Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের স্বাস্থ্য উপকারিতা

দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের স্বাস্থ্য উপকারিতা
ডা. মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ
দুধ আমাদের দেহের জন্য সব চাইতে উপাদেয় খাবার। আমাদের দেহের শারীরবৃত্তীয় কার‌্যাবলি পরিচালনার জন্য দৈনিক যে পরিমাণ ভিটামিন ও মিনারেলের প্রয়োজন, তার একটি বিরাট অংশ আমরা দুধ এবং দুগ্ধজাত খাদ্য থেকে পেয়ে থাকি। প্রতিদিন খাবার তালিকায় মাত্র এক গ্লাস দুধ আমাদের দেহের যতটা উপকার করে তা অন্য কোনো খাবার করতে পারে না। এই কারণেই দুধকে বলা হয় সর্বগুণ সম্পন্ন খাবার অর্থাৎ আদর্শ খাদ্য (ওফবধষ ঋড়ড়ফ)। নি¤েœ দুধ ও দুধ থেকে তৈরিকৃত খাদ্যের উপকারিতা আলোচনা করা হয়েছে।
দৈনিক দুধ পানের উপকারিতা
মজবুত হাড় ও দাঁত : দুধ ক্যালসিয়ামের সব চাইতে ভালো উৎস। ক্যালসিয়াম আমাদের দাঁত ও হাড়ের গঠন মজবুত করে। এ ছাড়াও ক্যালসিয়াম ভিটামিন ডি এর সাহায্যে আমাদের হাড় ও দাঁতে শোষিত হয়ে হাড় ও দাঁতের গঠন দৃঢ় করে এবং দাঁতের ক্ষয়রোধ করে। নিয়মিত দুধপান করলে দেহে বার্ধক্যও আসে দেরিতে।
মাংসপেশির গঠন উন্নত করে : দুধে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন যা মাংসপেশির গঠনে অনেক বেশি সহায়তা করে। দুধ মাংসপেশির আড়ষ্টতা দূর করতে সক্ষম। যারা নিয়মিত ব্যায়াম এবং খেলাধুলা করেন তাদের জন্য প্রতিদিন ১ থেকে ২ গ্লাস দুধপান অত্যন্ত জরুরি। বাচ্চাদের মাংসপেশির গঠন উন্নত করতেও প্রতিদিন দুধপান করা প্রয়োজন।
ওজন কমাতে সহায়তা করে : প্রতিদিন ১ গ্লাস দুধ পান করলে অন্যান্য খাবারের চাহিদা অনেকাংশে কমে যায় এবং নাশতার সময় দুধ পান করলে অনেকটা সময় দুধ পেটে থাকে। ফলে আজেবাজে খাবারের চাহিদা কমে। এতে করে ওজনও কমে যায়। দুধ পানের ফলে দেহে অনেক ধরনের পুষ্টি উপাদান পৌঁছায় যার কারণে যারা ডায়েট করে ওজন কমাতে চান তাদের জন্যও এটি সুপারফুড।
ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে : প্রতিদিন দুধ পান করলে ত্বকে এর বেশ ভালো প্রভাব পড়ে। ত্বক হয় নরম, কোমল ও মসৃণ। তাই প্রতিদিন খাবার তালিকায় ১ গ্লাস দুধ রাখা প্রয়োজন।
মানসিক চাপ দূর করে : দুধের অন্য একটি বড় গুণ হচ্ছে এটি মানসিক চাপ দূর করতে সহায়তা করে। দুধ পানে ঘুমের উদ্রেক হয়, যার ফলে মস্তিষ্ক শিথিল হয়ে যায় এবং মানসিক চাপ দূর হয়।
বুক জ্বালাপোড়া বন্ধ করে : অনেক ধরনের খাবার আমরা খাই যার ফলে আমাদের অ্যাসিডিটি হয় এবং বুক প্রচ- জ্বালাপোড়া করে। এর সব চাইতে সহজ এবং সুস্বাদু সমাধান হচ্ছে দুধপান। দুধপানে পাকস্থলী ঠা-া হয় এবং বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা দূর হয়।
দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে : দুধে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি, ভিটামিন, মিনারেল রয়েছে যা দেহের ইমিউন সিস্টেম উন্নত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এটি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং রক্ত পরিষ্কারের পাশাপাশি রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে।
দই খাওয়ার উপকারিতা 
দুগ্ধজাত সব খাবারের মধ্যে দই সবচেয়ে সহজপাচ্য। দুধের সব পুষ্টিগুণ এতে আছে। অনেকে মনে করেন, দই চর্বিহীন খাদ্য। এ ধারণা ভুল। দইয়ে দুধের সমানই চর্বি থাকে। মিষ্টি দইয়ে চিনি মেশানো হয় বলে ক্যালরি দুধের চেয়ে বেশি থাকে। তবে অন্যান্য উপাদান একই থাকে। দুধ পাকস্থলীতে গিয়ে বিপাক হয়ে দইয়ে পরিণত হয় বলে দইকে ডাইজেস্টেড দুধ বলা যেতে পারে। এটা ‘মিট টেন্ডারাইজার’ হিসেবে কাজ করে। মাছ-মাংস বা অধিক গুরুপাক খাবার খেলে শরীরে ‘পিউট্রিফ্যাকটিক’ নামের ব্যাকটেরিয়া উৎপন্ন হয়। যা শরীরে ক্ষতি করতে পারে। এটা প্রতিরোধ করার জন্য দই খুবই উপকারী। টক দই শরীরের মেদ কমায়। প্রতিদিন ১৮ আউন্স (৫১০ গ্রাম) দই খেলে ওজন কমে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন ২ কাপ করে দই খান, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যদের থেকে