Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

মেধাবী জাতি গঠনে পারিবারিক পুষ্টি বাগান

মেধাবী জাতি গঠনে পারিবারিক পুষ্টি বাগান

ড. মোঃ আকরাম হোসেন চৌধুরী
দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন- “গ্রামে গ্রামে বাড়ির পাশে বেগুন গাছ লাগিও, কয়টা মরিচ গাছ লাগিও, কয়টা লাউ গাছ ও কয়টা নারিকেলের চারা লাগিও। বাপ-মারে একটু সাহায্য কর। কয়টা মুরগি পালো, কয়টা হাঁস পালো। জাতীয় সম্পদ বাড়বে।” (বাণী চিরসবুজ, কৃষি মন্ত্রণালয়, জুন ২০২১, পৃষ্ঠা নং ১৪২)। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা করোনা মহামারিকালীন দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বলেছেন- ‘এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি থাকবে না’।  কৃষিবান্ধব সরকার দেশের প্রতিটি বসতবাড়ি আবাদের আওতায় আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা বাস্তবায়নের ফলে দেশের সবজি পুষ্টি চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে। 
সবজি সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ সুষম খাদ্য তালিকায় অপরিহার্য অংশ। বিভিন্ন প্রকার সবজি খেলে শরীরের প্রতিদিনের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ হয় যা শরীরকে সুস্থ সবল ও কার্যক্ষম রাখতে সহায়ক। সবজিতে চর্বি ও শর্করার হার অত্যন্ত কম থাকায় শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে এটাকে ভাল খাদ্য হিসাবে বলা হয়ে থাকে। উপরন্তু সবজি জাত খাবারে কোলেস্টরেল না থাকায় হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপজনিত শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি অনেকাংশে কম। তাই বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্য তালিকায় সবজির গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ প্রবণতা উন্নত বিশ্বে স্বল্পোন্নত বিশ্বের তুলনায় অধিকতর লক্ষনীয়। এইসব দেশে মাথাপিছু প্রতিদিন সবজি গ্রহণের পরিমাণ দেশভেদে আমাদের মত দেশের তুলনায় অনেক বেশি। তাইতো মেধা ও বুদ্ধি বৃত্তির অধিকতর বিকাশসহ শারীরিক সক্ষমতার বিচারে ঐসব দেশের নাগরিকরা আমাদের থেকে অনেক অগ্রগামী। এ অবস্থার অবসানকল্পে আমাদের খাদ্য তালিকায় মানবদেহের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় দু’টি খাদ্য উপাদান, বিভিন্ন প্রকার খনিজ লবণ ও ভিটামিন এর পর্যাপ্ত প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের জন্য এগুলোর সবচেয়ে সহজলভ্য উৎস বিভিন্ন প্রকারের সবজির অন্তর্ভুক্তির কোন বিকল্প নেই। আমাদের শর্করা তথা ভাত নির্ভর খাদ্যভাস পরিবর্তন করে খাদ্য তালিকায় বৈচিত্রময় শাকসবজিকে প্রাধান্য দিতে হবে। 
বাংলাদেশে প্রায় আড়াই কোটি বসতবাড়ি রয়েছে। এসকল বসতবাড়িগুলো অনাবাদি অবস্থায় পতিত পরে থাকে বছরের পর বছর। এসকল জমি চাষের আওতায় আনা গেলে দেশে মানুষের পারিবারিক পুষ্টিচাহিদা মেটানোর পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের সক্ষম হবে। করোনাকালীন খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন এবং পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপন প্রকল্প’ কাজ করছে। মাননীয়  কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক এমপি বলেছেন- ‘পুষ্টিচাহিদা পূরণ আজ আমাদের সামনে বিশাল চ্যালেঞ্জ।’ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপন প্রকল্প’ সেই চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 
