Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

আম-রফতানি-এবং-আর্থসামাজিক-ভাবনা

আম রফতানি এবং আর্থসামাজিক ভাবনা
মোহাম্মদ আরিফুর রহমান
বউভুলানী, জামাইপছন্দ শব্দগুলো শুনতেই কেমন যেন চটুলভাব জাগে। একটু হালকা আমেজ, রসালোভাব। প্রকৃত অর্থে এটি রসালো ফল আমেরই জাতের নাম। অনেকেই আমকে ফলের রাজা বলে অভিহিত করেন। স্বাদ, গন্ধে ও পুষ্টিতে অতুলনীয়। আম অর্থ সাধারণ। বাংলাদেশে আম জনসাধারণের অত্যন্ত জনপ্রিয় ফল। রসাল বা মধু ফলও বলা হয় আমকে।  অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সুস্বাদু আমকে জাতীয় ফল হিসেবে এশিয়া মহাদেশের তিনটি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানের পাশাপাশি ফিলিপাইনের জাতীয় ফল আম। বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে আম গাছকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। 
আমের অর্থনীতি
আমের আছে বাহারি নাম, বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদ। ফজলি, আশ্বিনা, ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতি, গোপালভোগ, মোহনভোগসহ রয়েছে অসংখ্য জাতের আম। ধারণা করা হয় প্রায় ৩০০ জাতের আমের দেখা মেলে। তবে অনেকগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়। প্রত্যেকটি জাতের সাথে আছে এক একটি ইতিহাস, যেমন ফজল বিবি থেকে ফজলি। 
বিশ্বে ৫৩টি দেশে আম উৎপাদন হয়। বাংলাদেশ উৎপাদনের দিক থেকে ৯ম অবস্থানে রয়েছে (এফএও, ২০২২)। দেশে বছরে ২৪-২৫ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। আমের মৌসুমে আম সংগ্রহ, পরিবহন, প্যাকেজিং এর সাথে জড়িত কর্মকা-ের সাথে জড়িয়ে আছে ব্যাংকিং লেনদেন। পাশাপাশি আম সংগ্রহের মৌসুমে কানসাট, বানেশ্বর, সাপাহারসহ স্থানীয় আড়তে হোটেল রেস্টুরেন্ট ব্যবসা থেকে শুরু করে অসংখ্য মৌসুমি লেবার বা ব্যক্তিবর্গ এর সাথে জড়িত। দেশে ১৩-১৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য আমকেন্দ্রিক হয়।
আম রফতানি
বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে আম উৎপাদন হলেও খুব সামান্য পরিমাণে আম রফতানি হয়। বিগত ৫ বছরে আম রফতানির চিত্র হতে দেখা যায় ২০১৯ সালে আম রফতানির পরিমাণ ২৮৩ মেট্রিক টন হলেও চলতি বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৯১ মেট্রিক টন। ৫ বছরের রফতানির পরিমাণ প্রায় দশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে উৎপাদিত ৭২টি জাতের মধ্যে ৮-৯টি জাতের আম রফতানি হচ্ছে। 
উত্তম কৃষি চর্চার মাধ্যমে আম উৎপাদন
খাদ্যাভাসের ব্যাপারে মানুষ দিন দিন সচেতন হচ্ছে। নিরাপদ খাদ্য গ্রহণে মানুষ আগ্রহী। নিরাপদ খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি মানুষ খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া জানতে চায়। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের একটি জনপ্রিয় প্রযুক্তি উত্তম কৃষি চর্চা (এড়ড়ফ অমৎরপঁষঃঁৎধষ চৎধপঃরপব)। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা-২০২০ অনুমোদন করেছে। বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালার আলোকে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ২৪৬টি প্যারামিটার অনুসরণ করে থাকে। ২০২২ সাল হতে মাঠপর্যায়ে আম ফসলে উত্তম কৃষি চর্চার প্রয়োগ হচ্ছে। সরকারিপর্যায়ে রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের আওতায় উত্তম কৃষি চর্চা প্রয়োগের জন্য ৮৪০০টি প্রদর্শনী স্থাপনের মাধ্যমে কৃষকদের হাতে কলমে নিরাপদ আম উৎপাদন কৌশল শিখানো হচ্ছে, যা বিদেশে আম রফতানি সম্পর্কে আগ্রহ বাড়াচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় নিরাপদ আম উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে উত্তম কৃষি চর্চা বিষয়ে কৃষক, রফতানিকারক এবং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।  
আম রফতানি ক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা
বিশ্বে আম রফতানির বাজারটি বেশ প্রতিযোগিতামূলক। আন্তর্জাতিক বাজারে আম রফতানির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এর পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির প্রধান শর্ত হলো আমদানিকারক দেশসমূহের চাহিদা অনুসারে মানসম্পন্ন আম উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। বাংলাদেশে আম রফতানির যেসকল প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তাহলো-
 পরিকল্পিতভাবে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে মানসম্পন্ন নিরাপদ আম উৎপাদন না করা;
 পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও জীবাণুমুক্ত স্বাস্থ্যকর পরিবেশে আম উৎপাদন ও উন্নত সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আমদানিকারক দেশের আরোপিত শর্তাবলী পূরণ না করা;
 রফতানিযোগ্য উন্নত আম উৎপাদন, বিপণনের ক্ষেত্রে ভ্যালুচেইনের সাথে সংশ্লিষ্ট আম উৎপাদনকারী, সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, কোয়ারেন্টাইন, গবেষক এবং রফতানিকারকদের সমন্বয়ের অভাব;
 আম সংগ্রহের পর আমের গুণগত মান বজায় রেখে যথাযথভাবে গ্রেডিং, প্যাকিং করে কুলিং ভ্যানের মাধ্যমে আম পরিবহন না করা;
 আমে উপস্থিত পেস্টিসাইডের রেসিডিউ এনালাইসিস ও ফলের গুণগত মান পরীক্ষার জন্য অ্যাক্রিডিটেশন ল্যাব না থাকা;
 আম উৎপাদনের সাথে প্রয়োজনীয় উপকরণ ফ্রুুট ব্যাগ ও অন্যান্য উপকরণসহ এয়ার ফেয়ার এর কারণে প্রতিযোগিতামূলক বাজারের সাথে প্রতিযোগিতা করার মানসিকতার অভাব; 
 সেলফ লাইফ কম, সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে যথাযথ প্রযুক্তি ও কৌশল ব্যবহার না করা এবং সংগ্রহ পর্যায় শনাক্তকরণের অভাব;
 নতুন বাজার সৃষ্টি করতে না পারা, ব্রান্ডিং ইমেজ তৈরি না করা;
 উৎপাদন এলাকায় আধুনিক প্যাকিং হাউজ এর সুযোগ-সুবিধার অভাব;
 রফতানিযোগ্য আম উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার, কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও সমন্বয়ের অভাব;
 আমের উন্নত সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কোয়ারেন্টাইন পেস্ট নিয়ন্ত্রণে সেন্সর বেইজড হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, ভিএইচটিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, অবকাঠামো ও উন্নত প্রযুক্তির অভাব;
 ট্রেসিবিলিটি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে রেকর্ড কিপিং যথাযথভাবে না করা।
আম রফতানি বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
আম রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যেসকল সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে সেসকল সমস্যাসমূহ সমাধানকল্পে নি¤েœাক্ত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
 প্রধান প্রধান আম উৎপাদন অঞ্চল চিহ্নিত করা ও উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ;
 কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর মাধ্যমে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে আম উৎপাদন;
 জীবাণুমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্ম পরিবেশ নিশ্চিতকরণ;
 ফার্ম রেকর্ড বইয়ে যাবতীয় ডাটা লিপিবদ্ধকরণ;
 গবেষণা কার্যক্রম জোরদারকরণ;
 আধুনিক প্যাকিং হাউজ স্থাপন;
 আম সংগ্রহ, সংগ্রহোত্তর কাজ এবং পরিবহনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা।
সামগ্রিক বিবেচনায় খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরে যে ধারা চলমান রয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় বাণিজ্যনির্ভর আমকে রফতানি বাণিজ্যে সম্পৃক্ত করার সরকারের নীতিগত উদ্যোগের ফলে এই শিল্পের ক্রমবিকাশ অবশ্যম্ভাবী। দেশের ঐতিহ্য সুস্বাদু আম রফতানির লক্ষ্যে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিরাপদ ও উচ্চ মানসম্পন্ন আম উৎপাদন করা সম্ভব হবে। সম্ভাবনাময় আম রফতানি বাণিজ্য বৃদ্ধির সাথে সাথে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।  
 
লেখক : প্রকল্প পরিচালক, রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প, মোবাইল : ০১৮১৯৪৫৭৫৭৪, ই-মেইল : ঃamrahman46@gmail.com