Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

স্মার্ট-ইকোনমির-নতুন-খাত:-পাটকাঠি-হতে-উৎপাদিত-চারকোল

স্মার্ট ইকোনমির নতুন 
খাত : পাটকাঠি হতে উৎপাদিত চারকোল
ড. মো. আবদুল আউয়াল১ ড. মো. আবু সায়েম জিকু২ ড. এ. টি. এম. মোরশেদ আলম৩
পাট পরিবেশবান্ধব, বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য প্রাকৃতিক আঁশ যা গোল্ডেন ফাইবার নামে পরিচিত। এই সোনালী আঁশ পাট আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে জড়িত। অর্থকরী ফসল হিসাবে পাট থেকে পরিবেশবান্ধব বহুমুখী পাটজাতপণ্য উৎপাদন করতে পারলে দ্রুত সোনালি আঁশের অতীত ঐতিহ্যে পাটকে ফিরে আনা সম্ভব হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পাটজাত পণ্যকে ২০২৩ সালের ‘বর্ষপণ্য’ এবং ১লা মার্চ ২০২৩ সালে এক প্রজ্ঞাপণের মাধ্যমে পাটকে ‘কৃষিপণ্য’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর তথ্য মতে, বর্তমানে পাট উৎপাদন ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে ১ম স্থান দখল করে আছে। চারকোল পাটখড়ি হতে উৎপাদিত একটি সম্ভাবনাময় পাটজাত পণ্য যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম বলে পাট গবেষকগণ মনে করেন। 
উন্নত বিশে^ চারকোলের বিস্তৃত ব্যবহার বিদ্যমান। বর্তমানে সোনালি আঁশ পাটের পাশাপাশি অপ্রচলিত রপ্তানি পণ্য পাঠকাঠি থেকে চারকোল বা কার্বন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। চারকোল হলো কার্বনের একটি কালো, ছিদ্রযুক্ত রূপ, যা প্রায়ই অঙ্কন, স্কেচিং এবং অন্যান্য শৈল্পিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। এটিই মূলত চারকোল বা এক্টিভেটেড কার্বন, যা পাটখড়ি থেকে উৎপাদিত একটি পণ্য। এর শোষক এবং শোষণকারী বৈশিষ্ট্যের কারণে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ধাতুবিদ্যা এবং ওষুধের মতো শিল্পগুলোতেও ব্যবহৃত হয়। সহজভাবে বলা যায়, পাটকাঠির ছাই থেকে এক ধরনের জ্বালানি উৎপন্ন হয় যা চারকোল নামে পরিচিত। বর্তমান বিশে^ পরিবেশবান্ধব পাটকাঠির ছাইয়ের কদর দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণ কাঠের (খড়ি) জ্বালানির দাহ্য ক্ষমতার চেয়ে চারকোলের দাহ্য ক্ষমতা অনেক বেশি, সে কারণে চাহিদাও বেশি। যদিও বিভিন্ন দেশে কাঠের গুঁড়া, নারিকেলের ছোবড়া ও বাঁশ থেকেও চারকোল উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত পাটকাঠি থেকেই চারকোল উৎপাদিত হয়ে আসছে। পাটকাঠি বা পাটখড়িকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ও যথাযথ প্রক্রিয়ায় পুড়িয়ে এরপর শীতলীকরণ ও সংকোচন করে চারকোল তৈরি করা হয়। এতে প্রায় ৭৫ শতাংশ কার্বন থাকে। তবে সহজভাবে বলা যায়, বিশেষ চুল্লিতে পাটখড়ি লোড করে তাতে আগুন দেয়া হয় এবং ১০-১২ ঘণ্টা রাখার পরে চুলা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়, যাতে চুলার ভেতরে অক্সিজেন প্রবেশ করতে না পারে। এভাবে ৪ দিন রাখার পরে এটি কার্বনে পরিণত হয়। পরে সেই কার্বন এর পিন্ডটি প্যাকেজিং করে বিশে^র বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।
