Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

মাশরুম একটি অসীম সম্ভাবনাময় ফসল

মাশরুম একটি অসীম সম্ভাবনাময় ফসল
ড. আক্তার জাহান কাকন
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সময়োপোযোগী দিকনির্দেশনা ও কৃষি খাতে অকুণ্ঠ সমর্থনে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সরকারের এখন লক্ষ্য কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণ ও লাভজনক করা এবং সকলের জন্য পুষ্টিসম্মত খাদ্য নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে মাশরুম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
মাশরুম একটি পুষ্টিকর (উন্নত মানের আমিষ, ভিটামিন ও খনিজসমৃদ্ধ), সুস্বাদু ও ঔষধিগুণসম্পন্ন ফসল। মাশরুম চাষ করার জন্য কোন আবাদি জমির প্রয়োজন হয়না। অনুৎপাদনশীল ফেলনা জমির স্বল্প পরিমাণ ব্যবহার করেই অধিক পরিমাণ মাশরুম উৎপাদন করা যায় বিধায় মাশরুম চাষ বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টির জোগান দিতে পারে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ কৃষিজ, শিল্পজ ও বনজ উপজাত যেমন- খড়, আখের ছোবরা, ভুট্টার কব ও কাঠের গুঁড়া উৎপন্ন হয়, তা দিয়েই মাশরুম উৎপাদন সম্ভব। মাশরুম একটি জৈব ফসল কারণ এটি চাষের জন্য কোন কীটনাশক, রোগনাশক এমনকি রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয়না। মাশরুম স্বল্প পুজিঁতে চাষ শুরু করা যায়। বেকার, প্রতিবন্ধী ও মহিলাদের বিশেষ করে গ্রামীণ নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। বিশ্বব্যাপী মাশরুমের চাহিদা আছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া সারাবছর মাশরুম চাষের জন্য উপযোগী। মাশরুম ঘরে চাষ করা হয় বিধায় অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, খড়া, বন্যা, ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাশরুমের কোন ক্ষতি করতে পারে না।
সম্ভাবনাময় এ ফসলটির চাষ সম্প্রসারণের প্রধান অন্তরায় আমাদের খাদ্যাভ্যাসে মাশরুম না থাকা। এদেশের প্রচলিত অন্যান্য ফসলের চাষ পদ্ধতির সাথে মাশরুম চাষ পদ্ধতির মিল না থাকা এবং মাশরুম চাষে উচ্চমূল্যের যন্ত্রপাতি ও উচ্চ প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের প্রয়োজন হওয়া। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষণায় এদেশে মাশরুম চাষের উপযোগী স্বল্পখরচের যন্ত্রপাতি ও সহজ প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে, তবুও এসব যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি সম্পর্কে জনগণের ব্যাপক পরিচিতির অভাব রয়েছে।
এ প্রেক্ষিতে, মাশরুমের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য, ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে মাশরুম চাষে সম্পৃক্ত করতে বর্তমান সরকার ৫ বছর মেয়াদে (জানুয়ারি ২০২৩ হতে ডিসেম্বর ২০২৭) ৯৬৬৪.১১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে মাশরুম চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্পটি অনুমোদন করেছেন, যেখানে সহজ সরল প্রযুক্তির প্রদর্শন থাকবে, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে এবং আরও নতুন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের সুযোগ থাকবে।
অষ্টম পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনায় ফসল উপখাতের কৌশলসমূহে পুষ্টিকর, নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য খাদ্য উৎপাদন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা, বসতবাড়ির আঙ্গিনায় খালি জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে বিশেষ জোর দিয়ে হলিস্টিক ফার্মিং সিস্টেম এ্যাপ্রোচ এর মাধ্যমে কৃষকদের জীবিকা ও আয় বৃদ্ধি করা, প্রধান খাদ্যে (চাল) এরই মধ্যে অর্জিত স্বয়ম্ভরতা অক্ষুণœ রেখে বিদ্যমান ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ, ভূমির ঠবৎঃরপধষ ঊীঢ়ধহংরড়হ এর মাধ্যমে নগর কৃষির প্রসার, কৃষিতে নারী ও যুবদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কৃষকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে, মাশরুমের গুণাগুণ, সম্ভাবনা ও