Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

উদ্ভিজ্জ প্রোটিন সমৃদ্ধিতে গম ও ভুট্টা

ড. মোহাম্মদ রেজাউল কবীর১, ড. মো. আশরাফুল আলম২ ড. মুহ. রেজাউল ইসলাম৩

গম বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত একটি ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ যার উৎপত্তি খ্রিষ্টপূর্ব ৯৬০০ সালে মধ্যপ্রাচ্যের ক্রিসেন্ট ফার্টাইল অঞ্চলে। বর্তমানে সারা বিশে^ ব্যাপকভাবে গম চাষ হয়। বিশ্বব্যাপী যে কোন দানাদার ফসলের তুলনায় গম বেশি জায়গায় আবাদ হয়ে থাকে। গম কার্বোহাইড্রেট এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্ভিজ প্রোটিনের প্রধান উৎস হলো গম। অন্যদিকে ভুট্টা একটি দানাদার শস্য যা ১০০০০ বছর পূর্বে মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চলের আদিবাসীরা প্রথম চাষাবাদ শুরু করেন। সারা বিশে^ গম ও ধানের তুলনায় ভুট্টার উৎপাদন বেশি। তবে এর সামান্য অংশই মানুষের খাদ্য হিসেবে সরাসরি ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে ভুট্টা প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১৯-২০ মৌসুমে  পৃথিবীতে গম ও ভুট্টার উৎপাদন যথাক্রমে ৬০৯ ও ১০৫০ মিলিয়ন টন। বাংলাদেশে দানাজাতীয় খাদ্যশস্য হিসেবে গম ও ভুট্টার গুরুত্ব অপরিসীম। ধানের তুলনায় গম অধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন, কৃষি সম্পদ সাশ্রয়ী ও পরিবেশ বান্ধব। উৎপাদন ব্যয় কম হওয়ায় কৃষকদের জন্য গম আবাদ লাভজনক। অপরদিকে, অধুনা দেশে পোল্ট্রি ও মৎস্য খাত বিকশিত হওয়ায় এবং এক্ষেত্রে ফিড হিসেবে বিপুল পরিমাণে ভুট্টা ব্যবহৃত হওয়ায় পরোক্ষভাবে এটি পুষ্টি চাহিদা পুরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। হেক্টরপ্রতি উৎপাদনশীলতা অধিক হওয়ায় কৃষকদের জন্য ভুট্টার আবাদ লাভজনক। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং পোল্ট্রি ও ডেইরি খামার বিকাশের সাথে সাথে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এ দুটি ফসলের চাহিদা দ্রæত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি গম আমদানিতে বাংলাদেশ বিশে^র শীর্ষ পঞ্চম দেশে পরিণত হয়েছে। দেশের বর্তমানে ৩.৪২ লক্ষ হেক্টর জমিতে ১২.৫ লক্ষ টন গম এবং ৫.৫৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে ৫৪ লক্ষ টন ভুট্টা উৎপাদনের পাশাপাশি বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে প্রতি বছর প্রায় ৬০ লক্ষ টন গম এবং ১৪ লক্ষ টন ভুট্টা আমদানি করতে হচ্ছে। বিদেশ থেকে এই ব্যাপক আমদানি নির্ভরতা কমাতে হলে গবেষণা ক্ষেত্রের  আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে গম ও ভুট্টার দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন।
গম ও ভুট্টার পুষ্টিমাণের তুলনামূলক চিত্র
পুুষ্টিগুণ বিবেচনায় গম ও ভুট্টা গুরুত্বপূর্ণ দানাদার খাদ্যশস্য। গম উদ্ভিজ্জ প্রেটিনের প্রধান উৎস । প্রতি ১০০ গ্রাম গম, ভুট্টা ও চালের খাদ্যমান এর তুলনামূলক চিত্র সারণি- ১ দ্রষ্টব্য।
খাদ্য হিসেবে গমের ব্যবহার ও উপকারিতা
গম থেকে নানা ধরণের খাদ্য দ্রব্য উৎপাদিত হয়ে থাকে। যেমন: পাউরুটি, পরিজ, ক্রেকার্স, বিস্কুট, কেক, রোল, বার্গার ইত্যাদি। গমজাত খাদ্য দ্রব্য উৎপাদনে গমের যে খামির (উড়ঁময) তৈরি করা হয় তার একটি গুরত্ব¡পূর্ণ উপাদান হলো গøুটেন। জৈব জ্বালানি তৈরি করতেও বর্তমানে গম ব্যবহৃত হচ্ছে। গমের খড় গৃহপালিত পশুর খাদ্য এবং নির্মাণসামগ্রী হিসেব ব্যবহার করা হয়।
গমের লাল আটাতে (ডযড়ষব যিবধঃ) তিনটি অংশ থাকে: ক) ব্রান (ইৎধহ) খ) জার্ম (এবৎস)  এবং গ) এন্ডোস্পার্ম (ঊহফড়ংঢ়বৎস)।  ব্রান হলো গমের বাইরের শক্ত আবরণ যাতে থাকে আঁশ, খনিজ ও এন্টিঅক্সিডেন্ট। জার্ম হলো উচ্চ প্রোটিনের সমৃদ্ধ একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য। জার্ম থেকেই গম গাছ গজায়। জার্মে ২৩টি পুষ্টি উপাদান আছে এবং প্রতি আউন্সে যে পুষ্টি আছে তা অন্য যে কোন শস্য কণা বা      শাকসবজির চেয়ে বেশি। এতে প্রায় ২৮ ভাগ প্রোটিন আছে এবং এই পরিমাণ অধিকাংশ প্রাণিজ প্রোটিনের চেয়ে বেশি। জার্মে পটাশিয়াম ও আয়রন এর পরিমাণ অন্য যে কোন খাদ্যের চেয়ে বেশি। সাদা আটা (জবভরহবফ যিবধঃ) গমের ব্রান ও জার্মকে অপসারেণের মাধ্যমে তৈরি হয়। গমে এর ওজনের ১২-১৫% আঁশ থাকে। সাদা আটাতে এই ফাইবারের পরিমাণ খুবই কম থাকে। তাই গম থেকে পরিপূর্ণ পুষ্টি পেতে লাল আটা খাওয়া উত্তম।
