Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

মুগডালের বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ

মুগডালের বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
ড. মোঃ ওমর আলী
সৃষ্টির আদিকাল থেকেই বাংলাদেশে ডাল চাষ হয়ে আসছে। আর সেই সাথে আমাদের খাদ্য  সংস্কৃতিতে ডাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কারণ ডাল থেকে পাওয়া যায় সহজে হজমযোগ্য আমিষ। ডাল গরিবের মাংস হিসেবে পরিচিত। বিশ^ খাদ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিদিন একজন মানুষের ৪০-৪৫ গ্রাম ডাল খাওয়া উচিত। কিন্তু আমরা সেখানে খাচ্ছি মাত্র ১৭ গ্রাম। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। অথচ আমাদের দেশে স্বল্প পরিচর্যা ও বৃষ্টিনির্ভর ফসল হিসেবে ডালের চাষ হয়ে আসছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টিস্বল্পতা দূর করতে, মাটির হারানো উর্বরাশক্তি ফিরে পেতে, মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে, সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ডালের আবাদ বৃদ্ধি এ সময়ের অগ্রগণ্য দাবি। ডাল আবাদে জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে উন্নত জাত ও প্রযুক্তি, ভালো বীজ এবং অনেক ক্ষেত্রে উপযোগী জমির বিষয়ে খেয়াল রেখেই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ডাল গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীবৃন্দ উদ্ভাবন করেছেন উচ্চফলনশীল জাত ও উন্নত প্রযুক্তি। এসব উন্নত প্রযুক্তির মধ্যে ডাল ফসলের সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানে উল্লেখ্য, ডাল ফসলের সংগ্রহ ও সংরক্ষণের উপরই অনেকাংশেই নির্ভর করে বীজের মান। কিন্তু দেখা যায় সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সময়ই সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন না করার জন্য বীজের পরিমাণ ও গুণাগুণ অনেকাংশে কমে যায়। গবেষণায় দেখা যায় অন্যান্য সকল বিষয় অপরিবর্তিত রেখেও শুধু ভালো বীজ ব্যবহারের মাধ্যমেই কোন ফসলের ফলন ১৫-২০% বৃদ্ধি করা সম্ভব। আর ভালো মানের বীজ থেকেই পাওয়া যায় ভালো ফসল। সুতরাং ভালো বীজ উৎপাদনের পাশাপাশি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা সম্পর্কে কৃষকের পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং তা সঠিকভাবে অনুসরণ করতে হবে।
মুগডালের ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য : উচ্চফলনশীল হতে হবে; বীজ বিশুদ্ধ হতে হবে; বীজ রোগ ও পোকামুক্ত এবং রঙ হবে উজ্জ্বল; সম আকারের বীজ দানা পুষ্ট হতে হবে; বীজে পানির পরিমাণ ৯-১০% এর মধ্যে থাকতে হবে; সর্বোপরি, বীজের গজানোর ক্ষমতা শতকরা ৭৫ ভাগের ওপরে হতে হবে; দেশে ৪ ধাপে বীজ বর্ধন হয়ে থাকে, যথা-মৌল বীজ (ব্রিডার বীজ), ভিত্তি বীজ, প্রত্যয়িত বীজ ও মানঘোষিত বীজ (ঞখঝ) এবং এগুলোর সাথে সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জড়িত।কৃষকগণ প্রত্যয়িত বীজ ও মানঘোষিত বীজ উৎপাদন করতে পারেন। এই সমস্ত বীজের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য সরকার নির্ধারিত নির্দিষ্ট মানদ- মেনে চলা হয়।
মুগডাল সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সময় করণীয়  
ফসল কর্তন : সঠিক সময়ে ফসল কর্তন করলে একদিকে যেমন বেশি ফলন পাওয়া যায়, অন্যদিকে মানসম্মত ফসলও পাওয়া যায়। সঠিক সময়ে সঠিকভাবে কর্তন না করলে প্রায় ৫-৭% ফসল/দানা ঝরে মাঠেই নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য পরিপক্ব ডাল জমিতে অধিক সময় না শুকিয়ে সময়মতো কেটে সরাসরি মাড়াই স্থানে নেয়া উচিত। এখানে উল্লেখ্য যে, ফসল কাটতে হবে কিন্তু মাটি থেকে টেনে উঠানো ঠিক নয়। কারণ এতে শিকড়ের সাথে মাটিসহ অন্যান্য উপাদান মিশে বীজের গুণাগুণ নষ্ট হয় এবং মাটিও তার কিছুটা জৈব পদার্থ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
