Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

প্রাণিসম্পদ খাতে ইঁদুর দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি

প্রাণিসম্পদ খাতে ইঁদুর দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি
কৃষিবিদ ডা. মনোজিৎ কুমার সরকার
ইঁদুর হলো লম্বা দাঁতবিশিষ্ট স্তন্যপায়ী প্রাণি। কাঠবিড়ালী, সজারু একই বর্গের অন্তর্গত। ১৭০০ প্রজাতির ইঁদুর রয়েছে, তার মধ্যে প্রায় ১৮-২০টি প্রজাতি আপদবালাইরূপে পরিচিত। কাটাকাটি করা তাদের প্রকৃতিগত স্বভাব। ইঁদুর যে পরিমাণ খায় তারচেয়ে ১০ গুণ কেটে নষ্ট করে। ইঁদুর দ্রুত বংশবিস্তার করে। স্ত্রী ইঁদুর ৩ মাস বয়সেই প্রথম বাচ্চা দেয়। প্রসবের ২ দিন পরেই গর্ভধারণ করে। গর্ভকাল ১৮-২২ দিন মাত্র। বছরে ৫-৭ বার বাচ্চা দেয়। প্রতিবারে ৬-১০টি বাচ্চা প্রসব করে। জীবনকাল ২-৩ বছর।
গ্রীষ্মকালে ফসলের মাঠ ও বিভিন্ন স্থানে গর্ত করে বাস করে। বর্ষাকালে পানির জন্য উঁচুস্থানে আশ্রয় নেয়-সড়ক, বাঁধ, পুরনো ও পতিত ঘরবাড়ি, প্রাণীর খামার যেমন: মুরগি, গাভী, হাঁস, ছাগল-ভেড়া, শুকুর, টার্কি, কোয়েল প্রভৃতি, পোল্ট্রি হ্যাচারি, মুরগি ও পশুর খাদ্যের দোকানে, ফিড মিলের স্টোররুমে, খড়ের গাদায়, শুঁটকি মাছের আড়তসহ বিভিন্ন স্থানে বাস করে বিভিন্নভাবে কৃষকের আর্থিক ক্ষতি সাধন করে থাকে। সাধারণত ২ জাতের ইঁদুর বেশি ক্ষতি করে থাকে। যেমন : বড় ইঁদুর (ইৎড়হি ৎধঃ, জধঃঃঁং হড়ৎাবমরপঁং = ১২০০-৮০০ গ্রাম) রাতে সচল থাকে। ছোট ইঁদুর (ঐড়ঁংব ৎধঃ, গঁং সঁংপঁষঁং = ১২-৩০ গ্রাম) দিন ও রাত সচল থাকে।
প্রাণিসম্পদ খাতে ইঁদুর দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি
খড় কেটে ক্ষতি : বাংলাদেশে প্রতি বছর ইঁদুর মাঠের পাকা ধানগাছ কেটেকুটে গর্তে নিয়ে যায়, ফলে ধানের সাথে বিপুল পরিমাণ খড় নষ্ট করে থাকে। এ ছাড়াও কৃষকের সংরক্ষিত শুকনা খড়ের পালায় ইঁদুর প্রবেশ করে প্রচুর পরিমাণে খড় কেটে নষ্ট করে এবং মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলে। এ ক্ষতির পরিমাণ লাখ লাখ টাকা। দেশে গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত শুকনো খড় সংকটের কারণগুলোর মধ্যে এটি একটি অন্যতম কারণ।
বস্তা কেটে দানাদার পশুখাদ্য নষ্ট : পশু খাদ্য কারখানা, পশু খাদ্যের দোকান, শুঁটকি মাছের আড়ত ও খামারির স্টোররুমে রক্ষিত দানাদার খাদ্যের বস্তা কেটে খাদ্য খেয়ে ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিপুল পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য নষ্ট করে থাকে। যার মূল্য লাখ লাখ টাকা। আবার মুরগি, হাঁস ও কোয়েলের খামারে সন্ধ্যার পরে খাদ্যের পাত্র হতে ইঁদুর ওই খাদ্যে ভাগ বসায় ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে নষ্ট করে থাকে। এমনকি তারা পানির পাত্র হতে পানিও পান করে থাকে।
