Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

চীনাবাদামের আধুনিক উচ্চফলনশীল জাত ও প্রযুক্তি

ড. এম. মনজুরুল আলম মন্ডল

চীনাবাদাম বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেলবীজ ফসল। তবে বাংলাদেশে চীনাবাদাম বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর খাদ্য তালিকায় উদ্ভিদ উৎস থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য উপাদান। বর্তমানে বাংলাদেশে যা চীনাবাদাম উৎপাদিত হয় তা চাহিদার এক তৃতীয়াংশ মাত্র। এ চাহিদাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বেশ কিছু উচ্চফলনশীল বাদামের জাত উদ্ভাবন করেছেন যা প্রচলিত জাত থেকে ফলন বেশি এবং জীবনকাল প্রচলিত জাতের চেয়ে কম। নি¤েœ উচ্চফলনশীল বাদামের জাতগুলোর বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো যাতে কৃষক ও মাঠ পর্যায়ের   কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী অঞ্চল ভেদে সঠিক বাদামের জাতটি বেছে নিতে পারে।
 

বারি চীনাবাদাম-৫ : মাঝারি উঁচু গাছ (উচ্চতা ৩৫-৪০ সেমি.)। গাছ খাড়া এবং গুচ্ছাকার, পাতার রং হালকা সবুজ। ১০০ বীজের ওজন ৪৮-৫০ গ্রাম। বীজে তেলের পরিমাণ ৫১% এবং আমিষের পরিমাণ ২৬%। খরিফ-২ মৌসুমে  জীবনকাল ১১৫-১২৫ দিন এবং ফলন ২.২৫ টন/হেক্টর।
 

বারি চীনাবাদাম-৮ : মাঝারি উঁচু গাছ (উচ্চতা ৩৫-৪২ সেমি.)। গাছ খাড়া এবং গুচ্ছাকার, পাতার রং হালকা সবুজ। ১০০ বীজের ওজন ৫৫-৬০ গ্রাম। বাদামের খোসা মসৃণ ও কিছুটা সাদাটে। বীজে তেলের পরিমাণ ৫০% এবং আমিষের পরিমাণ ২৬%। খরিফ-২ মৌসুমে জীবনকাল ১২৫-১৪০ দিন এবং ফলন ২.২০ টন/হেক্টর।
 

বিনা চীনাবাদাম-৪ : প্রায় সব বাদামগুলো গাছের গোড়ায় একসাথে গুচ্ছাকারে থাকে। দানা মাঝারি। বীজে তেলের পরিমাণ ৪৯% এবং আমিষের পরিমাণ ২৭.৫%। খরিফ-২ মৌসুমে জীবনকাল ১১০-১২০ দিন এবং ফলন ২.৪০ টন/হেক্টর।
 

বিনা চীনাবাদাম-৯ : লবণ সহিষ্ণু (৮ ডিএস/মি.)। দানা মাঝারি এবং গাঢ় লাল রঙের। ফলে দানার পরিমাণ ৮০%। বীজে তেলের পরিমাণ ৪৮% এবং আমিষের পরিমাণ ২৪%। খরিফ-২ মৌসুমে জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন এবং ফলন ২.১০ টন/হেক্টর।
 

বিনা চীনাবাদাম-১০ : গাছ একটু লম্বাটে (৬৫-৭৬ সেমি.) এবং পাতার রং ফ্যাকাশে সবুজ রঙের। প্রায় সব বাদামগুলো গাছের গোড়ায় একসাথে গুচ্ছাকারে থাকে। দানা মাঝারি এবং তামাটে লাল রঙের। ফলে দানার পরিমাণ ৮০%। বীজে তেলের পরিমাণ ৫০.৫% এবং আমিষের পরিমাণ ২৮%। খরিফ-২ মৌসুমে জীবনকাল ১১০-১২০ দিন এবং ফলন ২.২০ টন/হেক্টর।
 

বপন সময় : খরিফ-২ মৌসুমে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (আষাঢ়-আশ্বিন) পর্যন্ত বীজ বপন করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
 

চাষ উপযোগী জমি : বেলে, বেলে, দো-আঁশ ও এটেল দো-আঁশ মাটিতে অধিক ফলন পাওয়া যায়। শুষ্ক জমি বাদাম চাষের জন্য বেশ উপযোগী ।
 