সুযোগ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারের ফলে দেশে মাশরুমের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতা হ্রাস,  কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, মাশরুম রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি, নতুন মাশরুম উপকেন্দ্র স্থাপন, পুরাতন উপকেন্দ্র ও মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দেশে ভূমির ঠবৎঃরপধষ ঊীঢ়ধহংরড়হ বৃদ্ধি পাবে। এতে মাশরুম চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে গতিশীলতা বৃদ্ধি এবং আমদানি ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, সাভার, ঢাকা এবং ৩৪টি মাশরুম উপকেন্দ্র/হর্টিকালচার সেন্টার রিসোর্স সেন্টার হিসেবে এবং ৬৪টি জেলার ১৬০টি উপজেলা ও ১৫টি মেট্রোপলিটন থানা সম্প্রসারণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। প্রকল্প সমাপ্তে বীজ উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, সাভার, ঢাকা এবং ৩৪টি মাশরুম উপকেন্দ্র/হর্টিকালচার সেন্টারকে প্রদত্ত অর্থ রিভলব করার জন্য এবং উদ্যোক্তার বাড়িতে কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য  প্রদর্শনীর বীজ/স্পণ ও মাশরুম বিক্রির লভ্যাংশ থেকে যন্ত্রপাতি, চাষঘর মেরামত ও স্পণ উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনা রয়েছে তাতে সকলের বীজ প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে।
মাশরুম নতুন ও অপ্রচলিত ফসল এবং প্রচলিত আবশ্যিক অন্যান্য ফসলের মতো কোন খাদ্য না হওয়ার কারণে এতদিনেও মানুষের তেমন কোন  চাহিদা তৈরি হয়নি। পুষ্টিগুণ বিবেচনায় আমাদের খাদ্যাভাসে মাশরুম যুক্ত করলে দেশে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বাস; এরা প্রতিদিন মাত্র ২৫ গ্রাম করে মাশরুম  খেলেও বছরে ১৬৪২০০০০ মে. টন মাশরুম প্রয়োজন হবে। আর ১০% মানুষও যদি মাশরুম খান তাহলে প্রতিদিন ৪৫০ মে. টন মাশরুম প্রয়োজন হবে। মাশরুম চাষ সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয় করতে পারলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। দেশে বর্তমানে প্রায় ৪০-৪২ হাজার মেট্রিক টন মাশরুম প্রতি বছর উৎপাদন হচ্ছে যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।
যে সকল জেলায় হর্টিকালচার সেন্টারে কার্যক্রম চালু আছে, বড় উদ্যোক্তা আছে, সেখানে সাধারণ চাষিদের উৎপাদনের আগ্রহ বেশি কারণ উদ্যোক্তারা তাদের বাজারের নিশ্চয়তা প্রদান করে থাকে।
আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালের তুলনায় শীতকালে অধিক মাশরুম উৎপাদন হয়ে থাকে। এসব উৎপাদিত মাশরুম স্থানীয় কাঁচা বাজার (বিশেষ করে পাহাড়ে), ফ্রাই শপে, সুপার শপে, ছোট ছোট হোটেলে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া মাশরুমজাত বিভিন্ন পণ্য যেমন : স্যুপ, আচার, ফেসপ্যাক, হেয়ার ওয়েল, সাবান, মাশরুম ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, শুকনা ও পাউডার মাশরুম বাজারে বিক্রি হচ্ছে। মাশরুম খাওয়ার পদ্ধতি জনগণের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রচার করলে ভোক্তার সংখ্যা বাড়বে ও বাজার সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ অনেক দেশেই  মাশরুম রপ্তানির  সুযোগ রয়েছে। শিক্ষিত বেকার যুবক, যুবতীদের  প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে পারলে মাশরুমের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে, মাশরুম অত্যন্ত পুষ্টিগুণসম্পন্ন হওয়ায় সহজেই মানুষের পুষ্টি চাহিদার অনেকটা পূরণ হবে। আশা করা যায় মাশরুম চাষের এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সারা দেশে দ্রুততার সাথে কৃষক ও উদ্যোক্তা পর্যায়ে সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয় করার মাধ্যমে অচিরেই বাংলাদেশে এক অসবুজ বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।

লেখক : প্রকল্প পরিচালক (উপপরিচালক), মাশরুম চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্প, সাভার, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৮১৩৭১১৩; ই-মেইল : kakon.smdp@gmail.com