Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ছাদ কৃষি

ছাদ কৃষি
মো. শামীম সেখ
ছাদ বাগান কোনো নতুন ধারণা নয়। অতি প্রাচীন সভ্যতায়ও ছাদ বাগানের ইতিহাস চোখে পড়ে। বিশ্বব্যাপী নগরায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে আর নগরায়নের প্রভাবে নগর কৃষি দিনে দিনে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে কৃষির এ খাত গুরত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ছাদ বাগান স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ রয়েছে। যেমন-ছাদ বাগান পরিকল্পনা; উপকরণ সংগ্রহ; মাটি প্রস্তুতি; টবে মাটি ভরাট; উদ্ভিদ নির্বাচন।
ছাদ বাগান পরিকল্পনা
ছাদ বাগান করার জন্য দৃঢ় মানসিক প্রস্তুতি দরকার এবং ছাদ বাগানের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি ও ভালো উৎপাদনের জন্য সঠিক পরিকল্পনার কোন বিকল্প নেই। ছাদ বাগান স্থাপনের আগে অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে যে, ছাদ বাগান করার উপযোগী কি না? অর্থাৎ ছাদ গাছপালার ওজন বহন করার মতো যথেষ্ট মজবুত কি না? পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো কি না? পরিকল্পনা ও নকশা নিজে করা ভালো। তবে ল্যান্ডস্কেপ হর্টিকালচারিস্ট দ্বারাও ডিজাইন করানো যেতে পারে।
পারিবারিক ছাদ বাগানের পরিকল্পনা ও নকশা করার ক্ষেত্রে ছাদের আকার ও আয়তন অনুযায়ী পেন্সিল দিয়ে একটি নকশা একে নিতে হবে। নকশায় ছাদের চারপাশের সীমানা ও মাপ নির্ধারণ করতে হবে। চলাচলের সুবিধার জন্য খানিকটা খোলা জায়গা রাখতে হবে। ছাদের আয়তন বেশি হলে ছাদকে কয়েকটা অংশে ভাগ করে প্রতি অংশের মাঝে প্রায় ১ থেকে ১.৫ মিটার চওড়া করে চলাচলের পথ রাখতে হবে। এবার ছাদের যে কোন এক কিনারা থেকে পরিকল্পনা ও নকশা আঁকা শুরু করতে হবে। ছাদের যে কোন এক কোণে বা চিলে কোঠার সাথে লোহার পাইপ বা কাঠের খুঁটি লাগিয়ে যাতে একটি মাচা করা যায় সেটা নকশায় রাখতে হবে। ভেতরের এক এক অংশে এক এক ধরণের গাছ রাখা বা লাগানোর জন্য কাঠামো তৈরি বা টবের জায়গা চিহ্নিত করতে হবে। অবশ্যই পানির উৎস নকশায় রাখতে হবে। ছাদে বাগান করতে হলে কিছু জিনিসপত্র রাখার জায়গাও দরকার হয়। তাই নকশায় কোঠাঘরের জায়গা রাখতে হবে। বাগানের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য ছাদে মাঝের দিকে ফল গাছ লাগালে ভালো হয়। ছাদের কিনারায় যদি কিছু লতানো গাছ লতিয়ে দেয়ার কথা ভাবেন, তবে ছাদের রেলিংয়ের উপরে অনুচ্চ গ্রীল বা রেলিংয়ের ভেতরে বা বাইরের দিকে লোহার কিছু ক্ল্যাম্প বা হুক লাগিয়ে রাখা ভালো। যে কোনো গাছের বেঁচে থাকার জন্য সূর্যালোক একটি অপরিহার্য বিষয়। তাই বাগানের নকশা তৈরি করার সময় ছাদের কোন দিক থেকে রোদ আসে এবং ঋতুভেদে রোদ কোনদিকে সরে যায় ইত্যাদি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য সঠিক পরিকল্পনা থাকতে হবে। ছাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য খোলা জায়গায় লন তৈরি এবং একটি বসার শেড ও তৈরি করা যেতে পারে তবে শেডের আকার ছাদের সাথে       মানানসই হতে হবে।
প্রয়োজনীয় উপকরণ
ছাদ বাগানের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রাদি কোদাল, গার্ডেন ফর্ক, বাডিং নাইফ, সিকেচার, প্রুনিং শেয়ার, করাত, ব্যালেন্স, ডিবলার, ওয়াটারিং ক্যান ইত্যাদি সংগ্রহে রাখতে হবে। পাত্রসমূহের মধ্যে ট্রে, সীডপ্যান, পট, প্লাস্টিক পট, গ্রোইংব্যাগ, বালতি, পলিব্যাগ, ড্রাম, হাফ ড্রাম, মাটির বোল ইত্যাদি।
মাটি প্রস্তুত