জমি তৈরি, বপন পদ্ধতি ও বীজের পরিমাণ : তিন-চারটি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হয়। শেষ চাষের সময় নির্ধারিত পরিমাণ সার দিয়ে চাষ ও মই দিতে হবে। বীজ সারিতে বপন করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ১২ ইঞ্চি (৩০ সেমি.) এবং গাছ থেকে গাছের দুরত্ব ৬ ইঞ্চি (১৫ সেমি.) রাখতে হবে। বীজগুলো ১.০-১.৫ ইঞ্চি মাটির নীচে পুতে দিতে হবে। হেক্টর প্রতি ১৪০-১৫০ কেজি (বিঘা প্রতি ১৮-২০ কেজি) বীজের প্রয়োজন হয়।
 

বীজ শোধন : বীজ শোধন করে নিয়ে বপন করলে ভাল হয়। প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫ গ্রাম প্রোভেক্স/অটোস্টিন/ নোয়িন নামক বীজ শোধনকারী ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে। শোধনকারী বীজ জমিতে বপন করলে চারা গজানোর হার বেড়ে যায়।


সার প্রয়োগ : জমির উর্বরতার উপর নির্ভর করে সারের মাত্রার তারতম্য হতে পারে। তবে সাধারণভাবে হেক্টরপ্রতি ৪০-৫০ কেজি ইউরিয়া (একরপ্রতি ১৭-১৮ কেজি), ১০০-১৩০ কেজি টিএসপি,  এমওপি ও জিপসাম (একর প্রতি ৩৫-৪০ কেজি) এবং ৩-৪ কেজি  (একরপ্রতি ১.২-২.৫ গ্রাম) দস্তা সার প্রয়োগ করতে হয়। তবে বেলে মাটির ক্ষেত্রে বোরন ও মলিবডেনাম ১-১.৫ কেজি প্রতি হেক্টরে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। জমি উর্বর হলে ইউরিয়া অর্ধেক প্রয়োগ করতে হবে এবং দ¯তা সার প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। সকল প্রকার সার শেষ চাষের পূর্বে জমিতে ছিটেয়ে প্রয়োগ করতে হবে। অন্যদিকে জীবাণূসার ব্যবহার করলে ইউরিয়া প্রয়োগের প্রয়োজন নাই (জীবাণুসার একর প্রতি ৩০০ গ্রাম)।


জীবাণুসার ব্যবহারের নিয়মাবলী : (ক) সুস্থ সতেজ ও শুকনা বীজে পরিমাণমত চিটাগুড় মিশিয়ে নিতে হবে। যাতে বীজগুলো আঠালো মনে হয় (চিটগুড়ের অভাবে ঠাণ্ডা ভাতের মাড় বা পানি ব্যবহার করা যায়)। (খ) আঠালো বীজগুলোর সংগে জীবাণুসার ভালভাবে মিশিয়ে নিবেন। যাতে প্রতিটি বীজে কালো পলেপ পড়ে যায়। (গ) কালো প্রলেপযুক্ত বীজ ছায়ায় সামান্য শুকিয়ে নিলে বীজগুলো গায়ে গায়ে লেগে থাকবে না। (ঘ) জীবাণুসার মিশ্রিত বীজ রৌদ্রহীন বা খুবই অল্প রৌদ্রে বপন করে বীজগুলো মাটি দিয়ে তাড়াতাড়ি ঢেকে দিতে হবে। (ঙ) ঠাÐা, শুষ্ক, রোদমুক্ত জায়গায় জীবাণুসার এবং জীবাণুসার মিশ্রিত বীজ রাখতে হবে। জীবাণুসার উৎপাদনের ১৮০ দিনের মধ্যেই ব্যবহার করা  উত্তম।


আগাছা দমন : চারা গজানোর ২৫-৩০ দিন  পর নিড়ানী দিয়ে সতর্কতার সাথে হালকাভাবে আগাছা উঠিয়া ফেলতে হবে। শিকড়ে যেন কোন প্রকার আঘাত না লাগে সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।
পানি সেচ : খরিফ-২ মৌসুমে চীনাবাদাম চাষে সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে বৃষ্টির পানি যাতে জমিতে জমে না থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে।  