মাড়াই ও শুকানোর স্থান : মাড়াই ও শুকানোর স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়। মাড়াই ও শুকানোর জন্য পলিথিন সীট, পাকা মেঝে বা মাটির ওপর গোবরের প্রলেপ ব্যবহার করা যেতে পারে। মাড়াই ও শুকানোর স্থান অবশ্যই পোকামাকড় ও জীবাণুমুক্ত হতে হবে। বিভিন্ন ময়লা দানার সাথে মিশে দানাকে খাওয়ার/বীজের অনুপযোগী করে তোলে, যার ফলে ফসলের বাজারমূল্যও কমে যায়।
মুগের পড সংগ্রহের উপযোগী অবস্থা : সাধারণত অধিক পাকলে দানা ঝরে যায়। শুঁটি বা পড কালচে রঙ হলে বুঝতে হবে পরিপক্ব হয়েছে। খরিফ-১ ও বিলম্ব রবিতে সব ফল/পড এক সাথে পাকে না। ২-৩ বারে ফল সংগ্রহ করতে হয়। পরিষ্কার সূর্যালোকে ফল তুলে শুকিয়ে লাঠি দ্বারা মাড়াই করতে হবে। তবে খরিফ-২ মৌসুমে সব ফসল একসাথে পাকে, তখন গাছ কেটে এনে শুকিয়ে গরু ঘুরিয়ে/লাঠি দ্বারা খুব সাবধানে পিটিয়ে মাড়াই করতে হবে।
দানা পরিষ্কারকরণ : দানা সব সময় পরিষ্কার স্থানে শুকানো দরকার; ঝাড়াই কাজে বাঁশের কুলা ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া ফ্যানের বাতাসে বা মেশিনের সাহায্যেও বীজ ঝাড়াই বাছাই করা যেতে পারে। তবে প্রবল বাতাসে দানা ঝাড়াই করা উচিত নয়; সঠিক মাপের চালুনি দিয়ে দানা চেলে নিতে হবে; স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ঝাড়াইয়ের সময় মুখে পাতলা কাপড় বেঁধে নেয়া উত্তম।
গুদামজাতকরণের জন্য বীজ শুকানো : মাড়াইকৃত মুগডাল পরিষ্কার করে সূর্যের তাপে শুকিয়ে গুদামজাত করতে হবে। বীজ সারাদিন ধরে না শুকিয়ে ৪-৫ ঘণ্টা করে ৩-৪ দিন শুকালে বীজ ভালো থাকে; শুকানোর সময় হঠাৎ বৃষ্টিপাতের ক্ষতি এড়াতে পলিথিন শিট ব্যবহার করা উত্তম; আর্দ্র বীজ একসাথে অধিক পরিমাণ জড়ো করে না রেখে ছড়িয়ে রাখা উচিত; বৃষ্টির পর বীজ পুনরায় শুকিয়ে নিতে হবে; বীজ এমনভাবে শুকাতে হবে যাতে বীজে আর্দ্রতার পরিমাণ ৯-১০% থাকে; বীজ দাঁতের নিচে দিয়ে কট শব্দ করলে বুঝতে হবে বীজ শুকিয়েছে; শুকানো বীজ বাতাসে রেখে ঠা-া করতে হবে।
বীজমান : বীজের আর্দ্রতা ৯-১০%, বিশুদ্ধতা ৯৫% এবং অংকুরোদগম ক্ষমতা ৭৫% এর ওপরে হতে হবে।
বীজ সংরক্ষণ পূর্ব পরীক্ষা : গুদামে বা পাত্রে রাখার পূর্বে ডালবীজ ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। সমস্ত বীজ থেকে প্রতি ১০ গ্রাম করে ৩টি নমুনা সংগ্রহ করতে হবে এবং তা ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে উক্ত ডালের নমুনা বীজে কোনো পূর্ণাঙ্গ পোকা বা বীজের ওপর সাদা ডিম আছে কি না। যদি কোনো পোকা বা সাদা ডিম না থাকে তাহলে বীজ যে কোনো ছিদ্রহীন পাত্র যেমন: আলকাতরার প্রলেপযুক্ত মাটির পাত্র, টিন, লোহা, কাঠের পাত্র এবং মোটা পলিথিন ব্যাগে রাখা যায়। পলিথিন লাইনিংযুক্ত বস্তায়ও বীজ রাখা যেতে পারে।
গুদামজাতকরণ : ডাল ফসল সংগ্রহের পরই সংরক্ষণ জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। বীজের আর্দ্রতা এবং গুদামের তাপমাত্রা এ দুটো বিষয়ের ওপরই প্রধানত গুদামে ডাল ফসলের গুণগতমান নির্ভর করে। এজন্য গুদামে এ দুটো বিষয়ই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সঠিকভাবে গুদামজাতকরণের অভাবে প্রায় ১২-১৫% দানা নষ্ট হয়। কারণ গুদামে আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বীজে পোকা ও রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। সঠিকভাবে আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে উন্নত গুদাম এবং সঠিক স্বতন্ত্রীকরণ দূরত্বের ব্যবস্থা করতে হবে। ডাল ফসলের বীজ সাধারণত কৃষক, ব্যবসায়ী এবং ডিলাররা পরবর্তী মৌসুম পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের গুদাম বা পাত্রে সংরক্ষণ করে থাকে। কৃষক পর্যায়ে ডাল ফসল সংরক্ষণের জন্য সুপারিশকৃত পাত্রগুলো হচ্ছে- পলিথিনযুক্ত পাটের বস্তা; পলিথিন লাইনিংকৃত মটকা; আলকাতরার প্রলেপযুক্ত মটকা/মাটির পাত্র; উন্নত ধরনের টিনের পাত্র; লোহার ড্রাম, প্লাস্টিক ড্রাম প্রভৃতি।