টবে/ পটের গাছ বৃদ্ধির সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে মাটির মিক্সার তৈরি করার উপর। মাটি গুঁড়া করে, মাটি থেকে              অনাকাক্সিক্ষত বস্তু অপসারণ করতে হবে। প্রয়োজনীয় পরিমাণ মাটি নিয়ে, প্রতি কেজি মাটির জন্য ০.৫ গ্রাম (মাটির ঢ়ঐ ৫ থেকে বেশি হলে)/১ গ্রাম হারে (মাটির ঢ়ঐ ৫ এর কম হলে) করে ডলোচুন মিশিয়ে, ৮- ১০ দিন পলিথিনে মুড়িয়ে রাখতে হবে। শোধনকৃত মাটিতে পরিমাণমতো গোবর ও কোকোপিট মিশিয়ে প্রতি কেজি মিশ্রণের জন্য ১ গ্রাম হারে ইউরিয়া, টিএসপি এবং ০.৫ গ্রাম হারে এমওপি যোগ করতে হবে। পটে/টবে মাটি: গোবর: কোকোপিট মিশ্রণের অনুপাত হবে ২:১:১।
টবে মাটি ভরাট
টব থেকে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্যে টবের নিচে তিন থেকে চারটি ছিদ্র রাখতে হবে। টবের তলায় ২/৩ সেমি. পুরু করে ইটের খোয়া সাজাতে হবে এটা যদি সম্ভব না হয় তবে ছিদ্রের উপরিভাগে ভাঙ্গা টবের ৩ অথবা ৪টি অংশ কিংবা ইটের টুকরা এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে ছিদ্রগুলো মাটিদ্বারা বন্ধ না হয়ে যায়। টবে মাটি ভরার সময় টবের উপরিভাগে ০.৫ থেকে ১ ইঞ্চি পরিমাণ এবং হাফ ড্রামের ক্ষেত্রে ১.০ থেকে ১.৫ ইঞ্চি ঠিকমতো সার ও পানি দেয়ার জন্য খালি রাখতে হবে। সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত টব/পট ভরাট করতে হবে। ভরাটকৃত পট ১২-১৫ দিন ফেলে রাখার পর চারা রোপণ/বীজ বপন করতে হবে।
উদ্ভিদ নির্বাচন
ছাদ বাগানের জন্য এমন গাছ নির্বাচন করতে হবে যার জাত খর্বাকার, মূলের গভীরতা কম এবং সারা বছর ফল দেয়। ছাদ বাগানের জন্য উপযোগী ফলের জাত হচ্ছে, বারি আম-৩ (আম্রপালি), বাউ আম-২ (সিন্দুরী), থাই কাঁচা মিঠা, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, বারি আম-১১, কাটিমন, সূর্য ডিম, পুনাই, বারি পেয়ারা-২, ইপসা পেয়ারা-১, থাই পেয়ারা, বাউ কুল-১, ইপসা কুল-১ (আপেল কুল), থাই কুল-২, বারি লেবু-২, বারি লেবু-৩, বাউ কাগজি লেবু-১। বারি আমড়া-১, বাউ আমড়া-১, থাই আমড়া,  থাই মিষ্টি করমচা। গনেশ, পাকিস্তানি  ড্রাগন ফল, বারি কমলা-১, বারি মাল্টা ১, বারি মাল্টা-৪। বাউ জামরুল-১ (নাসপাতি জামরুল), বাউ জামরুল-২ (আপেল জামরুল) ইত্যাদি। নানা ধরনের শাকসবজি লাগানো যায়। যেমন- লালশাক, পালংশাক, মুলাশাক, ডাঁটাশাক, কলমীশাক, পুইঁশাক, চুকুর, ক্যাপসিকাম, লেটুস, বেগুন,টমেটো, ঢেড়স, শিম, বরবটি, করলা, লাউ, ধুন্দল ইত্যাদি। সৌন্দর্য্য ও মনের প্রশান্তির জন্য বিভিন্ন ফুল যেমনÑ গাধা, গোলাপ, বেলী, টগর, জুঁই, গন্ধরাজ, জবা, টিকোমা, জারবেরা, শিউলি, এলামন্ডা ইত্যাদি। মসলা ও ঔষধিগুণসম্পন্ন মরিচ, ধনেপাতা, বিলাতি ধনিয়া, পুদিনা, কারিপাতা, পেঁয়াজ, রসুন, অ্যালোভেরা, তুলসী, থানকুনি, ইত্যাদি লাগানো যেতে পারে।
সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা
ছাদ বাগানে সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ সেচ ব্যবস্থাপনা। নিয়মিত পরিমিত সেচের উপর ছাদ বাগান স্থাপনের সফলতা নির্ভর করে। পানি কম দেয়া যেমন ক্ষতিকর তেমনই অতিরিক্ত পানি দেয়াও গাছের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত পানি দেয়ার ফলে টবের/ পটের গাছে বিভিন্ন রোগ দেখা এমনকি গাছ/চারা মারাও যায়। এজন্য কেবলমাত্র গাছের গোড়া শুকালেই পানি দেয়া যাবে, গোড়া ভেজা থাকলে কোনো মতেই পানি দেয়া যাবে না। বর্ষাকালে খেয়াল রাখতে হবে শিম, মরিচ, বেগুন ইত্যাদি গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকেলে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে অন্যথায় ঢলে পরা রোগে আক্রান্ত হবে। ছাদের গাছ একবার ঢলেপড়া রোগে আক্রান্ত হলে তা থেকে আর ভালো ফলন আশা করা যায় না। বর্ষার সময় ব্যতীত ছাদ বাগানে সকাল বিকেল পানি দেয়া উত্তম তবে গরমে অবশ্যই সকাল বিকালে পানি দিতে হবে। গরমের সময় পানি দেওয়ার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে পাইপের পানি যেন গরম না থাকে। প্রখর রোধে অবশ্যই পানি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। গাছে ফুল আসার সময় পানির পরিমাণ কম দিতে হবে তবে নিয়মিত গোড়ায় অল্প পরিমাণ পানি দিতে হবে না হলে পানির অভাবে ছাদ বাগানের গাছের ফুল ঝরে যাবে। কুমড়াজাতীয় গাছে অবশ্যই ঠিকমতো সেচ দিতে হবে না হলে কাক্সিক্ষত বৃদ্ধি তথা ফলন পাওয়া যাবে না। ছাদ বাগানের জন্য ড্রিপ বা বিন্দু সেচ খুবই উপযোগী একটি পদ্ধতি ড্রিপ সেচ হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে গাছের শিকরে সঠিক এবং সুষম হারে পানি প্রয়োগ করা যায়। এ ছাড়া পানিতে দ্রবণীয় সার সঠিক মাত্রায় গাছে প্রয়োগ করা যায়। ড্রিপ সেচ একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি। এই পদ্ধতিতে ছিদ্রযুক্ত নলের সাহায্যে গাছের গোড়ায় ফোঁটায় ফোঁটায় সেচ দেয়া হয় এতে পানির কোন অপচয় হয় না। যেখানে সেচের জন্য পানি অপ্রতুল সেখানে এই পদ্ধতি খুবই কার্যকর।
সার ব্যবস্থাপনা
ছাদ বাগানে সার প্রয়োগের ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। দুই (২) সপ্তাহ পরপর অল্প পরিমাণ সার স্প্রে করতে হবে। প্রথম পর্যায়ে ১ লিটার পানিতে ৫ গ্রাম ইউরিয়া, ৫ গ্রাম টিএসপি, ১-২ গ্রাম বোরণ সার ভাল করে গুলে নিতে হবে ( সেক্ষেত্রে টিএসপি সার ৩/৪ ঘণ্টা আগে ভিজিয়ে রাখা ভাল)। ২য় পর্যায়ে ১ লিটার পানিতে (১ম বারের ২ সপ্তাহ পর) ৫ গ্রাম ইউরিয়া, ৫ গ্রাম জিংক গুলিয়ে নিতে হবে। ৩য় পর্যায়ে ১ লিটার পানিতে (২য় বারের ২ সপ্তাহ পর) ৫ গ্রাম ইউরিয়া, ২-৩ গ্রাম এমওপি সার গুলিয়ে, চারা/ছোট গাছের ক্ষেত্রে ৪/৫টি গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করা যেতে পারে, বড় গাছের ক্ষেত্রে (বড় টবে হলে) ২টি গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করা যেতে পারে, আবার হাফ ড্রামে হলে ১টি গাছের গেড়ায় প্রয়োগ করা যেতে পারে। এভাবে অল্প অল্প সার আবর্তকভাবে প্রয়োগ করলে ছাদ বাগানে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। সার মিশ্রিত পানি পড়ন্ত বিকেলে প্রয়োগ করা ভাল তবে গাছের গোড়ার মাটিতে ঐ পরিমাণ সার মিশ্রিত পানি প্রয়োগ করতে হবে যাতে গোড়ার মাটি পরের দিন শুকিয়ে যায় । বর্ষার সময় গাছের গোড়ায় অতিরিক্ত পানি না জমে সেভাবে সেচ দিতে হবে। ছাদ বাগানে জৈবসার ব্যবহার সব থেকে উত্তম।
অন্যান্য সাধারণ ব্যবস্থাপনা
কিউকারবিটস জাতীয় ফসলের পরাগায়ণজনিত সমস্যা রোধে হস্তপরাগায়ন করা প্রয়োজন। সাদা মাছি পোকা, জাবপোকা, ফলের মাছি পোকা, ডগা ও কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা, লিফমাইনর ইত্যাদি ছাদ বাগানে খুব বেশি দেখা যায়। এগুলো দমন করার জন্য সঠিক নিয়মে ফেরোমন ট্রাপ ব্যবহার করতে হবে পাশাপাশি পরিমিত পরিমাণ তামাক পানি অথবা নিমতৈল অথবা সাবান পানি বা অন্যান্য জৈব বালাইনাশক স্প্রে করতে হবে। ছাদ বাগান সম্পার্কিত যে কোন প্রয়োজনে স্থানীয় মেট্রোপলিটন কৃষি অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। য়
মনিটরিং অফিসার, নগর কৃষি উৎপাদন সহায়ক (পাইলট) প্রকল্প, মোবাইল নং: ০১৭১৭০৩৩৯৩২, ইমেইল: kbdshamimshaikh@gmail.com