Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

নিরাপদ মধুতে স্বাবলম্বিতা অর্জনে আমাদের করণীয়

নিরাপদ মধুতে স্বাবলম্বিতা অর্জনে আমাদের করণীয়
মো. কাওছারুল ইসলাম সিকদার
সুন্দরবনের মধু অনেকের কাছে অত্যন্ত লোভনীয়। প্রাকৃতিক উপায়ে যে মধু সুন্দরবন হতে পাওয়া যায় তার চাহিদা ব্যাপক। সুন্দরবনে যে সকল মৌমাছি রয়েছে সেগুলোর আকার অনেকটা বড় ও বন্য। এ সকল মৌমাছি সুন্দরবনের বিভিন্ন গাছ-পালায় যে মৌচাক তৈরি করে তা হতে স্থানীয় মধু সংগ্রহকারীরা (মৌয়াল) মধু সংগ্রহ করে। মৌমাছির বিভিন্ন জাত রয়েছে। অঞ্চলভেদে মৌমাছির জাতের ভিন্নতা পাওয়া যায়। বাংলাদেশে সাধারণত পাঁচ (০৫) রকমের মৌমাছি দেখা যায়। বিশ^ব্যাপী প্রায় ২০,০০০ প্রজাতির মৌমাছি রয়েছে বলে জানা যায়। জাতের ভিন্নতার উপর মধু গুনাগুণ ও বৈচিত্র্য রয়েছে।
মধু স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। মধু দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, আরোগ্য লাভ, ওজন কমাতে, অনিদ্রা দূর করতে, পেটের সমস্যায় এবং ঠা-া ও সর্দিজনিত রোগ নিরাময়ে অত্যন্ত কার্যকর। আমাদের দেশে শীতকালে এর চাহিদা বেশি থাকে।  মধু পানিতে মিশিয়ে শীতকালে খেলে দেহ উষ্ণ হয়, আবার গ্রীষ্মকালে দেহ শীতল বা প্রশান্তি লাভ করে। তাই নিরাপদ মধু ভোগ নিশ্চিতে মৌচাক সংগ্রহ হতে শুরু করে বিপণন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ শৃঙ্খলকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। তবেই দেশীয় মধুরপ্রতি ভোক্তার আস্থা বাড়বে ভিন্ন দেশীয় মধুরপ্রতি নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে।
মৌমাছি মানব সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর দ্বারা ফুলের পরাগায়ন ঘটে। পরাগায়নের মাধ্যমে পুরুষ ফুলের সাথে স্ত্রী ফুল নিষিক্ত হয়, ফলে ফুল হতে শস্য, ফল ও বীজ তৈরি হয়। মৌমাছি যখন এক ফুল হতে অন্য ফুলে গমন করে তখনই পরাগায়ন সংগঠিত হয়। এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। পরাগায়নের মাত্রা যত বাড়বে ততই শস্য, ফল, বীজের উৎপাদন বাড়বে।  তাই মৌমাছি হতে কেবলমাত্র মধু পাওয়া যায় এমনটি নয় বরং ফল ও ফসলের উৎপাদনও বাড়ে। বর্তমানে ফসলি জমির মাত্র ১০ ভাগ জমিতে মধু চাষ হয়। এটির পরিমাণ বৃদ্ধি করে মধুর উৎপাদন বৃদ্ধি ও আমদানির নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব। মৌচাষের সাথে ফসলি জমিতে যে ফসল ফলানো হয় তাতে প্রায় ২০-৩০ ভাগ ফলন বৃদ্ধি পায়। তাই অধিক ফলন, কর্মসংস্থান, মধু উৎপাদন ও মধুতে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে মধুর চাষ বৃদ্ধি করার ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহন আবশ্যক। এছাড়া মৌমাছির তৈরি মৌচাক হতে প্রাকৃতিক মোম পাওয়া যায়। এটির বাজার মূল্যও কম নয়। এটি বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
এদেশের শীত ও গ্রীষ্ম উভয় মৌসুম মধু চাষের জন্য উপযুক্ত। শীতে বিভিন্ন শস্যের ফুল এবং গ্রীষ্মে বিভিন্ন ফল গাছের ফুল হতে মধু সংগ্রহ হয়। বর্ষা মৌসুমে মধু সংগ্রহের জন্য তেমন কোনো ফুল থাকে না তাই বাংলাদেশের বর্ষা মৌসুম মধু সংগ্রহের জন্য তেমন উপযুক্ত নয়। এই সময় চিনির সিরা দিয়েই মৌ চাষের মৌপোকাসমূহ বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চলে। গ্রীষ্ম মৌসুমে বিশেষ করে যখন আম, লিচু, পেয়ারা ইত্যাদি ফলের গাছে ফুল আসে এবং শীতকালে তিল, সরিষা, কালিজিরা ফসলে মাঠ ভরে যায়, তখন মৌচাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বর্তমানে মৌচাষের দিকে যুবসমাজ আকৃষ্ট হচ্ছে। বিসিকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে (ঘএঙ) মৌচাষের কৌশল ও উপকরণ সরবরাহ করছে।