২০০৯ সাল থেকে সীমিত পরিসরে চারকোল রপ্তানির কার্যক্রম শুরু হয়। আর ২০১২ সাল হতে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় চারকোল উৎপাদন। পাটের আঁশের পাশাপাশি সম্ভাবনার নতুন খাত পাটকাঠি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি এই উচ্চমূল্যের অ্যাকটিভেটেড কার্বন এখন রপ্তানির নূতন দ্বার উন্মোচন করতে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত চারকোল এর  প্রায় ৮০% চীনে রপ্তানি হয়। বাকি ২০% রপ্তানি হচ্ছে মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি ও তাইওয়ানে। দেশের বিভিন্ন জেলায় চারকোল উৎপাদন শিল্প গড়ে উঠেছে। চারকোল কারখানার মালিকরা পাট কাটার মৌসুমে পাটকাঠি কিনে ফ্যাক্টরিতে পাঠাতে তাদের এজেন্টদের প্রতিটি এলাকায় পাঠিয়ে দেয়। ফলে,  কৃষকরা এখন পাটের সঙ্গে পাটখড়িও বিক্রি করছে। বাংলাদেশে ১০-১২টি চারকোল উপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়াও বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, ফরিদপুর, জামালপুর মাগুরাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে চারকোল কারখানা স্থাপিত হওয়ায় রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্য মতে, দেশের কার্বন ফ্যাক্টরিগুলো জুলাই-আগস্ট থেকেই পাটকাঠি কেনা শুরু করে। অক্টোবর থেকে মার্চ, এপ্রিল মাস পর্যন্ত চারকোল মিলগুলো উৎপাদনে ব্যস্ত থাকে। 
পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসল হতে বিভিন্ন ধরনের পণ্য ছাড়াও পাটের বহুমুখী ব্যবহারের মধ্যে চারকোলের অবস্থান পরিবেশগত ও অর্থনৈতিকভাবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সহজ পদ্ধতিতে পাটকাঠিকে কার্বনাইজ করে চারকোল তৈরি করা যায়। তাই উৎপাদন খরচও কম হয়। ফলে চারকোলের কদর ও অপার সম্ভাবনা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটির মূল উপাদন হলো বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কার্বনকে একীভূত করা। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে চারকোল শুধুমাত্র রান্নার কাজে ব্যবহৃত হতো। এই ছাইয়ের ভেতরের কার্বন পাউডার থেকে তৈরি হচ্ছে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, জীবনরক্ষাকারী বিষনিরোধক ট্যাবলেট, পানি বিশুদ্ধকরণ তথা পানির ফিল্টার তৈরিতে ব্যবহার্য কাঁচামাল, আতশবাজি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি ও পলিমার ব্যাটারি, ফেসওয়াশের উপকরণ, প্রসাধনসামগ্রী, মাউথওয়াশ, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধের কাঁচামাল। যথার্থ মেধার প্রয়োগ ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে চারকোলের গুণগতমান ও ঘনত্ব উত্তরোত্তর আরো বৃদ্ধি পেলে অদূর ভবিষ্যতে কাঠের বিপরীতে পাটকাঠিই হয়ে উঠতে পারে বিশ^ব্যাপী চারকোলের প্রধান কাঁচামাল। পরিবেশবিদদের মতে, একটি দেশে ২৫% বনভূমি থাকা উচিত কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে মাত্র ৮% থেকে ৯% বনভূমি রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর পাট কাঠির গড় উৎপাদন ২৪৮০.৬২ হাজার টন। পাটের কাঠি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হলে  কাঠের ওপর নির্ভরতা হ্রাস পাবে, যা বনভূমির উজাড়  হওয়া কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে গবেষকগণ মনে করেন। 
