Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তির মাধ্যমে কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার

প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তির মাধ্যমে কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার

ড. মো: গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী১, মো: হাফিজুল হক খান২

কাঁঠাল পুষ্টিগুণে ভরপুর তাই এটি ফলের মধ্যে গুণের রাজা হিসেবে স্বীকৃত। কাঁঠালে আছে অধিক পরিমাণে আমিষ, শর্করা ও বিভিন্ন ভিটামিন যা মানবদেহের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা কাঁঠালে ১.৮ গ্রাম, কাঁচা কাঁঠালে ২০৬ গ্রাম ও কাঁঠালের বীজে ৬.৬ গ্রাম আমিষ পাওয়া যায়। কাঁচা কাঁঠাল রোগব্যাধি উপশমে কার্যকর, অন্যদিকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয় অনেকগুণ। এটি ক্যান্সারের মোকাবেলায়ও সাহায্য করে। এতে আছে বিপুল পরিমাণে খনিজ উপাদান যা হাড়ের গঠন ও হাড় শক্তিশালীকরণে এবং রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কাঁঠালে আছে শক্তিশালী এন্টি-অক্সিডেন্ট যা আমাদের দেহকে ক্ষতিকর ফ্র্রি-রেডিকেলস থেকে রক্ষা করে। এ ছাড়াও সর্দি-কাশি রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। কাঁঠালে বিদ্যমান ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস আলসার, উচ্চ রক্তচাপ এবং বার্ধক্য প্রতিরোধে সক্ষম। এ ফলে রয়েছে আয়রন, যা দেহের রক্তস্বল্পতা ও এটি আঁশালো হওয়ায় কোষ্ঠকাঠিন্যও দূর করে। পাকা কাঁঠালে আয়রনের পরিমাণ ০.৫ মিগ্রা., কাঁচা কাঁঠালে ১.৭ মিগ্রা. এবং বীজে ১.৫ মিগ্রা. বিদ্যমান। কাঁঠালের অন্যতম উপযোগিতা হলো ভিটামিন ‘সি’। প্রাকৃতিকভাবে মানবদেহে ভিটামিন ‘সি’ তৈরি হয় না। ভিটামিন ‘সি’ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দাঁতের মাড়িকে শক্তিশালী করে। এতে আরও আছে ভিটামিন ‘বি৬’ যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান কাঁঠাল থেকে পাওয়া সম্ভব। আবার অনেক খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞানী চেহারায় লাবণ্য দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য কাঁঠাল খাওয়ার পরামর্শ দেন।
দেশের প্রায় সব এলাকায় কম বেশি কাঁঠাল উৎপাদিত হয়ে থাকে। অঞ্চলগুলোর মধ্যে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, খুলনা, সুনামগঞ্জ, পার্বত্য চট্টগ্রামে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ও উৎকৃষ্টমানের কাঁঠাল উৎপন্ন হয়ে থাকে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রায় প্রতি বছরই দাম খুব কম হওয়ায় হতাশাগ্রস্ত হৃদয়ে কাঁঠাল চাষি ও উদ্যোক্তাদের বিক্রয় করতে দেখা যায় বা বিক্রয় করতে একরকম বাধ্য হয়ে থাকেন। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় দেশে কাঁঠালের সংগ্রহোত্তর ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৫-৪৫ ভাগ বা কখনও কখনও এ অপচয়ের পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে থাকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায় আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ কাঁঠালের অপচয় হয়ে থাকে। কৃষক তার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হচ্ছে বলে অনেক কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়। লক্ষণীয় যে, কৃষক সময়মতো বিক্রয় করতে না পারা ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়ায় অনেকে কাঁঠাল গাছ বা কাঁঠালের বাগান কেটে ফেলছেন ও এর পরিবর্তে অন্য ফসল বিশেষত উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদনের পরিকল্পনা করছেন।
পাকা কাঁঠাল খাওয়ার প্রবণতা আমাদের দেশে খুব বেশি।         গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলাস্থ জৈনা বাজার ও মাওনা এলাকার কৃষক, ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কাঁঠালকে শুধুমাত্র পাকা ফল হিসেবে খাওয়ার কারণে এটি যখন পাঁকতে শুরু করে তখন একসাথে বেশির ভাগ কাঁঠালই পেকে যায়। ফলে সে সময় গাছ হতে ৩০-৪০ ভাগ কাঁঠাল প্রাকৃতিক ভাবে পড়ে যায়, যা খাওয়ার উপযোগী থাকে না অর্থাৎ ব্যাপক কাঁঠাল এক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে থাকে। সে সময় অনেকের মতে গরু বা পশু পাখিও পাকা কাঁঠাল খায় না। কিন্তু কাঁঠালকে বাণিজ্যিকীকরণের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এবং পরিচর্যা ও প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্যসামগ্রী তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করা হলে এ ফলটিকে সারা বছর খাওয়ার টেবিলে আমরা পেতে পারি।
কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার বাড়াতে এবং অপচয় কমাতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কেজিএফ এর অর্থায়নে পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ ও নিউভিশন সলিউশন লিমিটেড যৌথভাবে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই হলোÑ কাঁঠালের উৎপাদন, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন বিষয়কে সম্প্রসারিত করার মাধ্যমে অপচয় রোধ করা। কাঁঠালকে সঠিকভাবে কাঁচা থেকে ব্যবহার করা গেলে বহুমুখী ব্যবহারের মাধ্যমে বহলাংশে অপচয় কমে আসবে এবং আমাদের দেশেই থাইল্যান্ডের বা ভিয়েতনামের তৈরি কাঁঠালের চিপস্, ভেজিটেবল মিট, ফ্র্রেশ-কাট, ফ্রোজেন, অসমোটিক ডিহাইড্রেটেড প্রডাক্ট, রেডি-টু-কুক, ভিনেগার, কাঁঠালসত্ত্ব, জ্যাম, আচারসহ বহুবিধ উৎকৃষ্টমানের ও মুখরোচক খাদ্য দ্রব্য অনায়াসে তৈরি করা সম্ভব হবে। প্রকল্পের বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষকদের নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপ গঠন করা হবে এবং তাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করে প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্যসামগ্রী তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করা হবে এবং বিভিন্ন প্রচারণামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে কাঁঠালকে জনপ্রিয় করার বিবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর তথ্য মোতাবেক বিশ্বে বছরে প্রায় ৩৭ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয় যার অধিকাংশই উৎপাদিত হয় ভারতে (১৮ লাখ টন) এর পরের অবস্থান বাংলাদেশ (১০ লাখ টন)। তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড। পুষ্টি বিবেচনায় চীন, জাপান, মালয়েশিয়াসহ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশই কাঁঠালকে প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজে ব্যবহার করায় উৎপাদন চলমান রাখতে বিভিন্ন দেশ হতে কাঁঠাল আমদানিও করছে। এ ক্ষেত্রে             উৎকৃষ্টমানের ও সুনির্দিষ্ট জাত উদ্ভাবন এবং সঠিক পরিপক্বতা নির্বাচনের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে যা দেশের কৃষক ও উদ্যোক্তাকে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করবে। কাঁঠালকে জনপ্রিয় ও যথাযথ ব্যবহার বৃদ্ধি করার প্রয়াসে                বিএআরআই-এর উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র এ পর্যন্ত ৩টি জাত (বারি কাঁঠাল-১, বারি কাঁঠাল-২ ও বারি কাঁঠাল-৩) উদ্ভাবন করেছে, যা বছরব্যাপী ভোক্তাদের নিকট সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
কাঁঠালের বহুবিধ খাবারের মধ্যে কাঁঠালের বীচি খুবই           পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার, যা দিয়ে ভর্তা, সবজি, ফ্রাইড প্রডাক্ট, কেক, হালুয়াসহ রকমারি খাদ্যসামগ্রী সহজেই তৈরি করা যায়। প্রবাসীদের কাছে এর বীচির কদর খুব বেশি। আমেরিকা, ইউরোপ, কানাডা, অস্টেলিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই দক্ষিণ এশিয়ার সুপার-শপগুলোতে ফ্রোজেন অবস্থায় কেজি প্রতি   ৮০০-১০০০ টাকা দরে কাঁঠালের বীচি বিক্রয় করতে দেখা যায়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াতে কাঁঠালের তৈরি বিভিন্ন খাদ্য বিশেষ করে চিপস, অসমোটিক ড্রাইড, আচার, জেমসহ হরেক রকমের খাদ্য পণ্য ব্যাপক হারে চোখে পড়ে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের কেরালায় কাঁচা কাঁঠাল খুবই জনপ্রিয়। সেখানে ভেজিটেবল মিট সহ বিভিন্ন উপকরণে ১০০ প্রকার খাবার কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে তৈরি করে খাওয়ার প্রচলন আছে। কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এসডিজি এর লক্ষ্য পূরণেও সহায়ক হবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সেক্ষেত্রে কাঁঠালকে প্রথমেই সবজি হিসেবে খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে, যা বিএআরআই এর পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের গবেষণায় ৫৫ দিন হতে ৬৫ দিনের অপরিপক্ব কাঁঠালকে ‘ভেজিটেবল মিট’ হিসেবে উপযোগী বলে        প্রতীয়মান হয়েছে। এ কাঁঠালকে এন্টিমাইক্রোবিয়াল ও সংগ্রহোত্তর পরিচর্যার মাধ্যমে ডিপফ্রিজে ৬-৮ মাস গুণগতমান অক্ষুণ্ন রেখে সহজেই সংরক্ষণ করা যায়।
দেশে উৎপাদিত কাঁঠালের খুব অল্প পরিমাণে বিদেশে রপ্তানি হয় এবং এর ক্রেতা অধিকাংশই প্রবাসী বাংলাদেশি।  আমাদের দেশের কাঁঠাল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কাতার, ওমান, বাহরাইন, সৌদি আরব, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। উত্তম কৃষি চর্চা, উন্নত প্যাকেজিং প্রযুক্তি, সঠিক পরিপক্বতা নির্ধারণ, সুনির্দিষ্ট জাত নির্বাচন, প্যাকিং হাউজ সুবিধাসহ যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগ করার মাধ্যমে জাতীয় ফল কাঁঠালকে দেশের গন্ডী পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে, যা কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি যেমন নিশ্চিত করবে তেমনি অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল কাঁঠালের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। সর্বোপরি খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানসহ দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করবে। য়

১খাদ্য প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষক ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই), গাজীপুর, মোবাইল: ০১৭১২২৭১১৬৩, ই-মেইল: ferdous613@gmail.com