প্রকল্পটি দেশের ৬৪টি জেলার ৪৯২টি উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় ২৫৩.৬০ লক্ষ বসতবাড়ি রয়েছে, যার পরিমাণ ৫.৪০ লক্ষ হেক্টর। দেশের বসতবাড়ির গড় আয়তন ০.০২ হেক্টর। কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১৫১.৫৩ লক্ষ এবং আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ ২.২৩ লক্ষ হেক্টর। প্রকল্পের আওতায় সকল শ্রেণির কৃষক-কৃষানি যাদের বসতভিটা অনাবাদি পরে আছে সেই সকল জমি পরিকল্পিত উপায়ে চাষাবাদের আওতায় আনা হচ্ছে। বর্তমান সরকারে যুগান্তরকারী উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম হলো গৃহহীনদের জন্য গৃহ নির্মাণ ও গৃহের সংস্থান। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের জন্য নির্মিত গৃহের বসতভিটায় পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপনের মাধ্যমে হত দরিদ্র মানুষের পুষ্টি চাহিদা পুরণে প্রকল্পটি কাজ করছে। ৬,৮৩,৫৬০টি কৃষক পরিবার এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি উপকৃত হবে এবং ৪৫৫৪টি ইউনিয়ন ও ৩৩০ পৌরসভার প্রায় ৪১ লক্ষ কৃষক-কৃষানি পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে। 
প্রকল্প মেয়াদকালে পারিবারিক সবজি পুষ্টিবাগান প্রদর্শনী স্থাপন করা হবে ৪,৮৮,৪০০টি, স্যাঁতস্যেতে জমিতে কচু জাতীয় সবজি চাষ প্রদর্শনী স্থাপন করা হবে ৭৩৮০টি এবং ছায়াযুক্ত স্থানে/বসতবাড়িতে আদা/হলুদ চাষ প্রদর্শনী স্থাপন করা হবে ৭৩৮০টি। সকল প্রদর্শনীর সফল বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের ৫,০৩,১৬০টি বসতবাড়ির অনাবাদি/পতিত জমি বছরব্যাপী সবজি চাষাবাদের আওতায় আসবে। বসতবাড়িতে কালিকাপুর মডেল অনুসরণে সবজি চাষাবাদের ফলে প্রতিটি বসতবাড়িতে প্রতি মৌসুমে প্রায় ১০টি সবজি চাষ করা সম্ভব হবে। তিনটি মৌসুমে উৎপাদন করতে পারবে প্রায় ২৫-৩০ প্রকারের সবজি। যা পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে বাংলাদেশে সবজির গড় উৎপাদন ২৫-৩০ টন/হে.। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এই প্রকল্পের মাধ্যমে বছরে কেবল বসতবাড়ির অনাবাদি এবং পতিত জায়গার পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে ৮১,৬২৫ মেট্রিক টন (২৫ টন/হে. বিবেচনায়) বাড়তি সবজি উৎপাদন হবে। প্রতিটি বসতবাড়িতে ১ (এক) বছরে মোট সবজি উৎপাদন করা যাবে প্রায় ৩৬০ হতে ৩৯০ কেজি। কেজিপ্রতি বাজারমূল্য ৩০ টাকা হলে মূল্য হিসেবে প্রতি পরিবারের অর্থনৈতিক সাশ্রয় ১০,৮০০/- টাকা হতে ১১,৭০০/-টাকা। পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি এই অর্থনৈতিক সাশ্রয় পরিবারগুলো অন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় করতে পারবে।
আমাদের খাদ্য জগতে বিভিন্ন প্রকারের সবজিই সম্ভবত একমাত্র খাদ্য, শরীর গঠনে যার ইতিবাচক ছাড়া কোন নেতিবাচক প্রভাব নেই। তবে মানের দিক দিয়ে সেই সবজি হতে হবে নিরাপদ। খাদ্য নিরাপত্তার সাথে পুষ্টি নিরাপত্তার কার্যকর ভাবে সংযোগ ঘটাতে না পারলে খাদ্য নিরাপত্তা অর্থহীন হয়ে যাবে। আমাদের সংবিধানের ১৮(১) ধারায় বলা হয়েছে জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন। তাই বাংলাদেশ সরকার উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলকে খাদ্য সুরক্ষার পাশাপশি পুষ্টি সুরক্ষার মূল ক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত করেছে। 
বিবিএস ২০১৫ অনুযায়ী মোট ফসলি জমির পরিমাণ ৭.৯৩ মিলিয়ন হেক্টর যার মধ্যে সবজি ফসলের দখলে মাত্র ২.৬৩% এর কিছু উপরে। এ থেকে অনুমান করা যায় কত অল্প পরিমাণ জমি থেকে আমাদের ক্রমবর্ধিষ্ণু বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য সবজির চাহিদা মেটানো হচ্ছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস,২০১৭) তথ্য অনুযায়ী মাত্র ০.৪১ মিলিয়ন হেক্টর জমি থেকে ৪.০৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন (আলু বাদে) সবজি উৎপাদিত হয়েছে। সেই হিসাবে প্রতিদিন প্রতিজনের জন্য প্রায় ৭০ গ্রাম সবজি উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু এই পরিমাণ কখনোই মাথাপিছু প্রাপ্যতা হিসাবে ধরা যাবে না কারণ বিভিন্ন মাধ্যমের হিসাব মতে গড়ে যদি চার ভাগের এক ভাগও সংগ্রোহত্তর পর্যায়ে নষ্ট হয়ে যায় তা’হলেও তা ৫৪-৫৫ গ্রামে নেমে আসে। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে পরিমাণ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু সেটা যে ঋঅঙ কর্তৃক অনুমোদিত মাথাপিছু প্রতিদিন ২২০ গ্রাম এর তিন ভাগের এক ভাগের বেশি নয় তা মনে হয় বলাই যায়। সেক্ষেত্রে উৎপাদন বর্তমানের তিনগুণ বা তারও বেশি বৃদ্ধি করতে হবে। 