সাভার বাজারের ২০টি পশু খাদ্যের দোকানে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে বছরে ৪ লাখ টাকার ক্ষতি করে ইঁদুর। (সূত্র : প্রথম আলো)। বিশেষ করে রাতে মুরগির খামারে ইঁদুর প্রবেশের কারণে খাদ্য নষ্ট ছাড়াও ভয়ভীতি ও আতঙ্কের কারণে মুরগির ডিম উৎপাদন ব্যাহত হয়। বড় ইঁদুর ছোট মুরগির বাচ্চাকে মেরে ফেলে এবং মুরগির বাচ্চা ও ডিম খেয়ে থাকে।
ঘাস কেটে ক্ষতি : ইঁদুর মাঝে মাঝে ঘাসের জমিতে গর্ত করে ঘাসের চারা কেটে ঘাসের উৎপাদন ব্যাহত করে।
পশু-পাখিতে বিভিন্ন রোগ ছড়ানো : খড়ের পালা, খাদ্য কারখানা, পশু খাদ্যের দোকান ও গবাদিপশু পাখির খামারে ইঁদুর বসবাস করার কারণে বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে থাকে।
ইঁদুরের মলমূত্র, লালা, বাসা তৈরির দ্রব্য ও ইঁদুরের মৃতদেহ দ্বারা যখন খামারে মেঝে, খাদ্য, বাতাস দূষিত হবে তখন খামারের পশুপাখি বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়। আবার ইঁদুরের কাছ থেকে পরোক্ষভাবে টিকটিকি ও মাছির মাধ্যমেও রোগ ছড়ায়। ইঁদুরের মলমূত্র দ্বারা দূষিত খাদ্য খেয়ে গরু খবঢ়ঃড়ংঢ়রৎড়ংরং রোগে আক্রান্ত হয়, যা গর্ভপাত ঘটিয়ে থাকে।
ইঁদুরের মৃতদেহ মিশ্রিত খড়, সাইলেজ ও দানাদার খাদ্য খেয়ে গবাদিপশু বটুলিজম বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে। অনেক সময় মরা ইঁদুর ফিডমিলে মিক্সার মেশিনের মাধ্যমে দানাদার খাদ্যে মিশে যায় এবং বটুলিজম বিষ ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য মাঝে মাঝে খড়ের পালা, দানাদার খাদ্যের ভা-ার পর্যক্ষেণ করতে হবে। ইঁদুর গবাদি প্রাণির যে সব সংক্রামক রোগ ছড়ায় তা নিম্নরূপ-
১. খবঢ়ঃড়ংঢ়রৎড়ংরং - সকল গবাদিপশু, কুকুর, বিড়াল, শুকর।
২. ঝধষসড়হবষষড়ংরং - সকল গবাদিপশু, কুকুর, বিড়াল, শুকর ও পাখি।
৩. ঊথঈড়ষর - সকল গবাদিপশু ও পাখি, কুকুর, বিড়াল, শুকর, খরগোশ।
৪. ঞড়ীড়ঢ়ষধংসধ মড়হফর - সকল প্রাণি, শুকর, কুকুর, বিড়াল।
৫. ঝঃৎবঢ়ঃড়নধপরষষড়ংরং - সকল পশুপাখি।
৬. ঞৎরপভরহবষষধ - শুকর।
৭. খঁহম ড়িৎস - সকল গবাদিপশু কুকুর, বিড়াল।
৮. এরধৎফরধ - সকল গবাদিপশু, কুকুর, শুকর, বিড়াল।
৯. ঘবড়ংঢ়ড়ৎধ (চৎড়ঃড়ুড়ধ) - গবাদিপশু।
১০. ঞঁষধৎবসরধ - গবাদিপশু।
১১. এধহ এধহ ারৎঁং - গবাদিপশু।
১২. গধসসধৎু ঃঁসড়ঁৎ ারৎঁং - গবাদিপশু।
১৩. মিউরিন টাইফাস- গবাদিপশু।
