কেজি ও উপরিপ্রয়োগ ৩০ কেজি), টিএসপি : ৫৫ কেজি, এমওপি :  ৪০ কেজি, জিপসাম : ৪৫ কেজি, বরিক এসিড : ৩.০০ কেজি।


সার প্রয়োগ পদ্ধতি : নির্ধারিত ইউরিয়া সারের ২/৩ ভাগ ও অন্যান্য সব সার শেষ চাষের আগে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে এবং হালকা চাষ ও মই দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।  বাকি ১/৩ ভাগ ইউরিয়া প্রথম সেচের পর (বপনের ১৭-২১ দিনের মধ্যে) উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।  প্রতি একরে ৩০০০ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার চাষের শুরুতে প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে।
 

সেচ প্রয়োগ :  মাটির প্রকারভেদে গম চাষে সাধারণত ২-৩টি সেচের প্রয়োজন হয়। প্রথম সেচ  : তিন পাতা অবস্থায় (বীজ বোনার ১৭-২১ দিনের মধ্যে) প্রথম সেচ দিতে হবে। জমিতে অতিরিক্ত রস থাকলে এ সেচটি কয়েক দিন পর দিতে হবে। দ্বিতীয় সেচ  : শীষ বের হওয়ার আগে (বীজ বোনার ৫০-৫৫ দিনের মধ্যে) দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে।

তৃতীয় সেচ  : দানা বাঁধার প্রাথমিক পর্যায়ে (বীজ বোনার ৭০-৭৫ দিনের মধ্যে) তৃতীয় সেচ দিতে হবে। হালকা বেলে বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে ভালো ফলন পেতে হলে নির্ধারিত সেচ ছাড়াও অতিরিক্ত ১-২টি সেচের প্রয়োজন হতে পারে। সেচ কিংবা বৃষ্টির পানি জমলে অতি সত্বর পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাই বীজ বোনার পর পরই পানি নিষ্কাশনের জন্য জমির ঢাল বুঝে আনুমানিক ২০ ফুট অন্তর অন্তর  নালা কেটে রাখতে হবে যাতে সেচ বা বৃষ্টির পর পানি সহজে বের হয়ে যায়। কোনো অবস্থাতেই জমিতে পানি আটকিয়ে রাখা যাবে না।


আন্তঃচাষ পরিচর্যা : বপনের পর হতে ১০-১২ দিন পর্যন্ত অবশ্যই পাখি তাড়াতে হবে কিন্তু পাখি মারা যাবে না।  ভোর বেলা ও সন্ধ্যা বেলা পাখির উপদ্রব বেশি হয় তাই এই সময় খুবই সতর্ক থাকতে হবে। প্রথম সেচের পর মাটিতে জোঁ এলে নিড়ানি/আগাছানাশক দিয়ে আগাছা দমন করতে হবে। চওড়া পাতা জাতীয় আগাছা যেমন বথুয়া, কাঁকড়ি, বিষকাঁটালি, শাকনটে, কাঁটানটে ইত্যাদি দমনের জন্য এফিনিটি (আগাছানাশক) ব্যবহার করা ভালো। প্রতি ২০ শতাংশ জমির জন্য ১০০ গ্রাম এফিনিটি পাউডার ৪০ লিটার পানিতে মিশিয়ে চারার ২৫-২৮ দিন বয়সে প্রয়োগ করলে আগাছা দমনে ভালো ফল পাওয়া যায়। এফিনিটি মাত্রার বেশি প্রয়োগ করলে কিংবা গমের ২৫ দিন বয়সের আগে প্রয়োগ করলে গমের ক্ষতি হতে পারে। এফিনিটির মাত্রা কম হলে কিংবা ৩০ দিন বয়সের পর প্রয়োগ করলে আগাছা পুরাপুরি দমন হবে না।


গমের ব্লাস্ট এবং অন্যান্য রোগ দমনের জন্য প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে শীষ বের হওয়ার সময় একবার এবং ১২-১৫ দিন পর আর একবার ৫ শতাংশ জমির জন্য ৬ গ্রাম নাটিভো ৭৫ ডব্লিউজি অথবা ১০ মিলি ফলিকুর ২৫০ ইসি বা এমিস্টার টপ ৩২৫ এসসি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করলে গমের পাতা ঝলসানো রোগ, বীজের কালো দাগ রোগ, মরিচা রোগ ইত্যাদিও দমন হবে। এতে গমের ফলন ও বীজের মান বৃদ্ধি পাবে। ইঁদুর গমের অন্যতম শত্রু এবং অতি চালাক প্রাণী। তাই বিষটোপ, ফাঁদ, গ্যাস ট্যাবলেট, গর্তে পানি ঢালাসহ বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে ইঁদুর অবশ্যই দমন করতে হবে।


বীজ সংরক্ষণ : গম মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের পর বীজ কয়েক দিন হালকা রোদে এমনভাবে শুকাতে হবে যাতে দাঁত দিয়ে চিবালে কট করে শব্দ হয়। তবে কোনো অবস্থাতেই পাকা চাতাল বা ফ্লোরে গমবীজ কড়া রোদে শুকানো ঠিক নয়, এতে বীজের গজানোর ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমে যায়। ভালোভাবে শুকানোর পর গরম বীজ ঠা-া করে পাত্রে রাখতে হবে। এরপর পুষ্ট বীজ চালুনি দিয়ে বাছাই করে নিতে হবে এবং পরিষ্কার, ছিদ্রমুক্ত ধাতব বা প্লাস্টিকের ড্রাম, টিনের পাত্র অথবা মোটা পলিথিন ব্যাগে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ দ্বারা পাত্র সম্পূর্ণরূপে ভর্তি করে ঢাকনা দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখতে হবে। বীজের পাত্রে ফাঁকা জায়গা রাখা যাবে না। বীজের পরিমাণ কম থাকলে পাত্রের খালি জায়গা শুকনা পরিষ্কার বালু বা শুকনা তুষ অথবা শুকনা নিমপাতার গুঁড়া দিয়ে পাত্র পূর্ণ করে রাখতে হবে। বীজ ভর্তির পর পাত্রের মুখ ঢাকনা দিয়ে ভালোভাবে আটকাতে হবে যাতে বাতাস ঢুকতে না পারে। সে জন্য পাত্রের মুখ বন্ধ করার পর পলিথিন দিয়ে বেঁধে রাখা উচিত। পলিথিন ব্যাগে গম বীজ সংরক্ষণ করতে হলে অবশ্যই শক্ত প্লাস্টিক বস্তার ভেতরে সমান সাইজের মোটা পলিথিন ব্যাগ ঢুকিয়ে বীজ ভর্তি করে মুখ বেঁধে নিরাপদ জায়গায় রাখতে হবে। বীজের পাত্র মাটির সংস্পর্শে রাখা যাবে না। বীজের পাত্র মাচা, বিড়া অথবা তক্তার ওপর এবং ঘরের দেয়াল/বেড়া থেকে একটু দূরে রাখতে হবে। উপরোক্ত নিয়মে সংরক্ষিত গম বীজ পরবর্তীতে আর শুকানোর প্রয়োজন নেই।

 

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, নশিপুর, দিনাজপুর, ০১৭১৭১৩৯১৩৯, ই-মেইল snabibari@gmail.com