Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ

আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ
ড. মো. শরফ উদ্দিন
আম সারা বিশে^ সব মানুষের কাছে একটি পছন্দনীয় ফল। কিন্তু এদেশে আমের মৌসুম মাত্র ৩-৪ মাস। ফলে বছরের অন্যান্য সময় আমের চাহিদা থাকলেও  সে সময়ে আমের চাহিদা মেটানো যায় না। সারা বছর এই জনপ্রিয় ফলকে ভোক্তাদের নিকট সহজলভ্য করার অন্যতম পদ্ধতি হচ্ছে প্রক্রিয়াজাতকরণ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমের অনেক প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য উৎপন্ন করে। তারা এই প্রক্রিয়াজাত পণ্যগুলো দেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানি করে। এই ভাবে কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থায় আমের ব্যবহার হয় এবং চাষিরা আমের নায্যমূল্য পেয়ে থাকে। ফলশ্রুতিতে আমের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমে আসে। কিন্তু আমাদের দেশে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমের প্রক্রিয়াজাতকৃত পণ্য উৎপাদিত করে থাকে। এই পণ্যগুলোর মধ্যে আমের আচার, চাটনি, আমসত্ত্ব, আমচুর ড্রিংস ইত্যাদি। তাছাড়া বাড়িতে মা বোনেরা আমের বিভিন্ন পণ্য ঘরোয়াভাবে তৈরি করে থাকেন। নি¤েœ আম প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরিকৃত পণ্য এবং এদের প্রস্তুত প্রণালী নিয়ে আলোচনা করা হলো-
আমসত্ত্ব
উপকরণ: পাকা আম ১ কেজি, সরিষার তেল ১০০ এমএল, চিনি পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালী: আম ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে তা থেকে রস বের করে নিতে হবে। রস চুলায় জ্বাল দিয়ে কিছুটা ঘন হয়ে আসলে ঠা-া করে একটি প্লেটে রসের একটি প্রলেপ দিয়ে তা রোদে শুকাতে হবে। প্রলেপ শুকিয়ে আসলে পুণরায় নতুন প্রলেপ দিতে হবে। এভাবে  ৫-৭টি প্রলেপ শুকিয়ে আমসত্ত্ব তৈরি করা হয়। আমসত্ত্ব ভালোভাবে শুকিয়ে গেলে সুবিধামতো সাইজ করে কেটে সংরক্ষণ করতে হবে। প্লেট থেকে আমসত্ত্ব উঠানোর সুবিধার্থে রসের প্রলেপ দেয়ার আগে একটু সরিষার তেল মাখিয়ে নিতে হবে। রোদে শুকানোর সময় এতে যাতে মাছি না বসে ও ধুলি ও বালি না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রস চুলার তাপে না দিয়ে সরাসরি শুকিয়েও আমসত্ত্ব তৈরি করা যায়। আম টক হলে রসের সাথে কিছুটা চিনি যোগ করতে হয়। আমসত্ত্ব দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে হলে রসের সাথে ০.০৫% সাইট্রিক এসিড ও ০.১% পটাশিয়াম মেটা-বাইসালফেট যোগ করা যেতে পারে। তবে বিদেশে এই পণ্যটির ব্যাপক চাহিদা আছে। ফলে তারা বাণিজ্যিকভাবে এটি তৈরি করে থাকেন। আমাদের দেশে সাধারণত খোলা আকাশের নিচে শুকানোর কাজটি করা হয় কিন্তু বিদেশে এটি পলিনেট হাউজ এ সম্পন্ন করা হয়। ফলে ধুলাবালি ও কীটপতঙ্গের সংস্পর্শে আসার আশঙ্কা কম থাকে। আমাদের দেশে আমসত্ত্বগুলো ৫০০-৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা যায়। কিন্তু বিদেশে প্যাকেটজাত আমসত্ত্বগুলো ১২০০-১৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। প্রকৃতপক্ষে এর জন্য বড় কোন কলকারখানা স্থাপনের প্রয়োজন হয় না। বেশ কয়েকজন আমচাষি একত্রে মিলে এই কাজটি করতে পারেন।
আমের মোরব্বা