পোকামাকড় দমন : জমিতে বাদাম লাগানোর পরপর পিপিঁলিকা আক্রমণ করে রোপিত বাদামের দানা খেয়ে ফেলতে পারে। এজন্য বাদাম লাগানো শেষ হলেই ক্ষেতের চারিদিকে সেভিন ডাস্ট ৬০ ডবিøউপি ছিটিয়ি দিতে হবে। এছাড়া ক্ষেতের চারিদিকে লাইন টেনে কেরোসিন তেল দিয়েও পিপিঁলিকা দমন করা য়ায়। অনুরুপভাবে, উইপোকা চীনাবাদাম গাছের এবং বাদামের যথেষ্ট ক্ষতি করে থাকে। এরা বাদাম গাছের প্রধান শিকড় কেটে দেয় অথবা শিকড়ের ভিতর গর্ত তৈরি করে। ফলে গাছ মারা যায়। উইপোকা মাটির নিচের বাদামের খোসা ছিদ্র করে বীজ খায়। পানির সাথে কেরোসিন মিশিয়ে সেচ দিলে উইপোকা জমি ত্যাগ করে। অথবা উইপোকা দমনের জন্য ডায়াজিনন-১০ জি/বাসুডিন-১০ জি/ডারসবান-১০ জি যথাক্রমে হেক্টরপ্রতি ১৫, ১৪ ও ৭.৫ কেজি হারে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বিছাপোকার আক্রমণের প্রথম অবস্থায় পাতার নীচে দলবদ্ধ বিছাগুলোকে হাত দিয়ে সংগ্রহ করে কোন কিছু দিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হবে।


রোগ দমন : চীনাবাদামের পাতার দাগ এবং মরিচা রোগ বেশি হলে ২ গ্রাম ব্যাভিস্টিন-৫০ ডবিøউপি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে জমিতে বিকালে স্প্রে করতে হবে। বপনের পূর্বে প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫ গ্রাম প্রোভেক্স/অটোস্টিন/নোয়িন দ্বারা প্রতি কেজি বীজ শোধন করলে রোগের আত্রমণ কম হবে। মরিচা রোগ দেখা দিলে ফলিকুলার নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ১ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে।


ফসল সংগ্রহ, মাড়াই ও সংরক্ষণ : ভালো বীজ বা গুণগতমানের বীজ পেতে হলে ফসল যথাসময়ে উঠাতে হবে। ফসল সঠিক সময় তোলার জন্য ফসলের পরিপক্কতা সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকা আবশ্যক। চীনাবাদাম বীজ খুবই স্পর্শকাতর বা সংবেদনশীল। যখন গাছের শতকরা ৮০-৯০ ভাগ বাদাম পরিপক্ক হবে তখনই চীনাবাদাম তোলার উপযুক্ত সময়। পরিপক্ক হলে বাদামের খোসার শিরা-উপশিরাগুলো স্পষ্টভাবে দেখা যায় এবং গাছের পাতাগুলো হলুদ রং ধারণ করে নিচের পাতা ঝড়ে পড়তে থাকে। বাদামের খোসা ভাঙ্গার পর খোসার ভিতরে সাদা কালচে রং ধারণ করলেই বুঝতে হবে ফসল উঠানোর উপযুক্ত সময় হয়েছে। পরিপক্ক হবার আগে বাদাম উঠালে তা ফল ও তেল কম হবে। আবার দেরীতে উঠালে বীজের সুপ্ততা না থাকার দরুন জমিতেই অংকুরিত হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে।


ক্ষেত থেকে তোলার পর বাদামের গায়ে লেগে থাকা মাটি বা বালু পরিষ্কার করতে হবে। তারপর আটিগুলো উপুর করে অর্থাৎ বাদামগুলো উপরের দিকে রেখে গাছের মাথা শুকনো মাটিতে বসিয়ে রৌদ্রে শুকাতে হবে। এতে করে বাদামের গায়ে লেগে থাকা পানি ঝড়ে যাবে। পরে গাছ থেকে বাদাম ছাড়িয়ে উজ্জ্বল রোদে দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা করে ৫-৬ দিন শুকাতে হবে। এ অবস্থায় বীজের আর্দ্রতা ৮-১০% হয়ে থাকে। এভাবে শুকানোর পর খোসাসহ বাদাম ঠাÐা করে পলিথিন আচ্ছাদিত চটের বস্তায় মাচার উপর সংরক্ষণ করতে হবে।
 

সতর্কতা : ১। এলাকায় উপযোগী জাত বাছাই করা। ২। বপনের আগেই বীজের গজানোর হার পরীক্ষা করা। ৩। একই জমিতে বার বার চীনাবাদাম চাষ না করা।  প্রয়োজনে এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা বা কৃষি কর্মীর সাথে যোগযোগ করা।

চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ, মোবাইল: ০১৭১৬৭৪৯৪২৯, ই-মেইল : mmamondal@gmail.com