মধুর গুণগতমান পরীক্ষার অনেক প্রচলিত ধারণা রয়েছে। যেমন মধু পানিতে মিশবে না, আগুনে জ¦লবে না, নখের মধ্যে রাখলে পড়বে না, পিপড়ায় মধু খায় না, খাঁটি মধু জমবে না ইত্যাদি। এগুলোর কোনটিই ঠিক নয়। মধু পরীক্ষা করতে হবে পরীক্ষাগারে। এর মধ্যে বিদ্যমান উপকরণসমূহ যথাযথ পাওয়া গেলেই মধু খাঁটি বলে নিশ্চিত হওয়া যাবে। এছাড়া খাঁটি মধু নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ জন্য মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পরীক্ষা অত্যাবশ্যক। চহিদার তুলনায় দেশে মধুর যোগান ৭০% কম, সেক্ষেত্রে মৌচাষের পরিধি বাড়াতে হবে। তবেই ভেজাল মধুর দৌরাত্ম্য কমবে।
সুন্দরবনের মধুকে অর্গানিক মধুও বলা যায়। কারণ প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বনফুল হতে এই মধু সংগৃহীত হয়। মধুতে গ্লুকোজ, ফুক্টোজ, পলিস্যাকারাইড, প্রোটিন, বিভিন্ন ভিটামিন, লবণ ও পানি থাকে। সুন্দরবনের মধুর তারল্যতা বেশি। কারণ এই মধুতে প্রায় ২৯-৩০% পর্যন্ত পানি থাকে। সুন্দরবনের মধুতে পানি বেশি থাকার অন্যতম কারণ পরিবেশ ও জলবায়ু। বঙ্গোপসাগরের তীরে সুন্দরবন, তাই স্থানীয় জলবায়ুতে আর্দ্রতা বেশি। যেহেতু এটি একটি “ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট” তাই প্রতিদিন একাধিকবার সমুদ্রের জোয়ারে এখানকার বৃক্ষসমূহ জলমগ্ন হয়। এসকল কারণে এই বনের গাছপালা, ফুলফল প্রভৃতিতে  পানির পরিমাণ বেশি থাকে। মরুভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে যে মধু সংগ্রহ করা হয়, তাতে পানির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। আবার মরুভূমির শুষ্ক আবহাওয়ায় মধুতে যে পানি থাকে তা দ্রুত শুকিয়ে যায়। যার কারণে মরুভূমি অঞ্চলের মধুর ঘনত্ব বেশি এবং দীর্ঘসময়  প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত থাকে। তেমনিভাবে পাহাড় বা অঞ্চলভেদে মধুতে পানির পরিমাণের হেরফের ঘটে। মধুতে পানি থাকলে তা দ্রুত গাজন ঘটে এবং নষ্ট হয়ে যায়। দীর্ঘদিন গুণগতমান যথাযথ থাকে না। এ কারণে মধুকে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে পানির অংশ দূরীভূত করে মধু সংরক্ষণ করা হয়, যাতে দীর্ঘমেয়াদি তা সংরক্ষণ ও ভোগ করা সম্ভব হয়।      
মধু দীর্ঘসময়ে ভাল রাখার জন্য মধু মোড়কীকরণে কি ধরনের পাত্র ব্যবহার করা উচিত সে বিষয়েও জ্ঞানের অভাব রয়েছে। তাই সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মধু চাষিদের জন্য স্বতন্ত্র পোশাক, মাথা ও মুখে ব্যবহারের জন্য হেলম্যাট ও জাল এবং মধু সংগ্রহে ব্যবহৃত উপকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বন বিভাগ কর্তৃক স্বতন্ত্র লগোযুক্ত পোশাক ও উপকরণ, বিসিক হতে প্রশিক্ষণ ও প্রশাসন হতে প্রয়োজনীয় অন্যান্য সহযোগীতা প্রদান করতে হবে। এতে দুটি লাভ হবে। প্রথমত মৌচাক রক্ষা ও নিরাপদ মধু সংগ্রহ, দ্বিতীয়ত মৌয়াল ছাড়া অন্য কেউ সুন্দরবন হতে মধু সংগ্রহ করতে পারবে না।
বিশেষ করে মাছ ধরার নৌকা মধু সংগ্রহে যুক্ত হতে পারবে না। স্থানীয় সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নিলে সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ এবং বিপণন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করবে। মধুর নিরাপদতা সম্পর্কে ভোক্তাদের আস্থা অর্জিত হবে।  মধুর বিশুদ্ধতা এবং নিরাপদতা নিশ্চিতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মান নির্ধারণ এবং বিএসটিআই  কর্তৃক তা বাজারজাতকরণের অনুমোদন প্রদান করা হলে জনগণের আস্থা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। এতে কেবলমাত্র দেশেই নয় বিদেশেও মধু রপ্তানি সম্ভব হবে। যেমনটি প্রতিবেশী দেশের ডাবর ব্র্যান্ড অর্জন করেছে। সুন্দরবনের মধুর ব্র্যান্ড সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে যেমন যথাযথ পরীক্ষা, লেবেলিং ও প্রচার। নিরাপদ মধু সংগ্রহে ও স্বালম্বিতা অর্জনে করণীয়
