Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বাংলাদেশে কফি চাষের সম্ভাবনা ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব

বাংলাদেশে কফি চাষের সম্ভাবনা ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব

কৃষিবিদ কবির হোসেন১ কৃষিবিদ সাবিনা ইয়াসমিন২

পৃথিবীব্যাপী কফি একটি জনপ্রিয় পানীয়। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সেমিনার, কনফারেন্স চলাকালে টি ব্রেক বা কফি ব্রেক বলে খ্যাত ছোট্ট বিরতির এই রেওয়াজ চালু হয়েছিল আমেরিকায় আঠারো শতকের প্রথম দিকে। চা বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলেও আমরা এখনো পর্যন্ত কফি চাষে পিছিয়ে রয়েছি। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার বাণিজ্যিক কৃষির জন্য উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশকে খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর করতে কফি ও কাজুবাদামের সম্প্রসারণে জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কফি একটি অর্থকরী ফসল বিধায় এটি চাষ করে এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন হবে তেমনি এটি বহুমাত্রিক পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ বলে জনগণের পুষ্টি চাহিদা ও পূরণ করবে। এক কাপ বø্যাক কফি (১২৫    মিলিলিটার) কার্যত কোনও ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট বা প্রোটিন থাকে না সুতরাং এর শক্তির পরিমাণ কেবল ১-২ কিলোক্যালরি। কফিতে অনেকগুলো খনিজ এবং ভিটামিন রয়েছে।
বাংলাদেশে কফি চাষের বর্তমান অবস্থা ও বাজার পরিস্থিতি
কফি গ্রহণের ও বিপণনের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের তিনটি জেলায় এটি উৎপাদিত হলেও এর মধ্যে প্রায় ৯০% উৎপাদিত হয় বান্দরবানে । পাহাড়ি এলাকা বাদে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় ইতোমধ্যে চাষ শুরু হয়েছে।  উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী ও রংপুর জেলায় এবং টাঙ্গাইলে কফির চাষ শুরু হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) হর্টিকালচার উইং এর তথ্য মতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কফির উৎপাদন এলাকা ছিল প্রায় ১১৮.৩ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন প্রায় ৫৫.৭৫ টন। বর্তমানে কৃষকগণ যতটুকু চাষ ও প্রক্রিয়াজাত করছে তার সবটুকুই সনাতন পদ্ধতিতে করছে যার ফলন অনেক কম এবং লাভও কম হয়। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে আমদানিকৃত গ্রিন কফির পরিমাণ হলো ৩২.৫১৭ টন (সূত্র: উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং, ডিএই)। চাহিদার বেশির ভাগ অংশই প্রায় ৯৫% পূরণ হচ্ছে আমদানি করা কফি দিয়ে। তাই আমাদের কফির উৎপাদন বৃদ্ধিতে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে এক্ষণই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
কফি চাষ সম্প্রসারণে সম্ভাবনাময় দিকসমূহ
 কফি হতে পারে বাংলাদেশের পাহাড়ি মানুষের বিকল্প আয়ের উৎস। কফি চাষের সাথে  আন্তঃফসল হিসেবে পেঁপে, আনারস, গোলমরিচ অনায়াসে চাষ করা যায়। কফি হালকা ছায়ায় ভালো হয় এবং অতিরিক্ত সার ও সেচের তেমন প্রয়োজন হয় না যা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে রৌদ্রোজ্জ্বল স্থানে চাষ করলে সার ও সেচের প্রয়োজন আছে। স্থানীয় চাহিদা অনেক বেশি ও রপ্তানির সুযোগ রয়েছে বলে এটির উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কফি এবং কাজুবাদাম চাষ সম্প্রসারণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়ক একটি প্রকল্প প্রণয়নের কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও কফির চাষ বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে নর্থ এন্ড কফি রোস্টার্স, ঢাকা। যারা সরাসরি পার্বত্য অঞ্চলের কফি উৎপাদকদের কাছ থেকে কফি ক্রয় করছেন। তাছাড়া বেসরকারি  প্রতিষ্ঠান (এনজিও) মোনঘর, রাঙ্গামাটি, অরণ্যক ফাউন্ডেশন প্রশিক্ষণ ও কফির চারা বিতরণ করেছেন। কফির চাষ বৃদ্ধিতে উৎপাদক, গবেষক, সম্প্রসারণ অফিসার, মিডিয়া, বেসরকারি সংস্থা ও বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থাকে এগিয়ে আসা উচিত যাতে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ সফল হয়।