ব্যবসায়ী ও ডিলার পর্যায়ে ডাল ফসল সংরক্ষণের সুপারিশকৃত পাত্র- পলিথিনযুক্ত বস্তা; পলিথিনযুক্ত ঝারি; লোহার ড্রাম; ঠা-া ঘর (কুল হাউজ)।
সাবধানতা : আর্দ্রতা নিরোধক পাত্রে ডাল ফসল সংরক্ষণ করতে হবে; ভালোমানের বীজ সংগ্রহ করতে হবে; নতুন ও পুরনো বীজ মেশানো যাবে না; সংরক্ষিত বীজে আর্দ্রতার পরিমাণ  ৯-১০% হতে হবে; সংরক্ষিত পাত্রের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে যাতে পাত্রের মধ্যে আর্দ্রতা ও পোকা প্রবেশ করতে না পারে; ডাল বীজ সংরক্ষিত পাত্র মেঝেতে না রেখে মাচা/চৌকিতে রাখতে হবে; অর্থাৎ মেঝে থেকে উপরে রাখতে হবে; গুদাম ঘর ঠা-া এবং শুকনা হতে হবে; গুদাম ঘরের চারদিকে পরিষ্কার ও ইঁদুরমুক্ত হতে হবে; কুল হাউজের তাপমাত্রা ১২-১৫০ সেন্টিগ্রেড এবং আর্দ্রতা ৫০-৬০% হতে হবে।
পোকামাকড় দমন : পালস বিটল অর্থাৎ ডালের শুষড়ি পোকা সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকা। প্লাস্টিক ব্যাগে মজুদ করার আগে ডেসিস ২.৫ এর ১ মিলিলিটার প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ব্যাগের বাইরের দিকে শোধন করে নিতে হবে; অল্প পরিমাণ বীজের ক্ষেত্রে গুদামে প্রতি কেজি বীজের জন্য ৮ মিলি. নিমতেল শুকনা বালুসহ পাত্রের ওপরের অংশে রেখে পাত্র/ব্যাগের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করে দিতে হবে; প্রতি ৫০-১০০ কেজি বীজের জন্য ১টি এ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (ফসটক্সিন ট্যাবলেট) ন্যাকড়ার পুঁটলিতে বেঁধে ব্যবহার করলে প্রায় ১ (এক) বছর বীজ ভালো থাকবে; বিভিন্ন ধরনের পাত্রে সংরক্ষিত মুগডাল বীজের অংকুরোদগমের উপর গুদামজাতকরণের প্রভাব গবেষণাভিত্তিক ফলাফল টেবিল-১ দ্রষ্টব্য।
টেবিল-১ বিভিন্ন পাত্রে সংরক্ষিত মুগবীজের অংকুরোদগমের উপর গুদামজাতকরণের প্রভাব
উপরের টেবিল থেকে প্রতীয়মান হয়েছে যে, বীজ যে পাত্রেই রাখা হউক না কেন আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে থাকলে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয় না। কিন্তু বীজে আর্দ্রতা বেড়ে গেলে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা মারাত্মকভাবে নষ্ট হয়।
গুদাম পরিদর্শন এবং রক্ষণাবেক্ষণ
গুদামজাতকৃত ডালশস্য নিয়মিতভাবে পরিদর্শন করতে হবে। সম্পূর্ণ শুষ্ক ও আর্দ্রতা নিরোধক পাত্রে মুগডালের বীজ রাখার পরও পোকা ও ইঁদুরের আক্রমণে ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে লক্ষ রাখা দরকার। আর্দ্রতা ও পোকা নিরোধক পাত্রে বীজ রাখলেও পোকার আক্রমণ ও আর্দ্রতা যাতে না বাড়ে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। গুদামে পোকামাকড় ও ইঁদুরের আক্রমণ যাতে না ঘটতে পারে সেজন্য মাঝে মাঝে পরিদর্শনপূর্বক প্রয়োজনে অনুমোদিত মাত্রায় কীটনাশক ছিটাতে হবে। ডাল বীজের আর্দ্রতা বেড়ে গেলে পুনরায় বীজ শুকিয়ে গুদামজাত করতে হবে।

লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ডাল গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, জয়দেবপুর, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১২৫৪৩৭২০, ই-মেইল : ড়সধৎধষরঢ়ৎপ@মসধরষ.পড়স