বেশি থাকে। দই যেকোনো ব্যাকটেরিয়াল/ফাঙ্গাল ইনফেকশন থেকে রক্ষা করবে। টক দই রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এলডিএল (খউখ) কমায়। দইয়ে থাকা অ্যান্টিআক্সিডেন্ট শরীর ঠা-া রাখে। রক্ত পরিষ্কারেও সাহায্য করে। রক্তে থাকা টি সেলকে শক্তিশালী করে। দইয়ে থাকা ব্যাকটেরিয়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এ ছাড়া বিভিন্ন ভিটামিন ¯œায়ুতন্ত্র (নার্ভাস সিস্টেম) ভালো রাখে। দইয়ে আছে আমিষ ও শর্করার সঠিক অনুপাত। তাই ব্যায়াম করার পর দই খাওয়া স্বাস্থ্যকর। বেশির ভাগ মানুষ প্রতিদিন প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণ লবণ গ্রহণ করে। যা উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি ও হৃদরোগের জন্য দায়ী।  প্রতি ৮ আউন্স (২২৬ গ্রাম) দইয়ে আছে ৬০০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, যা শরীর থেকে অতিরিক্ত সোডিয়াম বের করে দিতে সাহায্য করে। টক দইয়ে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’ আছে, যা হাড় ও দাঁতের গঠন মজবুত করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া দই খেলে ক্যাভিটিস (ক্ষয়রোগ) হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। 
খুশকি দূর করতে মাথার স্ক্যাল্পে দই ব্যবহার করা হয়। দইয়ে থাকা ল্যাকটিক এসিড ও অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান খুশকি কমায়। টক দইয়ের আছে ল্যাকটিক এসিড, যা কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়রিয়া কমায়। উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা নিয়মিত টক দই খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, হার্টের রোগীরাও নিয়মিত টক দই খেয়ে গ্লুকোজ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন।
ঘি খাওয়ার উপকারিতা
শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের জন্যই ঘি খুবই উপকারী। পুষ্টিবিদদের মতে, আলসার ও কোষ্টকাঠিন্য এবং স্বাস্থ্যকর চোখ ও ত্বকের চিকিৎসায় ওষুধ তৈরিতে ঘি ব্যবহার করা হয়। ঘিতে রয়েছে ভিটামিন ‘এ’, ‘ডি’, ‘ই’ ও ‘কে’। অন্যান্য উপাদানের চেয়ে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ই’-এর চমৎকার উৎস ঘি। জলপাইয়ের তেল ও নারিকেলের তেলের মতো ঘিতেও সে সমস্ত স্বাস্থ্যকর পুষ্টি বিদ্যামান, যা শরীরের চর্বি পোড়াতে সাহায্য করে এবং ওজন হ্রাস করে। ঘিতে মধ্যম চেইন ফ্যাটি এসিড বিদ্যমান। যা, লিভার সরাসরি শোষণ করতে পারে এবং দ্রুত বার্ন করতে পারে। আমরা যে সকল কার্বযুক্ত খাবার গ্রহণ করি, তার মধ্যে এটি শক্তির একটি স্বাস্থ্যসম্মত উৎস। ঘি লিনোলেনিক এসিডসমৃদ্ধ, এটি এক প্রকার ফ্যাটি এসিড যা ‘প্লাক’কে প্রতিরোধ করে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং হার্টের বিভিন্ন রোগ দূর করে। ঘিতে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড বিদ্যামান। যা রক্তের কোলেস্টেরল কমিয়ে ফেলে এবং হার্টের সুরক্ষা প্রদান করে।
ঘিয়ে রয়েছে বিউটারিক অ্যাসিড, একটি সংক্ষিপ্ত চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড যার বেশ কিছু সুবিধা আছে। অনেক সুবিধার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী সুবিধা হলো এটি হজম শক্তি বৃদ্ধি করে। আমাদের শরীর ফাইবারকে বিউটারিক অ্যাসিডে রূপান্তর করে। তাই ঘি খাবার ফলে বিউটারিক অ্যাসিড পরিপাক নালীর কাজে সাহায্য করে এবং এটি সুস্থ রাখে। বিউটারিক অ্যাসিড শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এটি শরীরের ক্ষতিকারক সেল ধ্বংস করতে পারে। প্রদাহ দূর করার এটি একটি         প্রাকৃতিক উপায়। নিয়মিত ঘি খাদ্য তালিকায় রাখলে, তা শরীরের প্রদাহ দূর করে। হজমশক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে ঘি ক্ষুধা কমানোর ক্ষেত্রেও ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। ঘি ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ। যা আমাদের চোখের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। মস্তিষ্কের সুরক্ষায় ঘি