বাংলাদেশে চাষ উপযোগী আবহাওয়া ও জলবায়ু এবং জাতসমূহ
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু কফি চাষের অনুক‚ল তবে ভালো ও উন্নত স্বাদের ও ঘ্রাণের কফি পেতে এর চাষ সম্প্রসারণের জন্য পাহাড়ি এলাকায় বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কফি চাষের উপযোগী মাটি হলো গভীর, ঝুরঝুরে, জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ ও হিউমাস সমৃদ্ধ, হালকা অ¤øমাটি (পিএইচ ৪.৫-৬.৫)। পৃথিবীতে ৬০ প্রজাতির কফি থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদযোগ্য কফির ২টি জাত রয়েছে যেমন- ঈড়ভভবধ ধৎধনরপধ ধহফ ঈড়ভভবধ পধহবঢ়যড়ৎধ–ৎড়নঁংঃধ। রোবাস্টা জাতের কফি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় খুব উপযোগী। এটি সাধারণত সমুদ্র থেকে ৫০০-১০০০ মিটার উচ্চতায় এবং ১০০০-২০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ভালো ফলে সেজন্য বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকা যেমন -পার্বত্য অঞ্চল ও টাংগাইলের মধুপুর গড়ের আবহাওয়ায় এটির সম্প্রসারণ সম্ভব। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ১২ শতাংশ জমির এলিভেশন প্রায় ১০০০ মিটার। এ ছাড়া পাহাড়ি এলাকাবাদে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায়ও চাষ করা যাবে।  রোবাস্টা জাতের কফি গাছে রাস্ট রোগ কম হয়। এরাবিকা জাত আমাদের দেশে চাষ উপযোগী তবে ফলন কম হয়।
কফি চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি সম্প্রসারণে সরকারের উদ্যোগসমূহ
 কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প কফির উৎপাদনে, সম্প্রসারণে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন- কফি চাষ বৃদ্ধির জন্য সরকারিভাবে হাইব্রিড কফির কলম সংগ্রহ করে বিতরণ করা হবে। ভিয়েতনাম থেকে ঈড়ভভবধ ৎড়নঁংঃধ জাতের কফির কলম আনা প্রক্রিায়াধীন আছে। প্রাথমিকভাবে ঐড়সবংঃবধফ ঈড়ঃঃধমব ওহফঁংঃৎু স্থাপনের জন্য ১০টি কৃষক গ্রæপকে সরকারিভাবে প্রকল্পের মাধ্যমে তাদেরকে প্রশিক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের যন্ত্রপাতি প্রদান করা হবে । গুণগতমান সম্পন্ন কফির চারা/ কলম সরবরাহ করা হবে। আগামীতে কফি সম্প্রসারণের জন্য প্রকল্প বা কর্মসূচি গ্রহণ করার কাজ চলছে। কৃষি মন্ত্রণালয় ও ডিএই এর কর্মকর্তা দেশব্যাপী কফির বর্তমান অবস্থা নিয়মিতভাবে পরিবীক্ষণ করছেন।  চাষিদের প্রযুক্তিগত পরামর্শ দিচ্ছেন এবং নতুন বাগান সৃজনে উদ্বুদ্ধ করছেন।
সংক্ষেপে কফির প্রক্রিয়াজাতকরণ
আমেরিকার জাতীয় কফি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে কফির চারা রোপণ থেকে কাপে পানযোগ্য কফি পেতে কমপক্ষে ১০টি ধাপ পেরোতে হয়। ফল সংগ্রহ থেকে শুরু করে শেষ ধাপ পর্যন্ত সম্পন্ন করতে যা যা করতে হবে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ধারাবাহিকভাবে নিচে দেয়া হলো:
কফির বেরি যখন পেকে গাঢ় লাল বা হলুদ রং হয় তখন এগুলো গাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয় । বছরে ১ বার ফলন সংগ্রহ করতে হয়। বিশ্বের কোথাও কোথাও হাত দিয়ে আবার কোথাও যেমন সমতল ভূমিতে যন্ত্রের মাধ্যমে ফল সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহকৃত পাকা কফি পরবর্তীতে প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রে পাঠানো হয়। প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রে পৌঁছানোর সাথে সাথেই এর কার্যক্রম শুরু করে দিতে হয় অন্যথায় পচন শুরু হতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি দুই ধরনের হয়ে থাকে যেমন : শুকনো ও ভেজা পদ্ধতিতে। শুকনো পদ্ধতি পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবে এটি করা হয়। কফিগুলোকে রেকে বা মাটিতে বিছিয়ে তাতে পাতলা করে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং সূর্যের আলোতে এটি শুকানো হয় যতক্ষণ না পর্যন্ত কফি বীজের আর্দ্রতা ১১ শতাংশ হয়। এটি অনেক সময়সাপেক্ষ পদ্ধতি। ভেজা পদ্ধতিতে পাল্পিং মেশিনের মাধ্যমে উপরের নরম ও পাল্প আবরণ সরানো হয়। এরপর পানির চ্যানেলের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় রোটেটিং মেশিনের মাধ্যমে বীজের আকার অনুসারে গ্রেডিং করা হয়। ফার্মেন্টেশনের জন্য এই বীজগুলোকে রাখা হয় পানি ভর্তি বিশাল ট্যাংকে ১২-২৪ ঘণ্টা। তারপর বীজের উপরের পাতলা পর্দা সরে যায় ও ভালো পানি দিয়ে ধুয়ে শুকানো হয়। ভেজা পদ্ধতিতে সংগৃহীত কফি বীজগুলোকে রোদে বা ড্রায়ারে আর্দ্রতা ১১ শতাংশে না পৌঁছানো পর্যন্ত শুকাতে হবে, এই অবস্থার কফিকে পার্চমেন্ট কফি বলে। তারপর ব্যাগে ভরে সংরক্ষণ করতে হবে।
হালিং মেশিনের মাধ্যমে পার্চমেন্ট লেয়ার সরাতে হবে বা সম্পূর্ণ শুকনা আবরণ সরাতে হবে । যদি পলিশিং করলে এর গুণগতমান বাড়ে তবে এটি করা বাধ্যতামূলক বা জরুরি নয়। আকার ও ওজন দেখে কফিকে গ্রেডিং ও বাছাই করতে হবে। নিশ্চিতভাবে ভালো গ্রিন কফিগুলো রাখতে হবে রপ্তানির জন্য। পাটের ব্যাগ বা অন্যান্য বায়ুরোধী ব্যাগে ভরে জাহাজে চড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলে যায় বিখ্যাত পানীয় এর মূল উপকরণ।
কফির স্বাদ ও গুণগতমান পরীক্ষা করা হয় বিভিন্নভাবে। বাছাইকৃত গ্রিন কফিকে রোস্টিং করে তৈরি করা হয় সুঘ্রাণযুক্ত বাদামি কফি বীজ। যেটা আমরা সুপার সপ বা ক্যাফে থেকে ক্রয় করে থাকি। বেশির ভাগ রোস্টিং মেশিনের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় প্রায় ৫৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এই সময়ে সঠিকভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি কারণ এই ধাপেই সৃষ্টি হয় অসাধারণ স্বাদ ও ঘ্রাণ। এই প্রক্রিয়াকে বলে পাইরোলাইসিস। রোস্টিং এর পর অতি দ্রæত ঠাÐা করতে হবে। তাহলেই এর স্বাদ ও গন্ধ অটুট থাকবে যার জন্য ক্রেতাগণ অনেক বেশি আকৃষ্ট হবে কেনার জন্য। কফির স্বাদ ও ঘ্রাণ গ্রাহকের কাপ পর্যন্ত রাখতে হলে সঠিকভাবে কফি  গ্রাইন্ডিং করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কফি বীজ গুঁড়া করা যত মিহি হবে তত দ্রæত সুন্দর কফি তৈরি হবে। আধুনিক বিভিন্ন মেশিনের সাহায্যে বেøক কফি বা মিল্ক কফি তৈরি করে কফি প্রেমিদের সন্তুষ্টি করা যায়। বাংলাদেশে কফি চাষের জন্য উপযোগী। কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং মাঠ পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাগণের কফি বিষয়ক প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকায় এদেশে কফি চাষ বৃদ্ধি ও এর সম্প্রসারণ করা সম্ভব। আধুনিক প্রক্রিয়াজাত মেশিন ও প্রযুক্তি সহজলভ্যতা হলে এর চাষ বৃদ্ধি পাবে। দেশের কৃষি উদ্যোক্তাগণকে কফি চাষে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই কফির স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও বৃদ্ধি করা যাবে, এভাবেই    কৃষি ও অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ হবে সোনার বাংলাদেশ। য়

১পরিচালক, হর্টিকালচার উইং, ডিএই অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল: ০১৭১৬৩৮৪৫৩৮,২উপজেলা কৃষি অফিসার (সংযুক্ত : হর্টিকালচার উইং), ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল: ০১৬৮৮০৫৪৭৮৬, ই-মেইল :

dhw@dae.gov.bd