Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ভোজ্যতেল আমদানি কমাতে ধানের সাথে সরিষা চাষ

আবহমান কাল থেকে গ্রাম বাংলার মাঠে ঘাটে শীতকালে অসময় যত্রতত্র বুনে দেওয়া হতো সরিষার বীজ। কিন্তু পেট ভর্তি করে খাবার জন্য দানাশস্য বিশেষ করে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে আমাদের জোর দিতে হয়েছিল। ফলে অনুর্বর প্রান্তিক জমিতে তেল ফসলকে চলে যেতে হয়। সরিষা এমন একটি ফসল যা কিনা শুধু ধানের জমিতে নয়, ধান ব্যতীত অন্যান্য ফসলের জমিতেও  ভালোভাবে যে ফলানো যায় তা খনার বচনে প্রমাণ পাওয়া যায়।
সরিষা বুনে কলাই মুগ
বুনে বেড়াও চাপড়ে বুক
যদি একই ক্ষেতে সরিষা ও কলাই মুগ বোনা যায় তাহলে এক সাথে দুটি ফসল পাওয়া যায় তখন চাষি আনন্দে বুক বাজায়।
খনা বলে চাষার পো
শরতের শেষে সরিষা রো।
শরৎকালের শেষে অর্থাৎ আশ্বিন মাসের শেষে সরিষা রোপণের বিশিষ্ট সময়। তবে জাত ও শস্যবিন্যাস ভেদে সরিষা  আগ-পিছ করে লাগানো যেতে পারে। সরিষার বপন সর্ম্পকেও  খনার বচনে সম্যক ধারণা দেওয়া হয়েছে।                                 
সরষে ঘন পাতলা নাই।
নেঙে নেঙে কার্পাস পাই।
কার্পাস বলে কোষ্টা ভাই।
জ্ঞাতি পানি না যেন পাই।
সরিষা বুন ঘন করে এবং রাই কিছু ফাঁক ফাঁক করে বপন করতে হয়। এমনভাবে কার্পাস লাগাতে হবে যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোলা যায়; কার্পাস ও পাট একই ক্ষেতে বোনা উচিত নয়। পাটের জলে কার্পাসের চাষ ক্ষতি করে।
ভোজ্যতেলের জন্য আমরা মারাত্মকভাবে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয় আমাদের। প্রতি বছর প্রায় ২.৩ থেকে ২.৪ মিলিয়ন টন ভোজ্যতেল আমাদের আমদানি করতে হয়, যার মধ্যে ৫৫-৫৮ ভাগ হলো ঢ়ধষস ড়রষ। আমাদের দেশের উৎপাদিত তেলের সিংহ ভাগ আসে সরিষার আবাদের মধ্য দিয়ে। ধানের জমির সাথে পাল­া দিতে গিয়ে সরিষার আবাদ যে বন্ধ হয়ে গেছে তা নয় বরং শস্য বিন্যাস বিশেষজ্ঞ (Croping System Specialist), কৃষি সম্প্রসারণবিদ ও বাংলার কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সরিষা চাষ এখনো ভালোভাবে চলছে। তবে সমস্যা হলো সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে সরিষার জন্য জমি বের করা। সরিষাভিত্তিক শস্য বিন্যাসে ২৪ ধরনের শস্য বিন্যাস রয়েছে যার মোট  জমির পরিমাণ ৫২০৪৭০ হেক্টর (সারণি-১)। যার মধ্যে সরিষা-বোরো-রোপা আমন শস্য বিন্যাস এর জমি ১৮৪৬২ হেঃ এবং সরিষা-বোরো-পতিত শস্য বিন্যাস এর জমি ১৪৩১৩০ হেঃ। আবার বোরো- পতিতরোপা আমন এর আওতায়  সারাদেশে রয়েছে মোট ২৩০৬০০৫ হেঃ জমি, যা প্রকৃত ফসলি জমির  ২৭ ভাগ।  এই শস্য বিন্যাসে   বোরোর পূর্বে সরিষা ফলাতে পারলে  মোট সরিষা উৎপাদন করা যায় প্রায় ২.৬০ মিলিয়ন টন যা থেকে বছরে প্রায় ১.০৪ . মিলিয়ন টন সরিষার তেল পাওয়া সম্ভব।
আমাদের দেশে রয়েছে তিন রকমের সরিষার প্রজাতি, কম বেশি তিনটি প্রজাতিই আবাদ করা হচ্ছে আমাদের দেশে। অনাদিকাল ধরে এদেশের কৃষকভাইরা যে সরিষা আবাদ করে থাকে তা হলো Brassica campestri/rapa প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। কৃষকদের বাছাই করে নেওয়া জাতগুলোর মধ্যে অন্যতম  দুটি জাত হলো টরি ৭ এবং রাই ৫ সরিষা।  রাই ৫ হলো Brassica juncia প্রজাতির স্থানীয় জাত। টরি সরিষাকে স্থানভেদে মাঘী সরিষাও  বলা হয়। এদের ফলন কম বটে তবে ভালো বৈশিষ্ট্য এই যে, ৭০-৮০ দিনের মধ্যে এদের ফসল সংগ্রহ করা যায়। ফলন হেক্টরে ১ টনের কম হলে কৃষক এদের আবাদ করে কারণ শীতকালে মূল ফসল করার ফাঁকে একটি ফসল পাওয়া যায়। সেচ, সার, আগাছা নিড়ানি তেমন লাগেনা বলে এসব জাতের প্রতি কৃষকের এতো আকর্ষণ। সরিষার তৃতীয় প্রজাতিটি  হলো Brassica napus । এটি ইউরোপের একটি উচ্চফলনশীল প্রজাতি। আমাদের স্বল্প মেয়াদি Brassica napus জাতের সাথে ইউরোপের জাতের সংকরায়ন ও ক্রোমোজমের দ্বিগুণিতক করে এবং তা থেকে  বাছাই করে আমাদের দেশের জন্য উপযোগী করে  Brassica napus সরিষা উদ্ভাবন করা হয়েছে।