খুবই উপকারী। এটি একাগ্রতা বাড়াতে ও স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করে। একই সঙ্গে শরীর ও মন ভালো রাখে। ঘি একটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টপূর্ণ খাবার। এ উপাদান অন্যান্য খাবারের ভিটামিন ও মিনারেলের সঙ্গে মিশে রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়িয়ে দেয়। মাংসপেশির সঙ্গে হাড়ের গঠন মজবুত করে ঘি এবং ঘি দিয়ে তৈরি খাবার। ত্বকের যতেœ ঘি খুব উপকারী। ঘি সুন্দর থাকতে এবং চামড়া টানটান রাখতে সাহায্য করে। ঘি এবং ঘিযুক্ত খাবার গ্রহণে পরিমিত হতে হবে। একবারে বেশি খাওয়া যাবে না। দিনে ১০ থেকে ১৫ গ্রাম ঘি খাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া অতিরিক্ত ওজন সমস্যায় ভুগলে ঘিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলাই উত্তম বলে মনে করেন পুষ্টিবিদরা। (অশৎধস.গবঃ.ধষ. (২০২০). ঐবধষঃয. ইবহবভরঃং ড়ভ সরষশ ধহফ গরষশ চৎড়ফঁপঃং.)
মাখনের উপকারিতা
মাখনকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় মৃক্ষণ। দইয়ে জল মিশিয়ে মন্থন করলে মাখন বেরিয়ে আসে। গবেষকদের মতে, মাখন স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী একটি খাদ্য। মাখনে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’, যা আমাদের চোখের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারি। এ ছাড়াও  ভিটামিন ডি, ই এবং কে এর অন্যতম উৎস হলো মাখন। মাখনে রয়েছে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন খনিজ উপাদান যেমন- ম্যাঙ্গানিজ, ক্রোমিয়াম, জিংক, কপার এবং সেলেনিয়াম। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিডের অন্যতম উৎস মাখন। যা রক্তের কোলেস্টেরল কমিয়ে ফেলে এবং হার্টের সুরক্ষা প্রদান করে। মাখনে রয়েছে গ্লাইকোস্পিনগোলিপিডস, যা পরিপাক তন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা থেকে দেহকে রক্ষা করে। মাখন একটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টপূর্ণ খাবার। এ উপাদান অন্যান্য খাবারের ভিটামিন ও মিনারেলের সঙ্গে মিশে রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়িয়ে দেয়। মাখনে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-বি হাড় এবং অস্থিসন্ধির রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
পনিরের উপকারিতা
পনির একটি দুগ্ধজাত খাবার। এটি চর্বিজাতীয় খাবার হওয়ায় অনেকের ধারণা, এটি ওজন বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই বিশেষ দিবস বা অনুষ্ঠান ছাড়া আমাদের দেশে পনিরের ব্যবহার খুব বেশি চোখে পড়ে না। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত খাদ্য তালিকায় পনির রাখা উচিত। কারণ পনিরে রয়েছে ক্যালসিয়াম, সোডিয়ামসহ শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ। পনিরে বিদ্যমান উচ্চমানের প্রোটিন এবং ক্যালসিয়াম স্বাস্থ্যসুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া পনিরে লিনোলিক এসিড ও স্পিনগোলিপিডস নামে এক ধরনের উপাদান রয়েছে যা মরণব্যাধি ক্যান্সার প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। পাশাপাশি এর ভিটামিন বি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। পনিরের উচ্চমানের ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন বি হাড়কে শক্তিশালী করে। এছাড়াও শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে পনির সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ কারণে শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক পর্যন্ত সবার প্রতিদিনের খাবারে কিছুটা হলেও পনির রাখা উচিত। (ণড়ঁহম, ড.চ. বঃ ধষ. (২০১৩). গরষশ ধহফ ফধরৎু চৎড়ফঁপঃং রহ ঐঁসধহ ঘঁঃৎরঃরড়হ : চৎড়ফঁপঃরড়হ, ঈড়সঢ়ড়ংরঃরড়হ ধহফ ঐবধষঃয, ১৮, ৩৯০-৪০২) 

লেখক : ভেটেরিনারি সার্জন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি খামার সড়ক, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল-০১৮১১-৯৮৬৬০৫; ইমেইল-ংসসড়যরনঁষষধয@মসধরষ.পড়স