উপকরণ: কাঁচা আম ১ কেজি, চিনি ২ কেজি, এলাচ, দারুচিনি, তেজপাতা পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালী : কাঁচা আমের খোসা ছাড়ানোর পর ফালি ফালি করে কেটে নিয়ে ফালিগুলো কাঁটাচামচ বা অন্য কোন শলাকা দিয়ে কেঁচে ছিদ্র ছিদ্র করতে হবে। এবার ফালিগুলোকে গরম পানিতে ডুবিয়ে হাত দিয়ে চিপে চিপে টক পানি বের করে ফেলতে হবে। চিনির সিরা তৈরি করে আগুনে জ¦াল দিতে হবে। সিরা ঘন হয়ে আসলে তাতে আমের ফালিগুলো দিয়ে অল্প তাপে রান্না করতে হবে। সিরা যখন আমের ফালির গায়ে লেগে আসবে তখন তাপ বন্ধ করে দিতে হবে। ঠা-া হলে পরিষ্কার পাত্রে ভরে সংরক্ষণ করতে হবে। চিনির সিরা তৈরির সময় তাতে এলাচ, দারুচিনি ও তেজপাতা মিশানো যেতে পারে।
আমের জেলি
উপকরণ : পাকা আম ২ কেজি, চিনি ৪০০ গ্রাম, পানি ২ লিটার, লেবুর রস ২ চা চামচ।
প্রস্তুত প্রণালী : আমের খোসা ছাড়িয়ে পাত্রে পানি নিয়ে সিদ্ধ করতে হবে। আম সিদ্ধ হলে এবং পানি অর্ধেক হলে নামাতে হবে। সিদ্ধ আম ভাল করে মিশিয়ে পাতলা কাপড়ে ছেঁকে রস আলাদা করতে হয়। সংগ্রহীত রসের সাথে চিনি মিশিয়ে রান্না করতে হবে। যখন পাত্র ফেনায় ভরে উঠবে তখন লেবুর রস দিতে হবে। আমের রস ঘন হয়ে আসলে তার এক ফোঁটা পানিতে ফেলে যদি দেখা যায় যে তা বসে যাচ্ছে তখন তাপ বন্ধ করে শুকনা বোতলে বা কাঁচের বয়মে ভর্তি করে ঠা-া জায়গায় রেখে দিতে হবে। জেলি ঠা-া হলে বোতলের মুখ বন্ধ করতে হবে। জেলি তৈরিতে কাঁচা আমও ব্যবহার করা যায়। তবে চিনির পরিমাণ একটু বেশি দিতে হয়। লেবুর রসের পরিবর্তে ভিনেগার বা সাইট্রিক এসিডও ব্যবহার করা যেতে পারে।
আমের আচার
কাঁচা আম দিয়ে বিভিন্ন প্রকারের সুস্বাদু ও মুখরোচক আচার তৈরি করা হয়। এদের কোনটি ঝাল, কোনটি মিষ্টি, কোনটি গুড় দ্বারা আবার কোনটি চিনি দ্বারা তৈরি। অনেকে আচার তৈরি করে তা বিক্রিও করে থাকেন। নি¤েœ  আচার তৈরির ৪টি পদ্ধতি আলোচনা করা হলো।
প্রথম পদ্ধতি
উপকরণ : পরিপুষ্ট কাঁচা আম ১ কেজি, চিনি ৫০০ গ্রাম, ভিনেগার ১৭৫ মিলি., এলাচ, শুকনা মরিচ এবং লবণ পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালী : এটি আচার তৈরির অত্যন্ত সহজ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে প্রথমে আমের খোসা ছাড়িয়ে সাইজমতো কেটে তাতে লবণ মাখিয়ে রোদে শুকাতে হবে। ২/৩ দিন শুকানোর পর একটি পাত্রে কাটা আম নিয়ে তাতে চিনি, ভিনেগার, এলাচ, শুকনা মরিচ যোগ করে কিছুক্ষণ চুলায় তাপ দিতে হবে। ফালিগুলো সিদ্ধ হলে ঠা-া করে পরিষ্কার বয়মে ভর্তি করে সংরক্ষণ করতে হবে।
দ্বিতীয় পদ্ধতি
উপকরণ: কাঁচা আম ১ কেজি, চিনি ৩৭৫ গ্রাম, মৌরি ৫ গ্রাম, মেথি ৫ গ্রাম, শুকনা মরিচ ৩/৪ টি, রসুন ২টি, আদা ২০ গ্রাম, তেজপাতা ২/৩ টি, লবণ পরিমাণমতো।
প্রণালী : আমের খোসা ছাড়িয়ে গোল বা লম্বা করে কাটতে হবে। এবং আমের ফালিগুলো কাঁটা চামচ দিয়ে কেঁচে ছিদ্র ছিদ্র করতে হবে। তারপর কাটা আম গরম পানিতে সিদ্ধ করে পরিষ্কার পাতলা কাপড় দিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। এরপর আমের সাথে চিনি ও অন্যান্য উপাদানগুলো মিশিয়ে তাপ দিতে হবে। কিছুক্ষণ তাপ দিলে আচার প্রস্তুত হয়ে যাবে। কয়েকদিন রোদে শুকিয়ে কাঁচের বয়মে সংরক্ষণ করতে হবে।  
তৃতীয় পদ্ধতি  