মানুষ বাড়ছে জমি কমছে সেজন্য ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির চাপ আমাদের রয়েছে, ফলে অল্প জমিতে অধিক ফসল ফলানোর তাগিদও বাড়ছে। সে কারণে সনাতন কম ফলনশীল জাতের চাষ আমাদের কমাতে হচ্ছে। লক্ষ্য হচ্ছে এক জমি থেকে  বছরে তিন ফসল ফলানো। আর এজন্য এমন সব ফসলের জাত প্রয়োজন যেন জমি প্রস্তুতের সময় ব্যতীত বাকি সময়ে তিনটি ফসল কেটে নিয়ে আসা যায়। অনেক শস্য বিন্যাসে, যেমন  সরিষা-বোরো-রোপা আমন-এ তিনটি  ফসলের জাত এমনভাবে নির্বাচন করতে হবে যেন ৩২০-৩৪৫ দিনের মধ্যে তিনটি  ফসলই সংগ্রহ করা যায়। আর এভাবে সফলভাবে তিনটি ফসল ফলাতে পারলে  আমাদের  উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি -এর কৃষি সংক্রান্ত যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা পূরণে এক ধাপ এগিয়ে যাবে।
ধান যেহেতু কৃষকদের প্রধান ফসল, তাই ধানের ফলন কমে যাক কৃষক সাধারণত তা চায় না। বরং মাঝখানে একটি বাড়তি ফসল পেতে চান কৃষক। ফলে কৃষকরা স্বল্পমেয়াদি কিন্তু অধিক ফলনশীল জাত পছন্দ করেন। ধানের স্বল্পমেয়াদি আমন ও বোরো ধানের জাত যথাযথ ভাবে  চাষাবাদ করতে পারলে ফলন খুব একটা না কমিয়ে ২৩০-২৫০ দিনের মধ্যে দুটি ধান ফসল সহজে সংগ্রহ করা সম্ভব। কৃষকের কাছে সে রকম জাতের তথ্য পৌঁছে দেওয়া এবং শস্যবিন্যাসে এদের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা বড় প্রয়োজন। আর সেটা পারলে দুই ধানের মাঝখানে  ৮০-৯০ দিনের উচ্চফলনশীল সরিষার জাত আবাদ করা সম্ভব। আর এজন্য কৃষিতত্ত¡বিদদের এবং সম্প্রসারণবিদদের বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন  করতে হবে। জাত সম্পর্কিত তথ্যাদি ও জাতের বীজ যথাসময়ে কৃষকগনের মাঝে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে। যাই হোক স্বল্পমেয়াদি অথচ অধিক ফলনশীল জাত কৃষকগণের হাতে পৌঁছে দেওয়া এবং সেগুলো যথাযথভাবে শস্যবিন্যাসে ব্যবহার করার পূর্বশর্ত হলো এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা পরিচালনা করা এবং তা চলমান রাখা।
আমাদের মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, বিভিন্ন সভা, সেমিনারে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছেন আমাদের ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে এবং তা সম্ভব তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে।  ভোজ্যতেলের জন্য বছরে আমাদের প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয় এর সিংহভাগ খরচ হয় পাম অয়েল ও সয়াবিন তেল আমদানি করতে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায়  হলো আমদের দেশের কৃষি-পরিবেশ উপযোগী তেল উৎপাদনকারি  তেলবীজ ফসল যেমন-সরিষা, তিল, তিসি, সূর্যমুখী ইত্যাদি এর উৎপাদন বৃদ্ধি করা।

ড. সত্যেন মণ্ডল১ ড. আমিনা খাতুন২ ড. মুহম্মদ নাসিম৩ ড. অভিজিৎ সাহা৪ ড. মোঃ শাহজাহান কবীর৫


১ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২,৩প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ৪মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ৫মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, মোবাঃ-০১৭১২৪০৫১৪৯, ইমেইল atyen1981@gmail.com