    মধু সংগ্রহ হতে ভোক্তা অবধি পূর্ণাঙ্গ শৃঙ্খল বিজ্ঞানভিত্তিক হতে হবে।
    মধু চাষে মহিলাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং প্রযুক্তি সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করতে হবে।
    বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মধুর মাননির্ধারণ করে দিতে হবে।
    নিরাপদ মধু জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা, পরীক্ষাগার ও ব্র্যান্ডিং নিশ্চিত করতে হবে।
    মধুকে ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক দূষণ হতে রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সকল মৌয়াল ও মধু চাষিদের জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
    বিপণনে নিরাপদ মোড়কীকরণ ও লেবেলিং নিশ্চিত করতে হবে।
    মাস্টার প্ল্যান নিয়ে মধু সংগ্রহে স্বাবলম্বীতা অর্জন করতে হবে।
    মধু আমদানি শূন্যের কোঠায় আনতে দীর্ঘমেয়াদি নীতি অবলোকন করতে হবে।
    মধু উৎপাদন টেকসই করার জন্য অঞ্চলভিত্তিক মধু সংগ্রহ অভিযান বৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
    সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মধু সংগ্রহকারীদের মহাজনদের দৌরাত্ম্য হতে রক্ষায় জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সমিতির ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। গরিব মৌয়ালিদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।
    মধু সংগ্রহ নিষিদ্ধকালীন সময়ে মৌচাষিদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।
    মধু মৌচাক হতে মধু সংগ্রহ হতে ভোগ অবধি একটি পূর্ণাঙ্গ গাইড লাইন তৈরি করতে হবে।
    মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধি করতে হবে।
    মধুচাষিদের অঞ্চলভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা ও সকল মৌচাষিদের অ্যাসোসিয়েশনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
    অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকলের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।  
    প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় সকল মৌচাষিদের মধু নির্দিষ্ট দামে ক্রয় করতে হবে ।
    একটিমাত্র ব্যান্ডে সুন্দরবনের মধু দেশে ও বিদেশে বিপণনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ।
    সুন্দরবনের অর্গানিক মধুর দাম ও চাষের মাধ্যমে উৎপন্ন মধুর দাম জেলা প্রশাসনের সহায়তায় পৃথকভাবে নির্ধারণ ও বিপণন করতে হবে ।
    আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতার মাধ্যমে অসাধু মধু সংগ্রহ ও বিক্রয়কারীদের নিষিদ্ধ করতে হবে ।
মধু চাষের জন্য স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও সহজ সরল প্রযুক্তি প্রয়োজন হয়। মধু চাষের জন্য খুব একটা বেশি বিনিয়োগেরও প্রয়োজন হয় না। ক্ষুদ্র বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদের মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়ের সংস্থান করে লাভবান হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে আরো উদ্যোগী হতে হবে। তবেই টেকসই মধু উৎপাদন সম্ভব হবে। মধু উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে মধু আমদানি হ্রাস ও বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে।

লেখক : অতিরিক্ত পরিচালক (উপসচিব), বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, মোবাইল : ০১৫৫২৩৫৫৮৫৩ ই-মেইল: kawserul1173@gmail.com