কাক্সিক্ষত খাদ্য পুষ্টি নিরাপত্তার লক্ষ্য অর্জন করতে আমাদের যেতে হবে বহুদূর। এর জন্য প্রয়োজন সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উন্নত জাতের বীজ, সার ও অন্যান্য পরিচর্যা নিশ্চিতকরণ; কারিগরি জ্ঞান, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনে উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ) গ্রহণ; পর্যাপ্ত পোস্টহারভেস্ট হ্যান্ডলিং অবকাঠামো (প্যাক-হাউজ, কুল স্টোর, রেফ্রিজারেটেড ট্রান্সপোর্ট) নির্মাণ; খাদ্যে দূষক এবং অবশিষ্টাংশ কার্যকরভাবে নিরীক্ষণের জন্য আইন প্রয়োগ; খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর এবং টেকসই সমন্বয় জরুরি; পর্যাপ্ত সংখ্যায় স্বীকৃত খাদ্য পরীক্ষার ল্যাব তৈরি করা; খাদ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আধুনিক কোর্স/পাঠ্যক্রম চালু; শর্করা তথা ভাত নির্ভর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে সুষম খাবার গ্রহণের নিমিত্ত বেশি বেশি শাকসবজি খাবার হিসেবে গ্রহণে উৎসাহিত করা; আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সুরক্ষা মান মেনে চলার মাধ্যমে রফতানি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া; খাদ্যের গুণমান, খাদ্য সুরক্ষা, খাদ্য প্রস্ততি, খাদ্য স্বাস্থ্যবিধি, রান্না ইত্যাদি সম্পর্কিত সচেতনতামূলক প্রচারণা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত খাদ্য মানের উপর ভিত্তি করে বিদ্যমান আইনগুলোকে আধুনিকায়ন করা; দূষক, টক্সিন এবং অবশিষ্টাংশের জন্য স্থানীয় এবং আমদানিকৃত উভয় পণ্যগুলোর পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা; ফার্মের উৎপাদিত পণ্যের সুরক্ষার জন্য উত্তম-কৃষি চর্চা (এঅচ) বিষয়ে ব্যাপক উৎসাহমূলক প্রচারণা আবশ্যক; উৎপাদনকারী এবং মধ্যস্থতাকারী মধ্যে কার্যকর সংযোগ স্থাপন ও উৎপাদন পর্যায়ে সঠিক মূল্য নিশ্চিত করা; পুষ্টি এবং খাদ্য সুরক্ষা বার্তাগুলো বেশি বেশি প্রচারের ব্যবস্থা করা; সারাদেশে খাদ্য সুরক্ষা সচেতনতা কার্যক্রমের ব্যাপক প্রচারণার ব্যবস্থা করা, খাদ্য সরবরাহ চেইনে খাদ্য সুরক্ষা ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে খাদ্যে দূষকের মাত্রা এবং হুমকির পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত সংযোজন করতে হবে; পরিবেশ বান্ধব এবং নিরাপদ উদ্ভিদ সুরক্ষা ব্যবস্থা যেমন জৈব কীটনাশক, ফেরোমন ফাঁদ, জৈব চাষের অনুশীলন ইত্যাদিকে উৎসাহিত করতে হবে; আধুনিক ল্যাব স্থাপনের মাধ্যমে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থাসহ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর সমাবেশ ও পাইকারি বাজার স্থাপন করা, সবজি ফসলের জন্য বিশেষায়িত শীতল আধুনিক স্টোরেজ প্রতিষ্ঠা করা; বড় পাইকারি বাজারের আশপাশে বড় আকারের বহুমুখী স্টোরেজ সুবিধা সৃষ্টি ও তা কার্যকর করা ইত্যাদি। 
সার্বিক বিবেচনায় এসব কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারলে দেশের মানুষের নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পুরণের মাধ্যমে গড়ে উঠবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণহীন সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। 
  
লেখক : প্রকল্প পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), অনাবাদি জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন প্রকল্প, ডিএই। মোবাইল : ০১৭১১০৭১৯৭৩,  ই-মেইল : akrambdp2100@gmail.com