কুকুর, বিড়াল সরাসরি ইঁদুরকে কামড়িয়ে বা খেয়ে বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়। ইঁদুরের প্রস্রাব দ্বারা দূষিত খাদ্য খেয়েও কুকুর, বিড়াল সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়। এতে করে চিকিৎসা করতে অনেক টাকা খরচ হয়ে থাকে। ইঁদুর মুরগি, হাঁস ও কোয়েলের খামারের প্লাস্টিক নেট, কাঠের দরজা, পলিথিন, চটের পর্দা ইত্যাদি কেটে আর্থিক ক্ষতি করে থাকে।
খামারে ইঁদুর দমন ও প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা
ইঁদুর প্রতিরোধে ফসল ও প্রাণিসম্পদের ক্ষেত্রে অনেকটা একই রকম।  দমন পদ্ধতিকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে-
১) অরাসায়নিক দমন : গর্ত খুঁড়ে দমন; গর্তে পানি ঢেলে দমন; গর্তে মরিচের ধোঁয়া প্রয়াগ; ফাঁদ ব্যবহার (বাঁশের, কাঠের, লোহার ও মাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ) করে দমন; গ্লুবোর্ড বা মেঝেতে গ্লু বা আঠা লাগিয়ে রাখা; প্রতিরোধক জাল ব্যবহার করা ও বিভিন্ন যান্ত্রিক উৎপীড়ক ব্যবহার।
২) রাসায়নিক দমন : বিভিন্ন বিষটোপ খেলে দ্রুত মারা যায়; গ্যাসবড়ি গর্তে প্রয়োগ করতে হয়। রাসায়নিক দমন পদ্ধতি পশু-পাখির শেডের মধ্যে ব্যবহার না করাই উত্তম। শেডের বাইরে সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩) জৈবিক দমন : শিয়াল, বেজি, প্যাঁচা, বনবিড়াল, সাপ, গুইসাপ, চিল ইত্যাদি কিন্তু এগুলো পশু-পাখির শেডের মধ্যে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়।
খামারের জীব নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। খামারের চারপাশ, ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার করতে হবে। রাতে মুরগির খাদ্যের পাত্র থেকে খাদ্য সরিয়ে নিতে হবে। রাতে কোন ডিম যেন না থাকে, ডিম ইঁদুরের প্রিয় খাদ্য। পানির পাত্র থেকে পানি সরিয়ে নিতে হবে। মুরগির খামার ও হ্যাচারি তৈরিতে প্লাস্টিক, কাঠ, রাবার ও গ্রিন সিমেন্ট ব্যবহার না করে শক্ত দ্রব্য ব্যবহার করতে হবে। যেমন- কনক্রিট, গ্যালভানাইজড সিট (২৪ গজ), লোহার জালি ইত্যাদি।
মুরগির খামার ও হ্যাচারির দরজা এমনভাবে সেট করতে হবে যেন নিচ দিয়ে ইঁদুর প্রবেশ করতে না পারে (ডবষষ ংবধষবফ)। বিষটোপ ব্যবহার করার পর খেয়াল রাখতে হবে যেন মৃত ইঁদুর খেয়ে পশু-পাখি সেকেন্ডারি বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত না হয়।
ইঁদুর প্রাণিসম্পদ খাতে বিভিন্নভাবে অনেক টাকার ক্ষতি করে থাকে। এ জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সঠিক স্থানে, সঠিক সময়ে ও সঠিকভাবে ইঁদুর দমন করা প্রয়োজন।

লেখক : জেলা ভেটেরিনারি অফিসার, ঝিনাইদহ, মোবাইল : ০১৭১৫২৭১০২৬, ই-মেইল : drmorogit66@gmail.com