বাংলাদেশ চারকোল ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সাপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ইঈঈগঊঅ) ২০১৬ সাল থেকে অনানুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। এ প্রতিষ্ঠানটি চারকোলের বহুমুখী ব্যবহার ও নতুন বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করার ফলে ২০১৮ সালে  আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধন লাভ করায় অ্যাসোসিয়েশন এখন বিভিন্ন দেশে রপ্তানি বাড়াতে গুরত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। প্রতি মণ পাটখড়ি থেকে প্রায় ৮ কেজি চারকোল পাউডার বা কার্বন উৎপাদিত হয়। যার প্রতি কেজি উৎপাদন খরচ প্রায় ৭৫/- থেকে ৮০/- টাকা। বর্তমানে প্রতি কেজি চারকোলের বাজারমূল্য প্রায় ৮৫/- থেকে ৯০/- টাকা। উল্লেখ্য যে, রপ্তানির ক্ষেত্রে চারকোল ব্যবসায়ীগণ ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ২০% প্রণোদনা পেয়েছেন। ফলে,  রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি চারকোল থেকে আর্থিক লাভ হয় প্রায় ২৩/- টাকা। পাটকাঠি দিয়ে যে চারকল তৈরি হচ্ছে তা বিদেশে রপ্তানি করে  গত বছর বাংলাদেশ  প্রায় ১৬০ কোটি টাকা আয়  করেছে,  এতে করে ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। হিসাবমতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ টন পাটকাঠি উৎপাদিত হয়। প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী, এই উৎপাদিত পাটকাঠির ৫০ ভাগও যদি চারকোল উৎপাদনে যথাযথভাবে ব্যবহার করা যেত, তাহলে প্রতি বছর ৩ লক্ষ টন চারকোল উৎপাদন সম্ভব, যা বিদেশে রপ্তানি করে প্রতি বছর অন্তত ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব, একইসাথে সারাদেশে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এর ফলে  আর্থসামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং পাট চাষে পাট চাষিদের আগ্রহ বাড়বে ও পাট ফিরে পাবে তার হারানো গৌরবউজ্জ্বল ঐতিহ্য। এই খাতকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার পাটখড়ি থেকে উৎপাদিত চারকোলের রপ্তানি বাড়াতে চারকোল নীতিমালা ২০২২ প্রণয়ন করেছে। এই নীতি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে টেকসই চারকোল শিল্প ও সোনালি আঁশ পাটের অবদান জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) দেশের কৃষি পরিবেশ ও কৃষকদের চাহিদা বিবেচনায় নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে এবং পাট ফসলের বহুমুখী ব্যবহারের উপর বিভিন্ন ধরনের গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত বিজেআরআই কেনাফ এইচসি ৯৫ জাতটি হাওর এলাকার জন্য উপযোগী ও আঁশ মৌসুমে এই জাতটি ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হয়, যার পাটকাঠি সাদা, অনেক লম্বা, নরম, মসৃণ যা উন্নত মানের চারকোল তৈরির জন্য উপযোগী। ফলে এটি হাওর এলাকার মানুষের  আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। অন্যদিকে চারকোলের কাঁচামালের উৎস হিসেবে পাটকাঠির জন্য কৃষকেরাও কেনাফ চাষে আরো বেশি আগ্রহী হবে।
ক্রমবর্ধমান বিশ্বের সঙ্গে তালমিলিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে অগ্রসর হতে বর্তমান সরকারের নানা পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর লক্ষ্য, সেটি অর্জনে আমাদের অন্যতম চালিকাশক্তি হতে পারে চারকোল। পরিশেষে, স্মার্ট ইকোনমি হিসেবে সম্ভাবনার নতুন খাত চারকোলকে কাজে লাগাতে পারলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি কৃষক ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে চারকোল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। 

লেখক: ১মহাপরিচালক, ২ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা বিজ্ঞান শাখা ৩মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৭১৭-৫৬২৬৭৩, ই-মেইল : jikuly@gmail.com or sayem@bjri.gov.bd