খাদ্য হিসেবে ভুট্টার ব্যবহার ও উপকারিতা
ভুট্টা মানুষের খাদ্য, পশু-পাখির খাদ্য, জ¦ালানি এবং শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এশিয়ার অনেক দেশে শুধু ভুট্টার আটা দিয়ে রুটি অথবা গম বা চালের আটার সাথে ভুট্টার আটা মিশিয়ে বিভিন্ন খাবার প্রস্তুত করা হয়। আমাদের দেশে ভুট্টার কচি মোচা আগুনে পুড়িয়ে বা লবণ পানিতে সিদ্ধ করে খাওয়া হয়। বারি মিষ্টি ভুট্টা ১ জাতের ভুট্টার মোচা কাঁচা অবস্থায় খাওয়া যায়। দানা যখন অল্প নরম থাকে (গরষশ ধহফ ফড়ঁময ংঃধমব) তখনই মোচা সংগ্রহ করতে হয়। সিল্ক বের হওয়ার ২০-২৫ দিনের মধ্যে অর্থাৎ রবি মৌসুমে মাত্র     ১১৫-১২০ দিনে খাওয়ার উপযোগী মোচা গাছ থেকে সংগ্রহ করা যায়। এ সময় দানায় চিনির ভাগ গড়ে ১৮%। হলুদ দানায় প্রচুর পরিমান ভিটামিন এ থাকে। চাউল, গম ও ভুট্টা দিয়ে বিভিন্ন খাবার তৈরি করা হলেও পুষ্টি বিবেচনায় গম ও ভুট্টা দিয়ে তৈরি খাবেরের পুষ্টিমান বেশি।
মানবদেহের জন্য উপকারী অনেক গুণাগুণ ভুট্টায় রয়েছে। ভুট্টার ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স ত্বক, চুল, হার্ট, ব্রেইন এবং হজমের জন্য উপকারী। ভিটামিন এ, সি, কে,  বিটা ক্যারোটিন এরং সেলেনিয়াম থায়রয়েড গ্রন্থির কার্যক্রম ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে উন্নত করে। ভুট্টার তেলে বিদ্যমান অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড বিশেষ করে লিনোলিক এসিড উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।  ভুট্টার তেলে বিদ্যমান ভিটামিন কে এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।
বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধিনস্ত গম গবেষণা কেন্দ্র ও ভুট্টা শাখাকে একীভ‚ত করে “বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট” ২০১৭ সালের ২২ নভেম্বর একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সদ্য প্রতিষ্ঠিত এ গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান কার্যালয় দিনাজপুর জেলার নশিপুরে অবস্থিত। বর্তমানে প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও উপকেন্দ্রে গম ও ভুট্টার নানাবিধ গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক এ পর্যন্ত গমের ৩৪টি, হাইব্রিড ভুট্টার ১৮টি এবং কম্পোজিট ভুট্টার ৭টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি গম ও ভুট্টার ফলন বৃদ্ধির জন্য আধুনিক চাষাবাদ কলাকৌশল, ফসল বিন্যাস, মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা, রোগবালাই ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা এবং বিভিন্ন প্রকার কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিএআরআই এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় গত   ২০১৯-২০ মৌসুমে ৩৮৬১ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ ও ২০২০টি প্রদর্শনী স্থাপনের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে প্রযুক্তি হস্তান্তর কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। বীজ উৎপাদন ও বিতরণ কার্যক্রমের আওতায় ২০১৯-২০ মৌসুমে গম ও ভুট্টার ১০৩ টন প্রজনন ও মানঘোষিত বীজ উৎপাদন করা হয়েছে।
ভবিষ্যতে প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি মলিকুলার প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ে অধিক ফলনশীল গম ও ভুট্টার জাত উদ্ভাবন চলমান। পাশাপাশি আধুনিক জীবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে রোগবালাই প্রতিরোধী ও প্রতিক‚ল পরিবেশ সহিষ্ণু গম ও ভুট্টার জাত উদ্ভাবন করার প্রচেষ্টা চলছে।
গম ও ভুট্টার টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন: ঈওগগণঞ, টঝঅওউ, অঈওঅজ, টঝউঅ, কঝট, ঝখট এবং ওঈঅজ এর সাথে যৌথ গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা।

 

১ -২বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, নশিপুর, দিনাজপুর-৫২০০ ৩ আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রংপুর, ই-মেইল : rezaulw@yahoo.com, মোবাইল : ০১৭৯৬৫৮৬০৩৯