উপকরণ: কাঁচা আম ১ কেজি, চিনি ২৫০ গ্রাম, মৌরি ৫ গ্রাম, মেথি ৫ গ্রাম, শুকনা মরিচ ৩/৪টি, রসুন ২টি, আদা ২০ গ্রাম, তেজপাতা, লবণ পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালী: যে কোন বয়সের আম দ্বারা এ আচার বানানো যায়। আম খোসা ছাড়ানোর পর ফালি করে কেটে নিতে হবে। একটি পাত্রে সরিষার তেল নিয়ে চুলায় তাপ দিতে হবে। তেল গরম হলে সেখানে সমগ্র উপকরণ কিছুটা ভেজে নিয়ে তাতে কাটা আম চিনিসহ আরও তাপ দিতে হবে। আচার ঘন হয়ে আসলে চুলা থেকে নামাতে হবে। আম বেশি টক হলে চিনির পরিমাণ বাড়াতে হবে। আচার ২/৩ দিন রোদে শুকিয়ে কাঁচের বয়মে সংরক্ষণ করতে হবে।  
চতুর্থ পদ্ধতি
উপকরণ: কাঁচা আম ১ কেজি, পাঁচ ফোড়ন ৩০ গ্রাম, সরিষার তেল ২০০ মিলি., সরিষা বাটা ২ টেবিল চামচ, হলুদ ১ চা চামচ, আস্তা ধনিয়া ২ চা চামচ, রসুন বাটা ১ টেবিল চামচ, চিনি, ভিনেগার, লবণ, তেল পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালী : প্রথমে আম খোসাসহ ফালি করে কেটে ভিনেগার, লবণ ও হলুদ মাখিয়ে ৫/৬ ঘণ্টা রোদে রেখে দিতে হবে। এরপর একটি পাত্রে সরিষার তেল নিয়ে রসুন, পাঁচফোড়ন, ধনিয়া, সরিষা বাটা, চিনিসহ চুলায় তাপ দিতে হবে। মিশ্রণটি ঘন হয়ে এলে তার ভেতর আমের ফালিগুলো দিয়ে উল্টো করে নাড়তে হবে। এরপর ঠা-া করে দুই-একদিন রোদে শুকিয়ে কাচের বয়মে সংরক্ষণ করতে হবে।  
আমের প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রয়োজনীয়তা
এদেশে স্থানীয় জাতের আমের উৎপাদন অনেক বেশি এবং প্রায় সকল জেলাতেই পাওয়া যায়। কিন্তু এর ব্যবহার অনেক কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, খুব কম দামে স্থানীয় বাজারে বিক্রয় হয়। আম গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আশাবাদ অন্যান্য দেশের মতো আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্ভব হলে আমের ক্ষতি অনেকাংশে কমে আসবে। মোট উৎপাদনের  ১০-২০ ভাগ প্রক্রিয়াজাতকরণ করা সম্ভব হলে আমের দাম বাড়বে এবং আমচাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। বর্তমানে যে কোম্পানিগুলো আমের প্রক্রিয়াজাত করছে তার পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি, আম সেক্টরে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। গ্রাম, গঞ্জ ও শহরে অনেক মহিলারা আছেন যারা অত্যন্ত মজাদার পণ্য তৈরি করতে পারেন। এইসব দক্ষ মহিলাদের চিহ্নিত করে তাদের তৈরি পণ্যকে ব্রান্ডিং করা যেতে পারে। তাঁদের বাণিজ্যিকীকরণের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। আমের প্রক্রিয়াজাতকরণে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। বিগত কয়েক বছর আমচাষিরা আমের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এ ছাড়া আমের মৌসুমে ঝড়ে প্রচুর পরিমাণে কাঁচা ও আধাপাকা আম ঝরে পড়ে। এমতাবস্থায়, কাঁচা ও পাকা আমের প্রক্রিয়াজাতকরণের বিকল্প নেই। সুতরাং বাংলাদেশের যে এলাকাগুলোতে প্রচুর পরিমাণে আম উৎপাদন হয় সেসব এলাকায় আম প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করা সম্ভব হলে আমের ব্যবহার বাড়বে, চাষিরা আমের ন্যায্যমূল্য পাবে এবং আমের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি অনেক কমে আসবে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১২১৫৭৯৮৯ ই-মেইল  sorofu@yahoo.com